চবিতে সংঘর্ষের মধ্যে দুই হলে লুটপাট

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ চলাকালে দুটি হলে নির্বিচারে লুটপাট ও ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 May 2015, 05:35 PM
Updated : 23 May 2015, 05:35 PM

শুক্রবার বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাওল হল ও এ এফ রহমান হলে সংঘর্ষের সময় লুটপাটের ঘটনা ঘটে। এ সময় শিক্ষকরা বাধা দিয়েও লুট ঠেকাতে পারেননি।

শনিবার হল দুটি ঘুরে দেখা গেছে প্রায় দেড় শতাধিক কক্ষে ভাংচুর করা হয়েছে।

ক্ষতিগ্রস্ত কয়েক শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের কয়েকজন লুটপাটের জন্য ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের দায়ী করলেও তা অস্বীকার করেছেন সংগঠনটির নেতারা।

লুটপাটকারীদের চিহ্নিত করতে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সিরাজ উদ দৌল্লাহ জানিয়েছেন।

“জড়িতদের শনাক্ত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে,” বলেন তিনি।

শুক্রবার বিকালে আলাওল হলের সামনের মাঠে ক্রিকেট খেলার সময় এক ছাত্রলীগ কর্মীকে ‘উত্যক্ত’ করা নিয়ে শিবির নেতাকর্মীদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়। উভয়পক্ষ পাল্টাপাল্টি ইটপাটকেল নিক্ষেপ, হাতবোমার বিস্ফোরণ ও ফাঁকা গুলিবর্ষণ করে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান।

সংঘর্ষের এক পর্যায়ে হল দুটি থেকে সরে যায় শিবির কর্মীরা, যারা আগে সেখানে ‘আধিপত্য’ নিয়ে ছিল।

দুপুরে হল দুটির আবাসিক শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সংঘর্ষের সময় শিক্ষার্থীদের অন্তত ৫০টি কম্পিউটার ও ল্যাপটপ, টেবিল ফ্যান, টাকাসহ মানিব্যাগ, শিক্ষা সনদ, বই-খাতা, পোশাক এবং বিভিন্ন মূল্যবান সামগ্রী লুট হয়।

সংঘর্ষের সময় এ এফ রহমান হলের প্রাধ্যক্ষের কক্ষসহ ১৫৩টি কক্ষ এবং আলাওল হলের ৩০টি কক্ষ ভাংচুর করা হয়।

এফ রহমান হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক এস এম মনিরুল ইসলাম বলেন, “সংঘর্ষের সময় মুখ ঢাকা ছেলেরা হাতে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হলে ঢুকে আমার কক্ষসহ ১৫৩টি কক্ষে ভাংচুর করে। তারা শিক্ষকদের নামফলকও ভাংচুর করে। কক্ষগুলোর জানালার কাঁচ, দরজা, পড়ার টেবিল, শিক্ষার্থীদের কম্পিউটার কিছুই ভাংচুর থেকে বাদ যায়নি।

“এ সময় হামলাকারীরা আবাসিক শিক্ষার্থীদের আট থেকে ১০টি ল্যাপটপ নিয়ে যায়। আমি নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কয়েকটি ছেলের হাত থেকে ১৪টি ল্যাপটপ উদ্ধার করি।”

আলাওল হলের প্রাধ্যক্ষ শেখ জহির আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সংঘর্ষের সময় আমাদের হলের ৩০টি কক্ষ ভাংচুর করা হয়। কমপক্ষে পাঁচটি ল্যাপটপসহ অনেক শিক্ষার্থীর ডেক্সটপ কম্পিউটার, টাকা, বই ইত্যাদি লুট হয়েছে।”

এফ রহমান হলের আবাসিক শিক্ষার্থী খালেদ মাহমুদ বলেন, সংঘর্ষের সময় তিনি বাইরে ছিলেন। পরে নিজের কক্ষে ফিরে ৩৭ হাজার টাকা দামের ল্যাপটপ, মানিব্যাগে থাকা ৫৫০ টাকা আর মূল্যবান কাগজপত্র পাননি।

একই হলের আরেক আবাসিক শিক্ষার্থী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “আমি দরিদ্র পরিবারের সন্তান। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বৃত্তির টাকায় আমার পড়ালেখার খরচ চলে।

“সংঘর্ষের সময় ছাত্রলীগকর্মীরা আমার রুমে থাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার সনদপত্র ও বৃত্তির কাগজপত্রের ব্যাগ নিয়ে যায়। এসময় আমাকে কয়েকজন মিলে মারধর করলে ছাত্রলীগের একজন ভাইয়া আমাকে রক্ষা করেন।”  

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আলাওল হলের এক শিক্ষার্থী বলেন, “কক্ষের তালা ভেঙে বুকসেলফের তালাও ভাঙ্গে ছাত্রলীগ কর্মীরা। পরে বুকসেলফে থাকা আড়াই হাজার টাকা নিয়ে যায়।

“দামী শার্ট-প্যান্ট এমনকি ছাত্রদের অন্তর্বাসও চুরি করে নিয়ে গেছে। এ ঘটনা নতুন নয়। গত কয়েক বছর ধরে হল দখলকেন্দ্রিক সংঘর্ষের সময় লুটপাটের ঘটনা ঘটছে।”

এর আগে গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের পর শাহজালাল হলেও ছাত্রলীগের এক পক্ষের কর্মীরা লুটপাট চালায় বলে অভিযোগ সাধারণ শিক্ষার্থীদের।

তবে ভাংচুর ও লুটপাটের সঙ্গে তাদের সংগঠনের কেউ জড়িত নয় বলে দাবি করেছেন ছাত্রলীগ নেতারা।

বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সুমন মামুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সংঘর্ষের সময় ভাংচুর ও লুটপাটের কথা শুনেছি। তবে আমি যতটুকু জানি এ ঘটনায় ছাত্রলীগের কেউ জড়িত নয়।

“যদি সংঘর্ষের সময় ছাত্রলীগের কোনো কর্মীর ভাংচুরে জড়িত থাকার প্রমাণ মেলে তবে দোষী ছাত্রলীগ কর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিকভাবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”    

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি অমিত কুমার বসু ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দিয়াজ ইরফান চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

শিক্ষক সমিতির নিন্দা :

সংঘর্ষের সময় ভাংচুরের ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি।

শনিবার সমিতির সভাপতি মো. আবুল মনছুর ও সাধারণ সম্পাদক কাজী খসরুল আলম কুদ্দুসি স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, “দুটি হলে সংঘর্ষের সময় কিছু উচ্ছৃঙ্খল শিক্ষার্থী ও বহিরাগতরা ভাংচুর চালায় এবং প্রভোস্টের সাথে অশোভন আচরণ করে।

“ভাংচুরে প্রভোস্ট অধ্যাপক এস এম মনিরুল হাসান ও আবাসিক শিক্ষকদের কক্ষের আসবাবপত্র ও নামফলক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাছাড়া এরা ছাত্রদের বেশ কিছু কক্ষেও ভাংচুর করে।

“চবি শিক্ষক সমিতি এই অশোভন ও শিষ্টাচার বহির্ভূত আচরণের তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ জানাচ্ছে। দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানায় শিক্ষক সমিতি।”

দুই তদন্ত কমিটি :  

শুক্রবারের সংঘর্ষ ও লুটপাটে জড়িতদের খুঁজে বের করতে দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে দুই হলের প্রশাসন।

সংঘর্ষের ঘটনা তদন্তে এ এফ রহমান হলের তদন্ত কমিটিতে হলের জ্যেষ্ঠ আবাসিক শিক্ষক আমিনুর রহমানকে আহ্বায়ক করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- সহকারী অধ্যাপক আলতাফ হোসেন ও প্রভাষক আসাদুজ্জামান রানা। সদস্য সচিব করা হয়েছে হলের সেকশন অফিসার মো. সরোয়ারকে।

আর আলাওল হলের জ্যেষ্ঠ আবাসিক শিক্ষক বখতেয়ার উদ্দিনকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- প্রভাষক কাজী নুর হোসেন ও প্রভাষক আসাদুল হক। সদস্য সচিব করা হয়েছে হলের সেকশন অফিসার মো. হাশেমকে।

উভয় কমিটিকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।