মুজাহিদের চূড়ান্ত রায় ১৬ জুন

একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের আপিলের রায় ঘোষণা হবে ১৬ জুন।

সুপ্রিম কোর্ট প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 May 2015, 07:13 AM
Updated : 27 May 2015, 03:22 PM

দুই পক্ষের শুনানি শেষে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ বুধবার রায়ের এই দিন ঠিক করে দেন।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সাংবাদিক, শিক্ষকসহ বুদ্ধিজীবী হত্যা এবং সাম্প্রদায়িক হত্যা-নির্যাতনের দায়ে ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড দেয়।

অপহরণ, নিযার্তন ও হত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের সাতটি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি ঘটনায় আলবদর বাহিনীর প্রধান মুজাহিদের সংশ্লিষ্টতা ট্রাইব্যুনালে প্রমাণিত হয়।

২০১০ সালে যুদ্ধাপরাধের বহু প্রতীক্ষিত বিচার শুরুর পর এটি চতুর্থ মামলা, যা আপিল আদালতে রায়ের পর্যায়ে এল।

আপিল শুনানি শেষে অ্যার্টনি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা নানা রকম কাগজ-পুস্তক ও মৌখিক সাক্ষ্য দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছি, যাতে আমরা সার্থক হয়েছি। আশা করছি, সর্বোচ্চ আদালতেও ট্রাইব্যুনালের আদেশটা বহাল থাকবে।”

অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেন, “এই মামলায় আমাদের পক্ষে যেসব যুক্তি ছিল, সেগুলো আমরা সাধ্যমতো আপিল বিভাগে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আমাদের উপস্থাপিত যুক্তিগুলো বিবেচনায় নিয়ে আদালত মুজাহিদকে এই মামলার সব অভিযোগ থেকে খালাস দেবেন বলে আমরা প্রত্যাশা করছি।”

বিগত চার দলীয় জোট সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী মুজাহিদ যে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা করতে গঠিত আলবদর বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন এবং ওই বাহিনীর ওপর তার ‘কার্যকর নিয়ন্ত্রণ’ ছিল, তা উঠে আসে ট্রাইব্যুনালের রায়ে।

এর আগে যুদ্ধাপরাধের তিনটি মামলায় আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায় এসেছে; দণ্ড কার্যকর হয়েছে জামায়াতের দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের।

আপিল বিভাগের আরেক রায়ে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তবে সেই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত না হওয়ায় রিভিউ নিষ্পত্তি হয়নি।

আর শুনানি চলার মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধকালীন জামায়াত আমির গোলাম আযম ও বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমের মৃত্যু হওয়ায় তাদের আপিলের নিষ্পত্তি হয়ে গেছ।

বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আপিল এর আগে কার্যতালিকায় এলেও এখনও শুনানি শুরু হয়নি। সব মিলিয়ে যুদ্ধাপরাধের যে ১৪টি মামলার আপিল সর্বোচ্চ আদালতের হাতে এসেছে, তার মধ্যে আটটিই শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।

কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালে নিয়ে যাওয়ার পথে জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ

ট্রাইব্যুনালের রায়

মুজাহিদের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা সাতটি অভিযোগের মধ্যে ১, ৩, ৫, ৬ ও ৭ নম্বর অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে প্রমাণিত হয়। তবে ২ ও ৪ নম্বর অভিযোগে তার সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হয়নি বলে রায়ে জানানো হয়।

প্রথম অভিযোগে সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে অপরণের পর হত্যা এবং ষষ্ঠ অভিযোগে বুদ্ধিজীবীসহ গণহত্যার ষড়যন্ত্র ও ইন্ধনের অভিযোগে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয় এই জামায়াত নেতার।

একই সাজা হয় সপ্তম অভিযোগে, ফরিদপুরের বকচর গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর বর্বর হামলা চালিয়ে হত্যা-নিযার্তনের ঘটনায়।

এছাড়া পঞ্চম অভিযোগে সুরকার আলতাফ মাহমুদ, গেরিলা যাদ্ধা জহিরউদ্দিন জালাল ওরফে বিচ্ছু জালাল, শহীদজননী জাহানারা ইমামের ছেলে শাফি ইমাম রুমি, বদিউজ্জামান, আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল ও মাগফার আহমেদ চৌধুরী আজাদসহ কয়েকজনকে ঢাকার নাখালপাড়ায় পুরনো এমপি হোস্টেলে আটকে রেখে নির্যাতন এবং জালাল ছাড়া বাকিদের হত্যার ঘটনায় সংশ্লিষ্টতার জন্য মুজাহিদকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

আর তৃতীয় অভিযোগে ফরিদপুর শহরের খাবাসপুরের রণজিৎ নাথকে অপহরণ ও নির্যাতনের ঘটনায় পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয় মুজাহিদকে।

তবে দ্বিতীয় অভিযোগে ফরিদপুরের চরভদ্রাসনে হিন্দু গ্রামে গণহত্যা এবং চতুর্থ অভিযোগে আলফাডাঙ্গার আবু ইউসুফ ওরফে পাখিকে আটকে রেখে নির্যাতনের ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেলেও তাতে মুজাহিদের সংশ্লিষ্টতা প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে পারেনি বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়। এ দুটি অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেয়া হয়।

ফাঁসির রায়ের পর ট্রাইব্যুনাল থেকে কারাগারে ফিরিয়ে নেয়া হচ্ছে মুজাহিদকে

মামলার ইতিবৃত্ত

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগের একটি মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে গ্রেপ্তার করার পর ২ অগাস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

মামলার শুনানি শেষে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ২০১২ সালের ২১ জুন ট্রাইব্যুনালে মুজাহিদের বিচার শুরু হয়।

২০১৩ সালের ১৭ জুলাই ট্রাইব্যুনালে এই জামায়াত নেতার ফাঁসির রায় আসে। ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের ১১ অগাস্ট আপিল করেন মুজাহিদ।

রাষ্ট্রপক্ষ আপিল না করলেও শুনানিতে অংশ নিয়ে দণ্ড বহাল রাখতে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে। গত ২৯ এপ্রিল শুনানি শুরুর পর মঙ্গল ও বুধবার যুক্তি উপস্থাপনসহ নয় দিন আপিলের ওপর শুনানি গ্রহণ করেন বেঞ্চের চার বিচারপতি।

এ বেঞ্চের অপর সদস্যরা হলেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।  

বুধবার শুনানির নবম দিনে রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন শেষ করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। সঙ্গে ছিলেন সহকারী অ্যার্টনি জেনারেল মো. রশির আহমেদ।

আদালতে আসামিপক্ষে শুনানি করে আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন ও এস এম শাজাহান। সঙ্গে ছিলেন শিশির মনির।

দুই পক্ষের যুক্তি

আপিল শুনানি শেষে অ্যার্টনি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, “এই মামলায় আমরা দেখানোর চেষ্টা করেছি, মুজাহিদ ছাত্র সংঘের সভাপতি হিসেবে আল-বদরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ছাত্র সংঘের অধিকাংশ সদস্যই আল-বদরের সঙ্গে সেসময় যুক্ত ছিলেন।”

এক পাকিস্তানি লেখকের লেখা ‘আল-বদর’ নামের একটি বই শুনানিতে তুলে ধরার কথা জানিয়ে মাহবুবে আলম বলেন, “সেখানে দেখা যায়, ইসলামী ছাত্র সংঘের নাজেম (প্রধান) হিসাবে মুজাহিদ সে সময় এ বাহিনীর উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন।”

রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বলেন, “সে সময় মুজাহিদ যেসব বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন, তা মুক্তিযোদ্ধা, ভারত ও হিন্দুবিদ্বেষী বক্তব্য।... কোনো পাঠাগারে কোনো হিন্দু লেখকের বই যাতে না থাকে... থাকলে সেগুলো ধ্বংস করা হবে, পুড়িয়ে ফেলা হবে- ইত্যাদি হুমকিও ছিল। সেসব পুরানো কাগজ আমরা এই মামলায় প্রর্দশন করেছি।”

মাহবুবে আলম বলেন, “বুদ্ধিজীবী হত্যা ছিল ষষ্ঠ চার্জ; সপ্তম চার্জ ছিল একটি গণহত্যা। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের লাইন করে দাঁড়িয়ে মুজাহিদের নির্দেশে মারা হয়। মারা যাওয়া দুইজন ব্যক্তির সন্তান সাক্ষ্য দিয়েছেন। একজন মারতে দেখেননি। একজন গাছের ওপর থেকে ঘটনা দেখেন। এ ঘটনাগুলো প্রমাণিত হয়েছে বলেই ট্রাইব্যুনাল তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছেন।”

শুনানির বিষয়ে মাহবুবে আলম বলেন, “আমরা বলেছি আল-বদর বাহিনীর প্রধান না হলে কেন তাদের অনুষ্ঠানে তিনি কেন যাবেন। উনার ছবি আল-বদর প্রধান হিসেবে কেন ছাপা হবে। ‘মুক্তিযুদ্ধে যারা অংশগ্রহণ করে তাদের নিঃশেষ করে দাও’- এরকম কথা সাধারণ লোক হলে উনি বলতেন না। উনি একজন আলবদরের নেতা হিসেবে এ কথাগুলো বলেছেন। এই কথাগুলো আমরা তুলে ধরেছি।”     

অন্যদিকে শিশির মনির সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, “আমরা বলেছি, মুজাহিদ ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাস থেকে ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি ছিলেন। এটি সত্য কথা। এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার কোনো কারণ নেই। কিন্তু তিনি আল-বদরের কমান্ডার ছিলেন, আল-বদর বাহিনীর সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা ছিল- এরকম কোনো অকাট্য যুক্তি রাষ্ট্রপক্ষ উপস্থাপন করতে পারেনি।”

আসামিপক্ষের এই আইনজীবী বলেন, “ট্রাইব্যুনালের সামনে এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন যে, মুজাহিদের নাম কোনো আল-বদর, আল শামসের তালিকায় তদন্তকালে তিনি খুঁজে পাননি। আমরা এ কথাটি আপিল বিভাগকে বার বার বলার চেষ্টা করেছি।”

বদর নেতা থেকে মন্ত্রী

জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মুজাহিদের জন্ম ১৯৪৮ সালের ২ জানুয়ারি, ফরিদপুর জেলার পশ্চিম খাবাসপুরে। ১৯৬৪ সালে মাধ্যমিক পাসের পর তিনি ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে ভর্তি হন এবং উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র থাকাকালেই জামায়াতের তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘে যোগ দেন। ১৯৬৮ সালে তাকে সংগঠনের জেলা শাখার সভাপতির দায়িত্ব দেয়া হয়।

ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭১ সালে বাংলার মানুষের স্বাধীনতার সংগ্রাম যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে, সেই বছর জানুয়ারিতে ইসলামী ছাত্রসংঘের ঢাকা জেলা শাখার সভাপতি হন মুজাহিদ। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর জুলাই মাসে সংগঠনের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সেক্রেটারির এবং এরপর প্রাদেশিক সভাপতির দায়িত্ব পান।

মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতায় ইসলামী ছাত্রসংঘের সদস্যদের নিয়ে আলবদর বাহিনী গঠিত হলে ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তার নেতৃত্ব দেন ইসলামী ছাত্রসংঘের তখনকার সভাপতি ও জামায়াতের বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামী। অক্টোবরে ওই বাহিনীর প্রধান হন মুজাহিদ। নিজামীর বিরুদ্ধেও যুদ্ধাপরাধের মামলা চলছে।

তার নেতৃত্বে আলবদর বাহিনী যুদ্ধের মধ্যে ফরিদপুর, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হত্যা, অপহরণ, লুটপাটের মতো ব্যাপক মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড চালায়। এমনকি ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের প্রস্তুতির সময়ও বাহিনী নিয়ে আত্মসমর্পণ না করার সিদ্ধান্ত নেন মুজাহিদ।

একাত্তরে তার কর্মকাণ্ডের ঘনিষ্ঠ সহযোগী পলাতক আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারকেও যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।

স্বাধীনতার পর মুজাহিদ জামায়াতের রাজনীতিতে যুক্ত হন এবং ১৯৮২ সালে কেন্দ্রীয় পরিষদের সদস্য হন। ১৯৮৯ থেকে দুই বছর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব পালনের পর ২০০০ সালে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল হন তিনি।

কোনো নির্বাচনে জয়ী হতে না পারলেও বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে সমাজকল্যাণ মন্ত্রীর দায়িত্ব পান মুজাহিদ। জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামের পরিচালনা পর্ষদেরও প্রধান তিনি।

যুদ্ধাপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার আগে ২০১০ সালের মার্চে জামায়াতে ইসলামীর এক সংবাদ সম্মেলনে মুজাহিদ বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হিসেবে পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেছে। কিন্তু মানবতাবিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধের মতো কোনো ধরনের অপরাধে জামায়াত নেতারা জড়িত ছিলেন না।