যৌন নিপীড়কদের শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভে পুলিশের লাঠিপেটা

বর্ষবরণ উৎসবে যৌন নিপীড়নে জড়িতদের গ্রেপ্তার ও শাস্তি দাবিতে ছাত্র ইউনিয়নের ডিএমপি কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচি লাঠিপেটা ও জলকামান ছুড়ে পণ্ড করে দিয়েছে পুলিশ।

নিজস্ব প্রতিবেদকও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 May 2015, 05:47 PM
Updated : 10 May 2015, 05:47 PM

পুলিশি হামলার প্রতিবাদে মঙ্গলবার বাংলাদেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট ডেকেছে বামপন্থি ছাত্র সংগঠনটি। হামলার নিন্দা জানিয়েছে সিপিবিসহ বিভিন্ন বাম রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠন।

বর্ষবরণের যৌন হয়রানি ঠেকাতে পুলিশের ভূমিকার সমালোচনামুখর ছাত্র ইউনিয়ন নেতাদের দাবি, তাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বিনা উসকানিতে হামলা হয়। এতে তাদের ৩৪ নেতা-কর্মী আহত হন। পাঁচজনকে পুলিশ আটক করেছে।

অন্যদিকে পুলিশ কর্মকর্তাদের দাবি, বিক্ষোভকারীরা সড়ক আটকে রেখেছিল এবং তাদের সরতে বলা হলেও তারা সরেনি। তখন পুলিশ তাদের হটাতে ব্যবস্থা নেয়।

কাজে বাধা এবং পুলিশকে মারধরের অভিযোগে পাঁচজনকে আটক করা হয়েছে বলে দাবি করেন রমনা থানার এসআই মিজানুর রহমান।

গত ১৪ এপ্রিল (পহেলা বৈশাখ) বর্ষবরণের অনুষ্ঠানের মধ্যে নারীদের যৌন হয়রানির ঘটনায় পুলিশ এখনও কাউকে চিহ্নিত করতে না পারার মধ্যে রোববার ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের কার্যালয় ঘেরাওয়ে যায় ছাত্র ইউনিয়ন।

‘পাল্টা আঘাত’ কর্মসূচি হিসেবে সংগঠনটির সভাপতি হাসান তারেক ও সাধারণ সম্পাদক লাকী আক্তারের নেতৃত্বে শতাধিক নেতা-কর্মীর ওই মিছিল কয়েক দফা বাধার পর দুপুর পৌনে ১টার দিকে মিন্টো রোডে ডিএমপি কার্যালয়ের কাছাকাছি পৌঁছায়।

সেখানে পুলিশ বাধা দিলে উভয়পক্ষের ধস্তাধস্তি হয়। এক পর্যায়ে আন্দোলনকারীদের ওপর লাঠি নিয়ে চড়াও হয় পুলিশ, সেই সঙ্গে চলে জলকামান থেকে পানি ছোড়া।

কয়েকজনকে নিচে ফেলে লাঠিপেটার পাশাপাশি বুট দিয়ে আঘাত করতে দেখা যায় পুলিশকে। একই সময় কয়েকজন নারীকর্মীকে ধাওয়া করে ফেলে পেটাতেও দেখা যায়।

পুলিশি আক্রমণে ইসমত জাহান

পুলিশি আক্রমণে ইসমত জাহান

ইসমত জাহান জো নামে এক নারীকর্মীকে চুল ধরে ফেলে দিয়ে পেটাতেও দেখা যায় একজন পুলিশ সদস্যকে।

পুলিশের বেদম পিটুনিতে ছাত্র ইউনিয়নের কয়েকজন নেতা-কর্মী আহত হন। পুলিশ কয়েকজনকে আটক করে নিয়ে যায়। অন্যদের ধাওয়া করে এবং পিটিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ।

প্রায় ১৫ মিনিট ধরে এই অবস্থা চলার সময় মনসুর আলী সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরিস্থিতি শান্ত হলে পুনরায় যান চলাচল শুরু হয়।

ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি হাসান তারেক বলেন, “ক্যাম্পাস থেকে আমরা মিছিল নিয়ে যাচ্ছিলাম। পুলিশ দোয়েল চত্বর ও হাই কোর্টের উল্টো পাশে দুই দফা বাধা দেয়। এরপর সার্কিট হাউস অফিসার্স ক্লাবের উল্টো পাশে বিনা উসকানিতে আমাদের লাঠিপেটা শুরু করে।”

হামলায় হাসান তারেক নিজেও আহত হয়েছেন। তিনি দাবি করেছেন, হামলায় অন্তত ৩৪ নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছেন সংগঠনটির সাংগঠনিক সম্পাদক জিএম জিলানী শুভ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি লিটন নন্দী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি তন্ময় ধর, ঢাকা মহানগরের সাধারণ সম্পাদক সুমন সেন গুপ্ত।

আহত ইসমাতকে নেওয়া হচ্ছে হাসপাতালে

আহত আরেকজনকে নিয়ে যাচ্ছে সঙ্গীরা

এদের মধ্যে ১৫ জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বলে ঢাকা মেডিকেলের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।

বর্ষবরণের দিন যৌন নিপীড়কদের ঠেকাতে গিয়ে আহত হয়েছিলেন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা লিটন। সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তারা দায়িত্বহীন আচরণ করেছিলেন বলে তার দাবি।

বিক্ষোভ থেকে সংগঠনের পাঁচজনকে পুলিশ আটক করে বলে জানিয়েছেন ছাত্র ইউনিয়ন নেতারা। তারা হলেন- জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক দীপাঞ্জন সিদ্ধান্ত কাজল ও কর্মী আরিফুল ইসলাম অনিক, ঢাকা মহানগর শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক অনিক রায়, অন্তু চন্দ্র নাথ ও সাদ্দাম হোসেন জয়।

রমনা থানার উপ-পরিদর্শক মিজানুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, পুলিশের কাজে বাধা ও পুলিশকে মারধরের অভিযোগে ওই পাঁচজনকে আটক করা হয়েছে।

তবে রাত ৮টা পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি। এসআই মিজান বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ডিএমপির রমনা জোনের উপকমিশনার আব্দুল বাতেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শিক্ষার্থীরা অবরোধ করে যানজট সৃষ্টি করেছিল। পুলিশ তাদের সরে যেতে বলে এবং দাবি-দাওয়া থাকলে তাদের কয়েকজন প্রতিনিধি পাঠাতে অনুরোধ করে। কিন্তু তারা না সরায় পুলিশ টিয়ার শেল ও ওয়াটার ক্যানন ব্যবহার করে তাদের সরিয়ে দেয়।”

বর্ষবরণ উৎসবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীদের যৌন নিপীড়নে জড়িতদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবিতে ছাত্র ইউনিয়নের ‘ডিএমপি’ কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচিতে পুলিশের জলকামান ব্যবহার।

বর্ষবরণ উৎসবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীদের যৌন নিপীড়নে জড়িতদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবিতে ‘ডিএমপি’ কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচিতে বাধা পেয়ে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট ছুড়ছে ছাত্র ইউনিয়নকর্মীরা।

পুলিশ কোনো হামলা চালায়নি বলে দাবি করেন তিনি।

উল্টো মিছিলকারীদের ঢিলে ছয়জন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন বলে দাবি করেন রমনা থানার ওসি মসিউর রহমান। তারা হলেন- এসআই কামরুল, নায়েক জাহিদ, শাহীন, কাজী আরিফ, আলী হোসেন, আরাফাত।

‘পুলিশ নিপীড়কদের পক্ষে’

পুলিশ বিক্ষোভে হামলা চালিয়ে যৌন নিপীড়কদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে বলে দাবি করেছেন ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হাসান তারেক।

হামলার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের নির্দেশে পুলিশ বর্বরোচিত হামলা করেছে।

“এই হামলার মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এবং পুলিশ প্রশাসনের নিপীড়কদের পক্ষ নেওয়ার বিষয়টি আরও পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে।”

কর্মসূচিতে পুলিশের লাঠিপেটা ও গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে মঙ্গলবার সারা দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয় সংবাদ সম্মেলনে।

সোমবার বিকাল ৪টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে সমাবেশসহ দেশব্যাপী বিক্ষোভ কর্মসূচিও ঘোষণা করেন ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি।

মিছিল নিয়ে ঘেরাওয়ে যাচ্ছে ছাত্র ইউনিয়ন

মিছিলে স্লোগানে লাকী আক্তার

পুলিশের আচরণের নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)।

বামপন্থি দল দুটি এক বিবৃতিতে বলেছে, যৌন নিপীড়কদের না ধরে উল্টো ওই ঘটনার প্রতিবাদকারীদের উপর হামলা চালিয়ে পুলিশ নিপীড়কদের পক্ষ নিয়েছে।

“এ ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে- নিপীড়করা নয়, নির্যাতনের প্রতিবাদকারীরাই এখন সরকারের টার্গেট।”

ছাত্র ইউনিয়নের মিছিলে হামলাকারী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিও জানিয়েছে সিপিবি-বাসদ।

বর্তমানে ‘সরকার কোনো প্রতিবাদই আর সহ্য করতে পারছে না’ মন্তব্য করে সিপিবি-বাসদের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “গণদাবিকে অগ্রাহ্য করে, নির্যাতনের পথে গিয়ে কোনো সরকারই বেশিদিন ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারে না।”

ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীদের উপর হামলার নিন্দা জানিয়ে দোষী পুলিশ সদস্যদের শাস্তি দাবি করেছে ক্ষমতাসীন মহাজোটের শরিক দল ওয়ার্কার্স পার্টির সহযোগী সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রীও।

তাদের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “অন্যায়ভাবে পুলিশি হামলা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। যারা নারীদের সম্মান হরণে জড়িত ছিল তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করে বরং প্রতিবাদকারীদের উপর পুলিশের এই হামলা ন্যক্কারজনক।”