রাজউকের ‘গাফিলতি’, নির্মাতাদের ‘অনিয়ম’

কারওয়ান বাজার মোড়ের কাছে রাস্তা ধসে হোটেল সুন্দরবন ঝুঁকিতে পড়ার ঘটনায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ‘অবহেলা’ এবং পাশের বহুতল ভবন নির্মাণের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ‘অনিয়মের’ অভিযোগ এনে কঠোর ব্যবস্থা নিতে বলেছেন খোদ মেয়র ও স্থানীয় সাংসদ।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 May 2015, 01:52 PM
Updated : 27 May 2015, 06:50 PM

সাংসদ ফজলে নূর তাপস বলেছেন, “রাজউকের দায়িত্ব রাজধানীর সকল নির্মাণ কাজ তদারক করা। এ ক্ষেত্রে রাজউক চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। যে প্রতিষ্ঠান নির্মাণ চালাচ্ছে তারাও যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়নি।”

বুধবার সকালে বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক লাগোয়া হোটেল সুন্দরবন এবং ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের নির্মাণাধীন টুইন টাওয়ারের মাঝের ১৫ ফুট প্রশস্ত সড়কটি ধসে পাশের পাইলিংয়ের গর্তে চলে যায়।

এ ঘটনায় সুন্দরবন হোটেল ঝুঁকির মধ্যে পড়ায় ফায়ার সার্ভিসের পরামর্শে তাৎক্ষণিকভাবে অতিথিসহ সবাইকে ছয়তলা হোটেল ভবন থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়।

সুন্দরবন হোটেল কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা পাইলিং নিয়ে আগে থেকে সতর্ক করলেও ন্যাশনাল ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তা আমলে নেয়নি। নির্মাতা প্রতিষ্ঠান যে পাইলিংয়ের ক্ষেত্রে যথাযথ নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেয়নি, তা ফায়ার ব্রিগেড কর্মকর্তাদের কথাতেও এসেছে। 

তবে নির্মাণ কাজের দায়িত্বে থাকা এম এস কনস্ট্রাকশনস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কর্তৃপক্ষের দাবি, তাদের কোনো ‘ভুল ছিল না’।

প্রাথমিক সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, সিটি করপোরেশন, রাজউকসহ অন্যান্য সংস্থার প্রতিনিধি নিয়ে ১২ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে।

তাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আপাতত বালির বস্তা ফেলে নতুন করে ধস ঠেকানোর চেষ্টা চললেও, ওই গলির সামনের অংশে বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়কে ফাটল তৈরি হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।       

এদিকে ধসের ঘটনায় দোষীদের চিহ্নিত করতে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করেছে রাজউক।

গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন জানিয়েছেন, কমিটিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

বিকট শব্দে ধস

স্থানীয়রা জানান, সকাল সাড়ে ৭টার দিকে বৃষ্টি শুরুর পর হোটেল সুন্দরবন ও নির্মাণাধীন ভবনের মাঝে ওই গলিপথের একেবারে শুরু থেকে প্রায় ১২০ ফুট রাস্তার তলার মাটি বৃষ্টিতে আলগা হয়ে ধস নামে।

সুন্দরবন হোটেলের সীমানা প্রাচীর ও বেইজমেন্টের দেওয়াল, গলির মুখের বিদ্যুতের খুঁটি, কয়েকটি গাছ, ফুটপাতের একটি অংশ এবং সেখানে থাকা কয়েকটি টং দোকান ও রিকশা ভ্যান ওই গর্তে পড়ে যায়।

রাস্তা ধসের খবর পেয়ে ফায়ার ব্রিগেডকর্মীরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। প্রাথমিকভাবে আতঙ্ক তৈরি হলেও কিছুক্ষণ পর সেখানে উৎসুক মানুষের ভিড় জমে যায়। পরিস্থিতি সামাল দিতে মোতায়েন করা হয় বিপুল সংখ্যক পুলিশ ও র‌্যাব।

রাস্তা ধসে পড়ায় সুন্দরবন হোটেলের বেইজমেন্টে ওয়াসার পাইপ ফেটে যায়; গ্যাস লাইনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

পাইপ ফেটে যাওয়ায় বিপুল বেগে পানির ধারা ওই ধসে পড়া অংশের মাটি ধুয়ে পাইলিংয়ের গর্তে পড়তে থাকলে আরও বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি হয়। সেই সঙ্গে গ্যাসের গন্ধে নতুন বিপদ ঘটার আশঙ্কা তৈরি হয়।

এরই মধ্যে সুন্দরবন হোটেলের কয়েকটি স্থানে ফাটল দেখা দিলে আতঙ্ক বাড়ে। এই পরিস্থিতিতে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা হোটেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে অতিথিসহ সবাইকে সারিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করে।

তবে এ ঘটনায় কেউ হতাহত হননি বলে কলাবাগান থানার ওসি মো. ইকবাল জানান।

খবর পেয়ে ওয়াসা ও বিদ্যুৎ বিভাগের লোকজনও ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। ওয়াসাকর্মীরা পানি সরবরাহ এবং বিদ্যুৎকর্মীরা বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে ঝুঁকি কমানোর চেষ্টা করেন। পরে গ্যাসের লাইনও বন্ধ করা হয়। 

কারওয়ান বাজারে রাস্তার পাশের এ অংশটি ঢাকা দক্ষিণের হলেও ধসের খবর পেয়ে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ঘটনাস্থলে আসেন ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হক।

গলিপথের অবস্থা দেখে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “জায়গাটি ভয়াবহ অবস্থায় আছে। এমনকি মূল রাস্তাটিও ধসে পড়তে পারে।”

মেয়র আনিসুলের পরামর্শে সুন্দরবন হোটেল, নির্মাণাধীন ভবনসহ ওই এলাকা ঘিরে ফেলা হয়। তিনি নিজেও সবাইকে অনুরোধ করেন যাতে, অতি উৎসাহী হয়ে কেউ ভেতরে গিয়ে বিপদে না পড়েন। 

তোপের মুখে রাজউক

বেলা সাড়ে ১১টার দিকে স্থানীয় সাংসদ ফজলে নূর তাপসকে সঙ্গে নিয়ে ঘটনাস্থলে আসেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন।

এ বিষয়টি তদারকির দায়িত্ব যে প্রতিষ্ঠানের হাতে, সেই রাজউকের কাউকে ধসের ঘটনার চার ঘণ্টা পরও সেখানে না পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে মেয়র খোকন বলেন, “এটা সম্পূর্ণভাবে কর্তব্যে অবহেলা।”

রাস্তা ধসে পড়ায় আশেপাশের স্থাপনাগুলো ‘বড় ধরনের ঝুঁকিতে’ পড়েছে মন্তব্য করে পরিস্থিতি যাতে আরও খারাপের দিকে না যায় সেজন্য জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়ার ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।

ভবন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানেরও ‘অবহেলা’ ছিল মন্তব্য করে মেয়র বলেন, “এটা টলারেট করা যায় না।”

ফজলে নূর তাপস বলেন, পরিস্থিতির যে ‘ভয়াবহতা’ তারা দেখতে পেয়েছেন তাতে হতাহতের ঘটনাও ঘটতে পারত।

“রাজউকের দায়িত্ব রাজধানীর সকল নির্মাণ কাজ তদারক করা। এ ক্ষেত্রে রাজউক চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। যে প্রতিষ্ঠান নির্মাণ চালাচ্ছে তারাও যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়নি।”

তাপস বলেন, “তারা নাকি তিন তলা বেইজমেন্ট করার প্ল্যান করেছে। কিন্তু সেজন্য যে অনুমতি দরকার তারা তা নেয়নি।... এদের বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আমি আহ্বান জানাচ্ছি।”

তারা গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার সময় সেখানে উপস্থিত হয়ে তোপের মুখে পড়েন রাজউকের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান।

রাজউকের এই সদস্যের (উন্নয়ন) কাছে তারা জানতে চান, তদারক সংস্থা থাকার পরও কীভাবে নিয়ম না মেনে পাইলিংয়ের কাজ শুরু হল। 

প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত রাজউকের এই সদস্য (উন্নয়ন) এক পর্যায়ে সাংবাদিকদের বলেন, “রাজউকের দায়ভার থাকতে পারে, তবে যারা ভবন নির্মাণ করছিল, তাদের দায়ভারই সবচেয়ে বেশি।”

নির্মাণ সংস্থা ‘বিধি মানেনি’ জানিয়ে তিনি বলেন, “যদি মানত, তাহলে তো এ ঘটনা ঘটত না।”

অনিয়ম হয়ে থাকলে রাজউক মামলা করবে এবং তদারকিতে গাফিলতি থাকলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

সন্ধ্যায় ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, “এখানে এসে যা দেখলাম, তাতে মনে হল পাইলিংয়ে অসামঞ্জস্যতা রয়েছে। এটা আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পয়েন্ট অব ভিউ থেকে বললাম।”

রাজউকের বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মন্ত্রী বলেন, “রাজউকের অতবড় জনবল নেই যে একটা নকশা অনুমোদন করার পর তারা আবার তদারকি করবে। যারা ভবনের মালিক তাদেরই এটা তদারকির দায়িত্ব।

প্রাকৃতিক বিপর্যয়!

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নির্মাণাধীন ভবনের ফুটপাত লাগোয়া অংশে কয়েকদিন আগেই ফাটল দেখা দেয়। তারপরও নির্মাতা প্রতিষ্ঠান কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। 

আর বর্ষা মৌসুমে পাশে রাস্তা ও একটি উঁচু ভবন থাকায় পাইলিংয়ের সময় যে ধরনের নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ ছিল, এক্ষেত্রে তা নেওয়া হয়নি বলে সাংবাদিকদের জানান ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ খান।

তবে নির্মাণাধীন ভবনের নকশায় কোনো সমস্যা ছিল না কিনা, তা ‘না দেখে বলা যাবে না’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

সুন্দরবন হোটেলের জেনারেল ম্যানেজার ওয়াজেদ আলী বলেন, “আমরা তাদের আগে থেকেই সতর্ক করে বলেছিলাম, তাদের পাইলিং ঠিকমতো হচ্ছে না। কিন্তু তারা আমাদের কথা শোনেনি, তারা কাজ চালিয়ে গেছে।”

এ বিষয়ে কলাবাগান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছিল বলেও জানান তিনি।

তবে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এম এস কনস্ট্রাকশনস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের মালিক মোহাম্মদ সালাউদ্দিনের দাবি, তাদের কাজে ‘কোনো সমস্যা নেই’।

“আমরা রাজউকের বিধি মেনেই কাজ করছিলাম। আমাদের ওয়ার্ক এরিয়ার মধ্যে কিন্তু কোনো সমস্যা হয়নি, সমস্যা হয়েছে একটু পাশে।”

এখন পর্যন্ত ‘যতটুকু হয়েছে’, তা ‘রিকভার করার’ চেষ্টা করছেন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি হয়ে যাওয়ার পর ন্যাশনাল ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এ ঘটনাকে দেখছে ‘প্রাকৃতিক বিপর্যয়’ হিসাবে।

ব্যাংকের অতিরিক্ত পরিচালক আব্দুল হামিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভবনটি আমাদের হলেও এটি ডেভেলপ করছিল অন্য একটি প্রতিষ্ঠান। আমার যেটা মনে হচ্ছে, সাম্প্রতিক সময়ে ভূমিকম্প এবং গত কয়েকদিনের বৃষ্টির কারণে হয়ত এ ধরনের একটি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ইন্টারনাল ফ্যাক্টরই এর জন্য দায়ী।”

সুন্দরবন হোটেল বাঁচাতে ‘বালির বাঁধ’

সুন্দরবন হোটেল এবং তার আশপাশের এলাকা যাতে নতুন করে ঝুঁকির মধ্যে না পড়ে, সেজন্য দুপুরে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলীর নেতৃত্বে ১২ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়।

দুপুরে ওই কমিটির বৈঠকে প্রাথমিক ব্যবস্থা হিসাবে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় বালু ফেলার সিদ্ধান্ত হয়। শুরুতে ধসে পড়া অংশে বালুর বস্তা ফেলা হলেও দুপুরের পর থেকে সরাসরি বালু ফেলে সুন্দরবন হোটেলকে বাঁচানোর চেষ্টা চলে।

এর মধ্যেও বিকাল ৪টার পর সুন্দরবন হোটেলের বেইজমেন্টের দেওয়ালের খানিকটা অংশ ভেঙে পড়ে। তবে ভবনের মূল খুঁটি ও বিমগুলো ‘অক্ষত রয়েছে’ বলে রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী হাফিজুর রহমান জানান।

ঢাকা দক্ষিণের প্রধান প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, এ ধরনের ঘটনায় আগেও বালি ফেলে ধস ঠেকানো সম্ভব হয়েছে। সুতরাং, সুন্দরবন হোটেল ধসে পড়ার আশঙ্কা আপাতত তারা দেখছেন না।   

এম এস কনস্ট্রাকশনস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের প্রকল্প পরিচালক জানান, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে বুধবারই ৫০০ ট্রাক বালু ফেলা হচ্ছে। তিন দিনে ১৫শ’ ট্রাক বালু ফেললে ‘সমস্যার সমাধান হবে’ বলে তারা আশা করছেন।