ঢাকার রাস্তায় গারো তরুণীকে গাড়িতে তুলে দলবেঁধে ধর্ষণ

রাজধানীতে এক গারো তরুণীকে জোর করে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে দেড় ঘণ্টা ধরে চলন্ত গাড়িতে ধর্ষণ করেছে পাঁচ যুবক।  

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 May 2015, 03:26 PM
Updated : 23 May 2015, 04:34 AM

বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় এ ঘটনার পর শুক্রবার ভাটারা থানায় মামলা করেছে ধর্ষণের শিকার মেয়েটির পরিবার।  

বর্ষবরণের উৎসবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নারীদের যৌন নিপীড়নের ঘটনায় কেউ গ্রেপ্তার না হওয়ায় বিভিন্ন সংগঠনের আন্দোলনের মধ্যেই ধর্ষণের এ ঘটনা ঘটল।     

সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বে অবহেলার কারণেই এ ধরনের অপরাধের মাত্রা দিন দিন  বাড়ছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নারী অধিকারকর্মীরা।  

ভাটারা থানার পরিদর্শক মো. সাজ্জাদ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, অভিভাবকরা ওই তরুণীকে থানায় নিয়ে এলে শুক্রবার দুপুরে তাদের মামলা নথিভুক্ত করা হয়। মামলায় পাঁচজনকে আসামি করা হলেও কারও নাম উল্লেখ করা হয়নি।

“তিনি ধর্ষকদের কাউকে চিনতে পেরেছেন কি না, তাও বলেননি। আমরা বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে দেখছি।”

রাত সাড়ে ১১টার দিকে মেয়েটিকে তেজগাঁওয়ে পুলিশের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে নেওয়া হয়েছে বলে ভাটারা থানার ওসি নুরুল মুত্তাকিম জানিয়েছেন।

স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য শনিবার সকালে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

২১ বছর বয়সী ওই তরুণী যমুনা ফিউচার পার্কের একটি পোশাকের দোকানে বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করেন। বড় বোনের সঙ্গে উত্তরায় থাকেন খালার বাসায়। তাদের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়িয়ায়।

এই খবরটি শুনে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক থানায় যান। তিনি অপরাধীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করতে পুলিশকে আহ্বান জানান।

আনিসুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভাটারা থানা পুলিশের সঙ্গে দেখা করে অপরাধীদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি জানানোর পাশাপাশি ভিকটিমকে প্রয়োজনীয় সহযোগীতা দেওয়ার অনুরোধ করেছি।”

আনিসুল হক ধর্ষিতের পরিবারের সঙ্গেও কথা বলেছেন বলে ভাটারা থানার ওসি নুরুল মুস্তাকীন জানান।

দেড় ঘণ্টার পাশবিকতা

মেয়েটির বড় বোন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বৃহস্পতিবার রাত সোয়া ৯টার দিকে কাজ শেষ করে বাসায় ফেরার জন্য যমুনা ফিউচার পার্কের উল্টো দিকে বাসের অপেক্ষা করছিলেন তার ছোট বোন।

“এ সময় হঠাৎ একটি মাইক্রোবাস এসে ওর সামনে থামে এবং দুই যুবক ওকে জোর করে গাড়িতে তোলে। ভেতরে আরও তিনজন ছিল। তারা পাঁচজন মিলে চলন্ত গাড়িতে ওকে ধর্ষণ করে রাত পৌনে ১১টার দিকে উত্তরার জসিমউদ্দীন রোডে নামিয়ে দিয়ে চলে যায়।”

বড় বোন জানান, মাইক্রোবাসটি চালানো হচ্ছিল ধীর গতিতে। কুড়িল বিশ্বরোড ও যমুনা ফিউচার পার্কের সামনের এলাকা দিয়েই গাড়িটি কয়েকবার ঘুরেছে।

“তখনও ওরা গাড়ির ভেতরে আমার বোনকে ধর্ষণ করছিল।”

তিনি জানান, গত সপ্তাহের শুরুতে এক লোক দুই বিদেশি নারীকে নিয়ে যমুনা ফিউচার পার্কের ওই দোকানে যান, যেখানে তার ছোট বোন কাজ করেন।

“আমার বোন কোথায় থাকে, কত বেতন পায়, পরিবারে কে কে আছে জানতে চেয়েছিল তারা। ও বলেছে, মাইক্রোবাসে পাঁচজনের মধ্যে সেই লোকও ছিল। দোকানের সিসিটিভির ফুটেজ দেখলে তাকে ও চিনতে পারবে বলে মনে হয়।”

বড় বোন জানান, তারা জাতিতে গারো; তবে খ্রিষ্ট ধর্ম পালন করেন। ঢাকায় কাজ করার পাশাপাশি তার বোন এ বছরের শুরুতে ময়মনসিংহের একটি কলেজে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলেন।

রাতে ধর্ষণের ঘটনার পর মামলা করার জন্য তাদের তিন থানায় ঘুরে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়ে বলেও জানান তিনি। 

তুরাগ থানা কাছে হয় বলে মামলা করার জন্য রাত ৪টার দিকে মেয়েটিকে নিয়ে তারা সেখানে যান। কিন্তু অন্য এলাকার ঘটনা বলে পুলিশ তাদের ফিরিয়ে দেয়।

এরপর ভোর ৫টার দিকে তারা যান গুলশান থানায়। সেখানেও একই উত্তর মেলে।

শেষে সাড়ে ৬টার দিকে ভাটারা থানায় গেলে বলা হয়, ওসি নেই, অপেক্ষা করতে হবে।

এরপর সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ওসি আসেন এবং তাদের কথা শুনে সাড়ে ১২টার দিকে মামলা নথিভুক্ত করা হয় বলে মেয়েটির বড় বোন জানান।

‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি’

যৌন নিপীড়নের ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা সমালোচিত হওয়ার পর দেড় মাস না পেরোতেই ধর্ষণের এই ঘটনায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কী পদক্ষেপ নিচ্ছে তা জানতে গুলশান বিভাগের উপ কমিশনার লুৎফুল কবীরকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। 

মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) মীর রেজাউল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সন্দেহের ভিত্তিতে আমরা তো কিছু বলতে পারব না। মামলা হয়েছে, এখন তদন্ত হবে। সে অনুযায়ী আমরা কাজ করব।”

অন্যদিকে নারী অধিকারকর্মীরা বলছেন, সংশ্লিষ্টদের গাফিলতি এবং ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি’ প্রকারান্তরে এ ধরনের অপধারীদের উৎসাহ যোগাচ্ছে।

মানবাধিকারকর্মী খুশী কবির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতার কোনো ঘটনা ঘটলে কিছুদিন হইচই হয়, আলোচনা হয়, তারপর অন্য ঘটনার পেছনে তা চাপা পড়ে যায়। এই ধারা চলতে থাকায় অপরাধের মাত্রাও বাড়ছে।

“ধর্ষণের এই ঘটনাটি খুব সিরিয়াস। পুলিশকে আরও ভূমিকা নিতে হবে এবং অপরাধীদের যত দ্রুত সম্ভব গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে।”

গত ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখের সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ফটকে ভিড়ের মধ্যে এক দল যুবক নারীদের ওপর চড়াও হয়। সে সময় চার নিপীড়ককে ধরে পুলিশের কাছে দেওয়া হলেও পরে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়, যা পুলিশও স্বীকার করেছে।

ওই ঘটনায় পুলিশ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। এক মাসেও কাউকে গ্রেপ্তার করতে না পেরে পুলিশ কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি সিসিটিভির ফুটেজ থেকে আট সন্দেহভাজন নিপীড়কের ছবি প্রকাশ করে তাদের ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করেছে।  

এরই মধ্যে মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুলে এক শিক্ষার্থীকে ‘যৌন হয়রানি’র অভিযোগ ওঠে।এর তদন্ত নিয়ে টালবাহানার অভিযোগে অভিভাবকরা বিক্ষোভ শুরু করলে গত ১৬ মে উপাধ্যক্ষকে অব্যাহতি দেয় কর্তৃপক্ষ।

যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের এসব ঘটনার পর নারী নির্যাতন প্রতিরোধে ‘প্রীতিলতা ব্রিগেড’ গঠন করেছে ছাত্র ইউনিয়ন, যার নেতৃত্বে রয়েছেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক লাকী আক্তার।

চলন্ত গাড়িতে ধর্ষণের ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “প্রতিদিন নিপীড়নের ঘটনা ঘটছে এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে তা বেড়ে চলেছে। প্রশাসন যেরকম গা ছাড়া ভাব দেখাচ্ছে, তা থেকে সরে এসে নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন না হলে জনগণ ন্যায়বিচারের দায়িত্ব নিজেদের হাতে তুলে নেবে।”