এ পরিস্থিতিতে পাচারকারীরা নৌকা তীরে না ভেড়ানোর কৌশল নেওয়ায় আরও অন্তত আট হাজার বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা থাই উপকূলের কাছে সাগরে আটকা পড়ে আছেন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা-আইওএম।
মিয়ানমারে নির্যাতন ও বঞ্চনার শিকার রোহিঙ্গারা গত কয়েক বছর ধরে বাঁচার আশায় সাগর পাড়ি দিয়ে আশেপাশের দেশ, বিশেষ করে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার চেষ্টায় আছেন। আর বাংলাদেশ থেকেও নৌকা বা মাছ ধরার ট্রলারে করে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার চেষ্টার ঘটনা ঘটছে নিয়মিত। মানবপাচারকারীরা এ সুযোগটি কাজে লাগাচ্ছে।
সম্প্রতি দক্ষিণ থাইল্যান্ডের জঙ্গলে পাচারকারীদের পরিত্যক্ত এক ক্যাম্পে অভিবাসীদের গণকবরের সন্ধান পাওয়ার পর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়। এরইমধ্যে শুক্র ও শনিবার থাইল্যান্ডের পার্বত্য এলাকায় জীবিত অবস্থায় শতাধিক অভিবাসীর সন্ধান পাওয়া যায়। সংখলা প্রদেশ ও পাদাং বেসারের জঙ্গলে পাচারকারীদের আস্তানার খোঁজে শুরু হয় অভিযান।
“দেখে মনে হচ্ছে পাচারকারীরা আপাতত লোক নিয়ে আসছে না। কিন্তু সাগরে এখনো বহু নৌকা রয়েছে। অনেক নৌকা লোক নামানোর অপেক্ষায়। পাচারকারীদের সঙ্গে অভিবাসীদের টাকা পয়সার চূড়ান্ত লেনদেন হয় গন্তব্যে পৌঁছানোর পর। এখন পরিস্থিতি উত্তপ্ত, ফলে তাদের নামার জায়গা নেই।”
আরাকান প্রজেক্টের বরাত দিয়ে বিবিসির খবরে বলা হয়, আনুমানিক ৮ হাজার মানুষ নিয়ে পাচারকারীদের বহু নৌকা এখন সাগরে আটকা পড়ে আছে। ওই সংখ্যার কোনো প্রামাণিক ভিত্তি না থাকলেও আইওএম তা ‘বিশ্বাসযোগ্য’ বলেই মনে করছে।
রোববার ইন্দোনেশিয়ার উত্তর উপকূলে আচেহ প্রদেশের কাছে এরকম দুটি এবং সোমবার সকালের দিকে একটি কাঠের নৌকা থেকে স্থানীয় জেলেরা অন্তত এক হাজার অভিবাসীকে উদ্ধার করেছেন, যারা প্রায় সবাই বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা বলে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের তথ্য।
তবে তাদের মধ্যে ঠিক কতজন বাংলাদেশি সে বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে পারেননি ইন্দোনেশিয়ার স্থানীয় কর্মকর্তারা।
আচেহ সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ এজেন্সির মুখপাত্র মোহাম্মদ আরিফ মুতাকিন রয়টার্সকে বলেন, “এ পর্যন্ত যে তথ্য আমরা পেয়েছি, তাতে উদ্ধারকৃতদের অধিকাংশ এসেছে মিয়ানমার থেকে, তারা রোহিঙ্গা মুসলমান।”
তবে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) বলছে, তাদের মধ্যে বাংলাদেশি নাগরিকও আছেন, যারা আনুমানিক এক সপ্তাহ আগে থাইল্যান্ড ছেড়ে আসেন। ইন্দোনেশিয়া উপকূলে আসার পথে নৌকার মধ্যেই অনেকের মৃত্যু হয়।
আইওএম কর্মকর্তা স্টিভ হ্যামিল্টন বিবিসিকে জানান, উদ্ধারকৃতরা মালয়েশিয়ায় যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন বলে তারা জানতে পেরেছেন।
“ধারণা করা হচ্ছে মোট চারটি নৌকা উপকূলের কাছাকাছি পৌঁছানোর পর পাচারকারীরা সটকে পড়ে। উদ্ধারকৃতরা ভেবেছিল তারা মালয়েশিয়া পৌঁছে গেছে। কিন্তু উদ্ধারের পর তারা জানতে পারে, তারা এসেছে ইন্দোনেশিয়ায়।”
রশিদ আহমেদ নামে ৪৩ বছর বয়সী এক রোহিঙ্গা বলেন, “ছেলেকে নিয়ে এক মাস আগে দেশ ছেড়েছি। শেষ দিকে আমাদের খাওয়ার কিছু ছিল না।”
এদিকে রোববার মধ্যরাতের পর থাইল্যান্ড সীমান্তঘেঁষা মালয়েশিয়ার লাংকাউই উপকূল থেকে ১ হাজার ১৮ অভিবাসীকে আটক করা হয়, যাদের মধ্যে ৫৫৫ জন বাংলাদেশি ও ৪৬৩ জন রোহিঙ্গা বলে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
লাংকাউই পুলিশ বিভাগের প্রধান হারিথ কাম আব্দুল্লাহ রয়টার্সকে বলেন, আনুমানিক তিনটি নৌকায় করে এই অভিবাসীদের অগভীর সাগরে নামিয়ে দিয়ে পাচারকারীরা পালিয়ে যায়। একটি নৌকা পরে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়।
আটক অভিবাসীদের মধ্যে ৯৯ জন নারী ও ৫৪ শিশু রয়েছে। তাদের ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হবে বলে এই পুলিশ কর্মকর্তা জানান।
তিনি বলেন, পাচারকারীরা এই অভিবাসীদের নিয়ে প্রথমে থাইল্যান্ডে যায়, তারপর লাংকাউই হয়ে মালয়েশিয়ায় ঢোকে।
গত শুক্রবার জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে প্রায় ২৫ হাজারের মতো বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা মানব পাচারের শিকার হয়েছেন। এ সংখ্যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় দ্বিগুণ।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঝুঁকিপূর্ণ এসব যাত্রায় এ বছরের প্রথম তিন মাসে ৩০০ ব্যক্তি মারা গেছেন। ২০১৪ সালের অক্টোবর থেকে মারা গেছেন মোট ৬২০ জন। এদের অধিকাংশেরই মৃত্যু হয়েছে ক্ষুধা-তৃষ্ণা আর নির্যাতনে। অনেকে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার কথাও বলেছেন।
থাইল্যান্ডের সংখলা প্রদেশে গণকবরে পাওয়া মৃতদেহগুলো বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের অভিবাসীদের বলেও ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।