সিটি করপোরেশনের অগোচরে উত্তরায় যত্রতত্র মাদ্রাসা

আবাসিক প্লটে বাণিজ্যিক বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উপর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও রাজধানীর উত্তরায় যত্রতত্র গড়ে উঠেছে কওমি মাদ্রাসা, অথচ বিষয়টি নিয়ে দৃশ্যত অন্ধকারে দেখভালের দায়িত্বে থাকা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন।

আশিক হোসেনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 May 2015, 02:31 PM
Updated : 22 May 2015, 03:13 PM

আবাসিক এলাকা উত্তরার ১৪ নম্বর সেক্টরে ঢুকতেই চোখে পড়ে মাদ্রাসা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ব্যানার ও দেওয়াল লিখন।

ওই সেক্টরের প্রায় প্রতিটি সড়কে রয়েছে অন্তত একটি করে মাদ্রাসা বা ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কোন কোন সড়কে মাদ্রাসার সংখ্যা একাধিক।

আবাসিক ভবন ভাড়া নিয়ে চলছে এসব মাদ্রাসার কার্যক্রম, যদিও সিটি করপোরেশনের নিয়ম অনুযায়ী আবাসিক প্লটে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান চালানোর সুযোগ নেই।

উত্তরা এলাকায় কতো সংখ্যক মাদ্রাসা বা ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে তার কোনো পরিসংখ্যান দিতে পারেনি এলাকাটি রক্ষণাবেক্ষনের দায়িত্বে থাকা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ।

তবে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের অনুসন্ধানে শুধু ১৪ নম্বর সেক্টরের এক বর্গ কিলোমিটার এলাকাতেই পাওয়া গেছে অন্তত ৪০টি মাদ্রাসা।

এর মধ্যে অনেক ভবন বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই ভিতরে মাদ্রাসার কার্যক্রম চলছে, অথচ ভিতরে প্রায় সবগুলোই কওমি মাদ্রাসা।

স্থানীয়রা জানান, উত্তরার অন্য সেক্টরগুলোর তুলনায় ১৪ নম্বর সেক্টর একটু ভেতরের দিকে হওয়ায় গত কয়েক বছর ধরেই এ এলাকায় ‘ব্যাঙের ছাতার’ মতো করে গজিয়ে উঠছে এসব মাদ্রাসা। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে ভেবে কেউ এ বিষয়ে মুখ খুলতে চান না।

এই সেক্টরের ১৩ নম্বর সড়কের ২৪ নম্বর বাসায় গড়ে উঠেছে ‘মাদ্রাসাতুল ইহসান আল আরাবিয়া’। ২০০৫ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হলেও ৪-৫ বছর আগে উত্তরার এই ভাড়া বাড়িতে তাদের কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে প্রায় দুইশ শিক্ষার্থী রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির, যাদের সবাই আবাসিক শিক্ষার্থী।

আবাসিক ভবনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালানোর আগে সিটি করপোরেশনের অনুমতি নেওয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির সহকারী পরিচালক মো. শামসুজ্জামান বলেন, “না, তবে আমরা কওমি মাদ্রাসা বোর্ড থেকে অনুমোদন নিয়েছি।

“আশুলিয়াতে আমাদের একটি জায়গা আছে। সেখানেই মাদ্রাসাটি শিফট করা হবে। তার আগে এখানে সাময়িকভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।”

মাদ্রাসার শিক্ষার্থী কারা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “যারা দ্বীন-ই শিক্ষায় শিক্ষিত হতে চায় তারাই মাদ্রাসায় পড়তে আসে। এখানে মূলত আখিরাতমুখী শিক্ষা দেওয়া হয়।”

মাদ্রাসা পরিচালনার ব্যয় শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের কাছ থেকে আসে বলে জানান তিনি।

একই সড়কে কিছু দূর এগোলে চোখে পড়ে আরেকটি ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘আল-কুরআন এডুকেশন সেন্টার’।

প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক সাইফুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখানে শিশু ও বয়স্কদের কুরআন শেখানো হয়। এটি একটি পার্ট-টাইম প্রতিষ্ঠান।”

উত্তরার অন্য কয়েকটি সেক্টরে শিগগিরই শাখা খোলার পরিকল্পনার কথা জানান তিনি।

একই সেক্টরের ১৬ নম্বর সড়কের ৬৫ নম্বর বাড়িতে গড়ে উঠেছে আরেকটি মাদ্রাসা ‘মাদ্রাসা ই বাবুন নাঈম’। ২০০৯ সাল থেকে এ ভাড়া বাসায় তাদের কার্যক্রম চলছে।

প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার দায়িত্বে থাকা আব্দুল কাদের বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সরকারি অনুমতি না থাকলেও কওমী মাদ্রাসা বোর্ডের অনুমোদন তাদের রয়েছে। ”

বর্তমানে দেশে দুই ধরনের মাদ্রাসা রয়েছে-আলিয়া মাদ্রাসা ও কওমি মাদ্রাসা।  আলিয়া মাদ্রাসার সরকারি অনুমোদন রয়েছে এবং সরকার থেকে এগুলোর সনদ দেওয়া হয়।

অপরদিকে কওমি মাদ্রাসার সরকারি অনুমোদন থাকে না, কওমি মাদ্রাসা বোর্ড এ সব মাদ্রাসার অনুমোদন দিয়ে থাকে। কওমি মাদ্রাসা বোর্ডও কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান নয়।

উত্তরার ‘মাদ্রাসা ই বাবুন নাঈম’র পরিচালক আব্দুল কাদের জানান, তাদের প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে মোট ৩৬ জন শিক্ষার্থী আছে। পরিচিত কিছু ব্যক্তির সহায়তা থেকে তাদের ব্যয়ের বড় অংশ আসে।

মাদ্রাসাটির অধিকাংশ শিক্ষার্থী দরিদ্র পরিবার থেকে আসা বলেও জানান তিনি।

“এখানে মূলত নূরানী মক্তব ও হাফেজি পড়ানো হয়।”

এছাড়াও ১৫ নম্বর সড়কে কওমি মাদ্রাসা বোর্ডের অনুমোদন নিয়ে ‘তানজিমুল উম্মাহ হিফয্ মাদ্রাসা’ ও ‘মাদ্রাসাতুল কুরআন ওয়ানসুন্নাহ’ নামে আরো দুটি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।

আবাসিক এলাকায় সরকারি অনুমোদন ছাড়া এসব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান কীভাবে গড়ে উঠল জানতে চাইলে কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ বি এনামুল হক বলেন, সিটি করপোরেশনের অগোচরেই এ ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে।

“শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দেয় শিক্ষা বোর্ড বা মাদ্রাসা বোর্ড, অনুমোদন নিয়ে তারা আমাদের কাছে আসে লাইসেন্সের জন্য । আমি বলতে পারি, ওই এলাকায় এ ধরনের কোনো প্রতিষ্ঠান করার বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো আবেদন আসেনি।

“রেসিডেন্সিয়াল প্লটে কোনো বাণিজ্যিক বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকার কথা না, আমরা এর অনুমতিও দিই না। কিন্তু দেখা যায় কমার্সিয়াল এলাকার অনুমোদন নিয়ে অনেকেই আবাসিক এলাকায় এ ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে।”

রাজউকের সঙ্গে আলোচনা করে এসব প্রতিষ্ঠান উচ্ছেদে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সারা দেশে ১৩ হাজার ৯০২টি কওমি মাদ্রাসায় প্রায় ১৪ লাখ শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছে।

বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা বোর্ডের (বেফাক) অধীনে আট হাজারের বেশি কওমি মাদ্রাসা  পরিচালিত হচ্ছে বলে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।