চিংড়ি নীতিমালা পুনর্বিবেচনার দাবি

দেশের দক্ষিণপশ্চিম অঞ্চলে লোনা পানি আটকে চিংড়ি চাষে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ‘ক্ষতির’ নানা দিক তুলে জাতীয় চিংড়ি নীতিমালা পুনর্বিবেচনার দাবি তুলেছেন রাজধানীতে এক আলোচনা সভার বক্তারা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 May 2015, 07:35 PM
Updated : 26 May 2015, 07:35 PM

মঙ্গলবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘প্রেক্ষিত চিংড়ি চাষ: অভিজ্ঞতা, বাস্তবতা এবং করণীয়’ শীর্ষক এই গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করে বেসরকারি সংস্থা নিজেরা করি, বেলা ও এএলআরডি।

আলোচনায় খুলনার পাইকগাছা উপজেলার কৃষক গৌতম চন্দ্র মণ্ডল ও ডুমুরিয়া উপজেলার তিলক রানী দাস চিংড়ি ঘেরের কারণে পরিবেশের ক্ষতি এবং কৃষিজীবী মানুষের ‘দুর্দশা’র বিভিন্ন চিত্র তুলে ধরেন।

বেসরকারি সংস্থা নিজেরা করির তত্ত্বাবধানে প্রায় একশ ভুক্তভোগী মানুষের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে নিজেদের অভিমত দেন তারা। চিংড়ি ঘেরের কারণে সাধারণ কৃষকরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে অভিযোগ তাদের।

গৌতম বলেন, “চিংড়ি ঘেরের কারণে কৃষি জমি হারিয়ে এ অঞ্চলের শ্রমজীবী মানুষরা বেকার জীবনযাপন করছেন। অনেকে ভিটেমাটি ছেড়ে ভারতে কিংবা দেশের অন্য কোথাও পুনর্বাসিত হয়েছেন। মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় বসতবাড়ির আঙ্গিনার গাছ, তৃণভূমি মরে যাচ্ছে। খাদ্যের অভাবে গবাদি পশুপালন কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে।”

পরিবেশ আইনবিদ সৈয়্যদা রিজওয়ানা হাসান বলেন, “কৃষক ও ভুক্তভোগী মানুষের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের পর ২০১২ সালে সর্বোচ্চ আদালত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে লোনাপানিতে চিংড়ির ঘের নির্মাণের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি নির্দেশনা দিয়েছিল। এর দুই বছরের মাথায় (২০১৪ সালে) সরকার যে ‘জাতীয় চিংড়ি নীতিমালা’ করল তাতেও আদালতের নির্দেশনার প্রতিফলন ঘটেনি। বরং সেখানে কৌশলে চিংড়ি চাষের জন্য নতুন নতুন পথ বলে দেওয়া আছে।

“চিংড়ি নীতিমালার অনেকগুলো সাংঘর্ষিক ধারা এর প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়ে ধুম্রজাল সৃষ্টি করছে। কোথাও বলা আছে জনপদে লোনাপানি আসতে দেওয়া যাবে না। আবার কোথাও লোনাপানি আসার সম্ভাব্য পথ বলে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং এই নীতিমালা বাস্তবে কোনো উপকারে আসবে না। বরং আরও জটিলতা সৃষ্টি করবে।”

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ বলেন, “চিংড়ির ঘেরগুলো একটি সন্ত্রাস নির্ভর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরি হয়।

“অন্যের জমি জবর দখল, ফসলি জমির উপর দিয়ে লোনা পানি আনা, প্রকৃতির সবুজ রূপ নষ্ট করার মতো অপরাধগুলো ঘটছে। চিংড়ি রপ্তানি থেকে যতই বৈদেশিক মুদ্রা আসুক, তাতে কোনোভাবেই দেশের জনগণের কল্যাণ হবে না। ইতোমধ্যেই সেখানে অনেক আবাদি জমি শেষ হয়ে গেছে, গাছপালা মরে গেছে, বহু মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে।”

চিংড়ি নীতিমালার সমালোচনা করে অর্থনীতিবিদ কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ বলেন, “চিংড়ি চাষে সমাজের কিছু মানুষ রাতারাতি ধনী হয়ে গেলেও সমাজের অধিকাংশ মানুষই এর ক্ষতির শিকার হয়। সরকার টেকসই উন্নয়নের যে নীতির কথা বলে এটি তার প্রতিফলন নয়। ঘের এলাকার মানুষজন পশুপালন, হাল-চাষসহ অন্যান্য কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

“এই নীতি পুনরায় বিবেচনা করা উচিত। সরকারের ভিশন ২০২১, সংবিধান, ৬ষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লংঘন এই নীতি।”

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন খুলনা অঞ্চল থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য এবং মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ।

চিংড়ি নীতিমালা নিয়ে সমালোচনার বিষয়ে তিনি বলেন, “নীতিমালা নিয়ে আপনাদের মূল্যায়নগুলো আমি ধরতে পেরেছি। আশা করছি অচিরেই এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট সচিবের সঙ্গে বসব, আপনাদেরও ডাকব।”

প্রতিমন্ত্রী বলেন, “প্রকৃতি ও পরিবেশ বিপর্যয়ের পেছনে চিংড়ির ঘের ছাড়াও আরও অনেক কারণ রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ ও প্রতিবেশী দেশ ভারতের ফারাক্কা বাঁধের কারণে দক্ষিণাঞ্চলের যে ক্ষতি হচ্ছে তা ভুলে গেলে চলবে না।

“বাঁধের কারণে নদীর পানিপ্রবাহ জনপদে আসছে না, মাটির ক্ষয় হচ্ছে ঠিকই কিন্তু নতুন পলি পড়ছে না। ফলে জমির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে, ভূ-পৃষ্ঠ নিচু হয়ে যাচ্ছে। শুধুমাত্র চিংড়ি ঘেরই সেখানকার পরিবেশগত পরিবর্তনের কারণ নয়।”

দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের মিঠাপানিতে গলদা চিংড়ি এবং লোনাপানিতে বাগদা চিংড়ির চাষ হয়। লোনাপানিতে চিংড়ি চাষ লাভজনক হওয়ায় ওই অঞ্চলে বাগদা চিংড়ির আবাদ বেশ জনপ্রিয়। বাংলাদশের চিংড়ি রপ্তানি হচ্ছে বিদেশেও।

খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের অনেক এলাকায় কৃষিজমিতে লোনাপানি আবদ্ধ করে চিংড়ির আবাদ শুরু হওয়ার ফলে কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত দিনমজুররা বেকার হয়ে পড়েন। পাশাপাশি পানির লবণাক্ততা মাটিতে প্রবেশ করে গাছপালা ও তৃণভূমি কমছে, যার প্রভাব পড়ছে তৃণভূজি গবাদি পশুর উপরেও।

সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে ২০১৪ সালে চিংড়ি চাষ নিয়ে নীতিমালা প্রণয়ন করে সরকার, পরিবেশের ক্ষতি এড়িয়ে চিংড়ি চাষের নির্দেশনা রয়েছে। তবে লাভজনক এই চাষ কোথাও নিষিদ্ধ করা হয়নি।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, “কোনো ফসলি জমিতে লোনাপানি আবদ্ধ করে চিংড়ি চাষ করতে দেওয়া ঠিক হবে না। সেটা করতে হলে এর পরিপূর্ণ প্রটেকশন গবেষণা করে বের করতে হবে। নদী তীরে লোনাপানির উৎসের কাছে চিংড়ি চাষ করা যায় কি না সেটা এখন পর্যালোচনার ব্যাপার।

“পর্যালোচনা করে বর্তমান নীতিমালা বতিলযোগ্য হলে বাতিল, কিংবা সংশোধন যোগ্য হলে সংশোধন করা হবে।”