সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভূমিকম্প পরবর্তী উদ্ধার কাজের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা, তথ্য-উপাত্ত ও নীতিমালা থাকলেও মাঠপর্যায়ে এগুলোর প্রয়োগ ও চর্চা অনুপস্থিত।
গত ২৫ এপ্রিল ৭ দশমিক ৮ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প নেপালকে লণ্ডভণ্ড করে দেয়। এতে নিহতের সংখ্যা ৮ হাজার ছাড়িয়েছে।
ওই ভূমিকম্প বাংলাদেশকেও নাড়িয়ে দিয়ে যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরনের ভূমিকম্পে ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা হবে অনেক বেশি।
নেপালে ভূমিকম্পের পর বাংলাদেশেও এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াবহতা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বলছেন, ভূমিকম্প সামাল দেওয়ার মতো প্রস্তুতি সরকারের আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ভূমিকম্পসহনীয় ভবন নির্মাণেরও ওপর জোর দিয়েছেন।
তবে বিশেষজ্ঞ এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গেছে ভিন্ন চিত্র।
বুয়েটের নগর গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভূমিকম্পের বিষয়ে সক্ষমতা একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। বড় ভূমিকম্প হলে তা মোকাবেলা করা সম্ভব নয়।
“প্রশাসনিকভাবে অনেক নিয়ম কানুন, নীতিমালা কাগজে থাকলেও বাস্তবে ভূমিকম্প পূর্ব ও দুর্যোগ পরবর্তী ব্যবস্থাপনা একদম নিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। এটাকে কোনো পর্যায়ই বলা যায় না।”
বেশি ঝুঁকিতে রাজধানী
বাংলাদেশে ভূমিকম্প প্রস্তুতি ও তথ্য উপাত্ত নিয়ে জাতিসংঘের উন্নয়ন প্রকল্প- ইউএনডিপি অনেকদিন ধরে সরকার ও বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে কাজ করে আসছে।
২০০৪ সালে তারা ‘কম্প্রিহেনসিভ ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম-সিডিএমপি’ বা সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি শুরু করে। দুটি পর্যায়ে এই পরিকল্পনায় ভূমিকম্পজনিত দুর্যোগ মোকাবেলায় করণীয় এবং এর সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ইতোমধ্যে তৈরি ও সংরক্ষণ করা হয়েছে।
২০০৯ সালে প্রকাশিত সিডিএমপির এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকা সিটি করপোরেশনের আয়তন ছিল প্রায় ১২০ বর্গকিলোমিটার। তখন এই মহানগরীর জনসংখ্যা ছিল ৭২ লাখেরও বেশি। অর্থাৎ প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনসংখ্যার ঘনত্ব ছিল প্রায় ৬১ হাজার জন।
ওই সময়ে রাজধানীতে বিভিন্ন ধরনের ভবনের সংখ্যা ছিল প্রায় সোয়া তিন লাখ। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি ভবনের বয়স ৩০ বছর কিংবা তারও বেশি। মোট ভবনের প্রায় ৪০ শতাংশই ঝুঁকিপূর্ণ। ‘মধ্যম’ মানের ভবন ৩৫ শতাংশের মতো।
পরিসংখ্যানের এই চিত্র থেকেই অনুমান করা যায়, বড় মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকায় কী বিপুল প্রাণহানি হতে পারে।
এমন পরিস্থিতিতে ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত রাজধানীর পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মতো অবস্থাও নেই দুর্ঘটনা ও দুর্যোগ মোকাবেলায় নিয়োজিত বাংলাদেশের একমাত্র সরকারি সংস্থা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের।
এমনকি ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় মাত্র ফায়ার সার্ভিসের যে ১৩টি স্টেশন রয়েছে, তার ১১টি স্টেশন ভবনের অবস্থাই নাজুক। বড় মাত্রার ভূমিকম্পে এসব ভবনই ধসে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া নেই পর্যাপ্ত কর্মী, গাড়ি ও অন্যান্য উদ্ধার সরঞ্জাম।
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ খানও প্রস্তুতি আরও বাড়ানোর কথা বলেছেন।
তিনি বলেন, “১৩টি স্টেশনে চারশর মতো দমকলকর্মী রয়েছে। ঢাকায় দুর্যোগ মোকাবেলায় কমপক্ষে আরও ১০টি স্টেশন জরুরি হয়ে পড়েছে।”
নেই সমন্বয়, নীতিমালা কার্যকরেও দুর্বলতা
গুরুত্বপূর্ণ এসব তথ্য-উপাত্ত ও করণীয় নিয়ে নীতিমালা থাকলেও সেসব কার্যকর করার ক্ষেত্রে দুর্বলতা রয়েছে বলে মনে করেন ইউএনডিপির জ্যেষ্ঠ পরামর্শক এম আমিনুল ইসলাম।
তিনি বলেন, “দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের চেয়ে এখানে বেশি কাজ হয়েছে। তবে এগুলোর সঠিক প্রচার ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে এখনও তেমন অগ্রগতি নেই।
“ইনফরমেশন ডাটাবেইজ সরকারি পর্যায়ে থাকলেও তৃণমূল পর্যায়ে এসব তথ্য পৌঁছে দেওয়ায় ঘাটতি আছে। ভূমিকম্প হলে কী করতে হবে সে তথ্যও অনেক মানুষের কাছে নেই। নির্দেশনা তৈরি আছে কিন্তু প্রচারণা নেই। মিডিয়াতেও বড় দুর্ঘটনার পর কিছু প্রচার চলে, কিন্তু সেগুলোও গড়পরতা ও দায়সারা।”
সিডিএমপি প্রকল্পে বুয়েট বিশেষজ্ঞদের নির্দেশিত বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে একটি হলো বিদ্যমান ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোকে রেট্রোফিটিং পদ্ধতিতে ভূমিকম্প সহনীয় করে তোলা। এতে খুব বেশি খরচও হয় না। কিন্তু এ ব্যাপারে অধিকাংশ ভবনমালিকই কিছু জানেন না।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর তাজমহল রোডে ২০ বছরের পুরোনো একটি চারতলা ভবনের মালিক আব্দুল লতিফ ভূমিকম্প নিয়ে আতঙ্কের কথা জানান।
রেট্রোফিটিং পদ্ধতির ব্যাপারে অজ্ঞতার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “বাপের বানানো এই বিল্ডিং ভাঙাও সম্ভব না। এমন কোনও সিস্টেম থাকলে তো খুবই ভালো হয়, আমি অবশ্যই ব্যবহার করতে চাই।”
ভূমিকম্প বিষয়ে অনেক সাধারণ তথ্যই সাধারণ মানুষের অজানা। ভূমিকম্প হলে কী করতে হবে এবং কী করা যাবে না- এসব নিয়ে মানুষের মধ্যে পর্যাপ্ত ধারণা নেই বলেই অনেকের সঙ্গে কথা বলে দেখা যায়।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের গুরুত্ব অনুভব করেন ইউএনডিপির জ্যেষ্ঠ পরামর্শক ও ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ খান বলেন, “ভূমিকম্পের মতো বড় ধরনের দুর্যোগ মোকাবেলায় একাধিক সংস্থার অংশগ্রহণ থাকে। কিন্তু এক্ষেত্রে সংস্থাগুলোর মধ্যে প্রয়োজনীয় সমন্বয়ের জন্য মূল কোনো দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা বা ব্যক্তি নেই।
“দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার বিশাল কার্যক্রম একই ছাতার নিচে আনতে না পারলে সুষ্ঠুভাবে উদ্ধার কাজ চালানো সম্ভব হবে না। এক্ষেত্রে একদম কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে উদ্ধারকাজ পরিচালনায় মাঠ পর্যায়ে সমন্বয়কারীর নেতৃত্ব ও দায়িত্ব নির্দিষ্ট করে দিতে হবে।”
তবে গত সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাউন্সিলের বৈঠকে ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় ‘ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার’ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এই সেন্টার থেকে দুর্যোগকালীন ও দুর্যোগোত্তর পরিস্থিতিতে অনুসন্ধান ও উদ্ধার কাজ পরিচালনা, সমন্বয়, নির্দেশনা এবং পর্যবেক্ষণ করা হবে।
ঢাকায় ভূমিকম্প পরবর্তী ক্ষয়ক্ষতির রূপ ভয়াবহ আকার নিতে পারে উল্লেখ করে এম আমিনুল ইসলাম বলেন, “ঢাকার পপুলেশন ডেনসিটি বিশ্বে সবচেয়ে বেশি। নেপালের চেয়ে অন্তত ১০ গুণ বেশি। ফলে এখানে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কাও বেশি।
“জলাভূমি ভরাট করে ঢাকায় অনেক আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেছে। ভূমিকম্পের সময় এগুলো ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। এছাড়া ঢাকাসহ দেশের অনেক জায়গাতেই জাতীয় ইমারত নির্মাণ নীতিমালা মেনে চলা হচ্ছে না। এ বিষয়ে তদারকিরও ব্যাপক অভাব রয়েছে।”
ভূমিকম্প পরবর্তী উদ্ধার কাজের জন্য ফায়ার সার্ভিসের কাছে নানা নির্দেশনা ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম থাকলেও এসব ব্যবহারের জন্য এখন পর্যন্ত বিশেষায়িত মহড়া অনুষ্ঠিত হয়নি।
এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক বলেন, “বেশকিছু উদ্ধার সরঞ্জাম সম্প্রতি আমাদের হাতে এসেছে, আরও বেশকিছু সরঞ্জাম আসার পথে রয়েছে। তবে এগুলোও প্রয়োজনের তুলনায় কম। এছাড়া এগুলো এখনো কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনার হাতেই রয়ে গেছে।”
সিডিএমপির আওতায় ভূমিকম্প ও দুর্যোগ মোকাবেলার প্রস্তুতি হিসেবে বিস্তৃত গবেষণা, ‘লাইফ-লাইন’ গবেষণা, বাংলাদেশ জাতীয় ইমারত নির্মাণ বিধিমালার (বিএনবিসি) জন্য কারিগরি ও তাত্ত্বিক নির্দেশনা, গৃহঋণ সংস্থার মাধ্যমে নির্মাণ শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, ভূমিকম্পের ‘ফল্ট জোন’ চিহ্নিত করা, সম্ভাব্য ভূমিকম্প ও ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা নির্ধারণে এলাকাভিত্তিক ‘মাইক্রো জোনেশন’ মানচিত্র তৈরি করা হয়েছে।
এছাড়া এই প্রকল্পের মাধ্যমে ফায়ার সার্ভিসের সহযোগিতায় ৬২ হাজার ‘শহরভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবক’ প্রস্তুত করা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই ৩০ হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবক প্রশিক্ষণ নিয়েছে।