ফারুকী হত্যাকাণ্ডের ৮ মাস : তদন্তে অগ্রগতি ‘জিরো’

টেলিভিশনে ইসলামী অনুষ্ঠানের উপস্থাপক নুরুল ইসলাম ফারুকী হত্যাকাণ্ডের পর আট মাস পেরিয়ে গেলেও খুনিদের কাউকে চিহ্নিত কিংবা খুনের কারণ উদ্ঘাটন করতে পারেনি পুলিশ।

প্রকাশ বিশ্বাসপ্রকাশ বিশ্বাসবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 May 2015, 03:35 PM
Updated : 6 May 2015, 05:24 AM

তদন্তের অগ্রগতি জানতে চাইলে এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির পরিদর্শক জুলহাস উদ্দিন আকন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে এক কথায় বলেন, “জিরো। কোনো অগ্রগতি নেই।”

এদিকে পুলিশের ভূমিকায় ক্ষোভ জানিয়ে তদন্তে অবহেলার অভিযোগ করেছেন ফারুকীর ছেলে বেসরকারি টেলিভিশন মাই টিভির ধর্ম বিষয়ক অনুষ্ঠানের প্রযোজক আহমেদ রেজা ফারুকী।

২০১৪ সালের ২৭ অগাস্ট সন্ধ্যার পর ১৭৪ নম্বর পূর্ব রাজাবাজারের ভাড়া বাড়ির দোতলায় ঢুকে গলা কেটে হত্যা করা হয় ফারুকীকে।

বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত বাংলাদেশের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুকী চ্যানেল আইয়ে ‘শান্তির পথে’ ও ‘কাফেলা’ নামে দুটি ইসলামী অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ছিলেন। হাই কোর্ট মাজার মসজিদের খতিবও ছিলেন তিনি। পাশাপাশি তিনি একটি হজ এজেন্সি চালাতেন।

ফারুকী হত্যাকাণ্ডের পর ধর্মীয় উগ্রবাদীদের সন্দেহের কথা জানিয়েছিলেন তার পরিবারের সদস্যরা। একই ধারণার কথা জানিয়েছিলেন পুলিশ কর্মকর্তারাও।

ব্লগার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে এর যোগসূত্রের বিষয়টিও আলোচনায় এসেছিল। অভিযোগ উঠেছিল বিভিন্ন টেলিভিশনে ইসলামী অনুষ্ঠানের কয়েকজন উপস্থাপকের সঙ্গে মতাদর্শিক বিরোধের কথাও।    

অনেক সন্দেহ নিয়ে আট মাস ধরে তদন্ত চললেও কোনো অগ্রগতি জানাতে পারলেন না তদন্ত কর্মকর্তা জুলহাস।

গত বৃহস্পতিবার তাকে টেলিফোন করে অগ্রগতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, “জিরো, এককথায় জিরো। তদন্তে কোনো অগ্রগতি নাই।”

কেন নেই- জানতে চাইলে তিনি সামনাসামনি কথা বলার আগ্রহ জানান।

সোমবার তার কার্যালয়ে গেলে পরিদর্শক জুলহাস বলেন, “কারা ওই ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে, তা সবাই ধারণা করতে সক্ষম।”

ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার, অভিজিৎ রায়, গোপীবাগের পীর লুৎফর রহমান ফারুকসহ ৬ খুনের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, “গতানুগতিকভাবেই বলতে হচ্ছে যে, এটা একই চক্রের কাজ।”

ব্লগার রাজীব হত্যাকাণ্ডের প্রধান আসামি পলাতক রেদোয়ানুল রানার ছবি দেখিয়ে বলেন, “একে পাওয়া গেলে সব কিছুর সুরাহা হবে।”

ফারুকী হত্যাকাণ্ডের পর তার পরিবারের পক্ষ থেকে শেরেবাংলা নগর থানায় খুনসহ ডাকাতির অভিযোগে মামলা করেছিলেন তার ছেলে ফয়সাল ফারুকী। কিন্তু একে নিছক ডাকাতি বলতে নারাজ তিনি। 

তদন্তে হতাশা প্রকাশ করে ফয়সাল বলেন, “তদন্ত আগের জায়গাতেই পড়ে আছে, এক ফোঁটাও এগোয়নি।

“পাঁচ-ছয়দিন আগে হত্যার প্রত্যক্ষদর্শী মারুফকে (নিহতের ভাগ্নে) তদন্ত কর্মকর্তা কয়েকজনের ফটো দেখিয়েছিল। তাদের কাউকে মারুফ চেনে না। সে পর্যন্তই।”

তদন্ত কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগ তুলে আহমেদ রেজা ফারুকী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “একটার পর একটা এরকম ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে বিচার করা গেলে একসঙ্গে অনেক ঘটনা জমে যেত না।”

এই হত্যামামলায় এ পর্যন্ত নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবির একজন সদস্য এবং আহলে হাদিসের যুব সংগঠনের সভাপতিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

জেএমবি সদস্য লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ থানার চণ্ডিপুরের মো. খোরশেদ আলম রুবেল (২৩) এবং রাজশাহীর বাঘা উপজেলার বাওসা হেদাতীপাড়ার মো. মোজাফ্ফর হোসেন ওরফে শাইখ মোজাফ্ফর বিন মোহসিনকে (৩৪) রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করেছে পুলিশ।

হত্যাকাণ্ডের দেড় মাস পর গত বছরের ১৯ অক্টোবরে ভোরে ক্যান্টনমেন্ট থানা এলাকা থেকে রুবেলকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশের নথিপত্র অনুযায়ী, মিরপুর ফ্লাইওভারের সংযোগস্থলে গোলাগুলির পর রুবেলকে গ্রেপ্তার করা হয়।

রুবেলসহ তার সঙ্গীরা তাদের ‘বড় ভাই’ সোহেল ওরফে রবিনের নির্দেশে ‘নাস্তিকতার’ জন্য মিরপুরের এক স্কুল শিক্ষককে হত্যা করতে যাচ্ছিল বলে পুলিশের দাবি।

মোজাফ্ফর বিন মোহসিনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজত চেয়ে পুলিশের আবেদনে বলা হয়েছিল, ফারুকীর সঙ্গে তার মতাদর্শগত প্রচণ্ড বিরোধ ছিল। হত্যাকাণ্ডের আগে ফারুকীকে নিয়ে উত্তেজনামূলক বক্তব্য দিয়েছিলেন তিনি।

হেফাজতে নেওয়ার আবেদনে এসবের উল্লেখ থাকলেও আদালতে পুলিশ যে প্রতিবেদন দিয়েছে, তাতে তদন্তে দিক-নির্দেশনা পাওয়ার কোনো ইঙ্গিত নেই।

নুরুল ইসলাম ফারুকী

ফারুকীর সংগঠন ইসলামী ফ্রন্টের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসেনার ঢাকা মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক ইমরান হোসাইন তুষার বিভিন্ন টেলিভিশনের ছয়জন উপস্থাপকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন।

তার দাবি, এদের মদদে এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে এবং এই ষড়যন্ত্রের কথা ফারুকী মৃত্যুর আগে বলে গিয়েছিলেন।

তুষার এই অভিযোগ আনুষ্ঠানিকভাবে দেওয়ার পর আদালত এজাহারের সঙ্গে তা একত্রে তদন্তের নির্দেশ দেয়।

তুষার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তিনি যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন, তাদের একজন একটি ইন্সুরেন্স কোম্পানির মালিকানায় রয়েছেন।

“ওই কোম্পানির মালিকানায় সরকারের একজন প্রভাবশালী কর্তাব্যক্তিও রয়েছেন। সে কারণে তদন্ত এগোচ্ছে না।”

তবে তার বক্তব্য নাকচ করে তদন্ত কর্মকর্তা জুলহাস বলেন, “তাদের (তুষার) তো কতবার আমি কথা বলার জন্য ডেকেছি, তারা আমার কাছে এসে তো এ কথা বলেনি।”

মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ঘটনার দিন সন্ধ্যা ৭টার দিকে দুজন লোক ফারুকীর বাসায় গিয়েছিলেন। তারা ড্রয়িংরুমে বসেন। ২০ মিনিট পর আরও ৬/৭ জন আসেন। এরপর ফারুকীর ভাগ্নে মারুফ হাসান এসে দেখেন, ওই ব্যক্তিরা ফারুকীর মাথায় পিস্তল ও চাপাতি ধরে রেখেছে।

ওই বাসায় তখন মারুফ ছাড়াও ছিলেন ফারুকীর স্ত্রী, শাশুড়ি, এক গৃহকর্মী এবং ফারুকীর দুজন ভক্ত। তাদের বেঁধে ফারুকীকে গলা কেটে হত্যার পর টাকা, স্বর্ণালঙ্কারসহ বিভিন্ন সামগ্রী লুট করে দুর্বৃত্তরা চলে যায়।