কারাবন্দি পিন্টুর মৃত্যু, অবহেলার অভিযোগ

পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মামলায় দণ্ডিত হয়ে কারাভোগের মধ্যে মারা গেছেন বিএনপি নেতা নাসির উদ্দিন আহম্মেদ পিন্টু।

নিজস্ব প্রতিবেদকও রাজশাহী প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 May 2015, 05:35 PM
Updated : 3 May 2015, 05:35 PM

রাজশাহী কারাগারে আকস্মিক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে রোববার দুপুরে তার মৃত্যু হয় বলে কারা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার দাবি, তার দলের এই নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। একই অভিযোগ তার পরিবারেরও।

এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, বিশেষ উদ্দেশ্য থেকেই এসব কথা বলা হচ্ছে।

সম্প্রতি হয়ে যাওয়া সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ঢাকা দক্ষিণ থেকে মেয়র পদে প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন পিন্টু, কিন্তু কারাগার থেকে দাখিল করা তার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে যায়।

এই নির্বাচনে দেওয়া হলফনামা অনুযায়ী পিন্টুর বয়স হয়েছিল ৪৮ বছর। ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি পিন্টু বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। ২০০১ সালে ঢাকার লালবাগ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। 

পিন্টুর স্ত্রী নাসিমা আক্তার কল্পনা। তাদের বড় ছেলে কানাডার টরেন্টোর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন। আর ছোট ছেলে পড়েন ঢাকার একটি স্কুলে।

২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর বহুল আলোচিত পিলখানা হত্যা মামলার রায়ে পিন্টুকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় ঢাকার আদালত। ২০০৯ সালের বিদ্রোহের সময় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ অন্তত ৭৪ জন নিহত হন। হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্র এবং আসামিদের পালাতে সহযোগিতার অভিযোগ ছিল পিন্টুর বিরুদ্ধে।

পিলখানা হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদনে নাম আসার পর ২০০৯ সালের জুন মাসে হাই কোর্টের বাইরে থেকে পিন্টুকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর তার আর জেল থেকে বের হওয়া হয়নি।

পিন্টুর মরদেহ গ্রহণের জন্য রাজশাহী গেছেন তার ভাই নাসিম আহমেদ রিন্টু। তিনি জানান, রাজশাহী থেকে মরদেহ ঢাকায় আনার পর আজিমপুরে তাদের বাবার কবরে পিন্টুকে দাফন করা হবে।

পিন্টুকে গত ২০ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ থেকে রাজশাহী কারাগারে নেওয়া হয়েছিল বলে কারা অধিদপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান।

রাজশাহীর রাজপাড়া থানার ওসি মেহেদী হাসান সাংবাদিকদের বলেন, বুকে ব্যথা অনুভব করায় পিন্টুকে দুপুরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয় কারা কর্তৃপক্ষ। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক ১২টা ২০ মিনিটে তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান ডা. রইছ উদ্দিন জানান, বেলা ১২টার পর পিন্টুকে হাসপাতালে আনা হয়েছিল।

“তবে তিনি মারা গেছেন তার আগেই। কার্ডিয়াক অ্যাটাকে তার মৃত্যু হয়েছে।”

বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও রাজশাহীর সংগঠনিক সম্পাদক মতিউর রহমান মন্টু বলেন, শনিবার তিনি কারাগারে গিয়েছিলেন পিন্টুর সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু তিনি অসুস্থ জানিয়ে কারা কর্তৃপক্ষ দেখা করতে দেয়নি।

“হাসপাতালের চিকিৎসকরা আমাকে জানিয়েছেন, কারাগারে নাসির উদ্দিন পিন্টুকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও ওষুধ সরবরাহ করা হত না। এ কারণে তিনি আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। কারা কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে তার মৃত্যু হয়েছে।”

কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান ডা. রইছ উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, পিন্টু হৃদযন্ত্র, কিডনি, ডায়াবেটিস, রক্তচাপ এবং চোখ ও বুকের সমস্যায় ভুগছিলেন।

কারাগার থেকে শনিবার হাসপাতালের পরিচালকের কাছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়। সে অনুযায়ী শনিবার বিকালে পিন্টুর চিকিৎসার জন্য কারাগারে যান ডা. রইছ, যিনি বিএনপি সমর্থক চিকিৎসকদের সংগঠন ড্যাবের রাজশাহী শাখার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। 

তিনি অভিযোগ করেন, সিনিয়র জেল সুপার শফিকুল ইসলাম খান ‘চা খাইয়ে’ তাকে তার অফিস থেকেই ‘বিদায় করে দেন’।

“রোগীর অবস্থা ভালো ছিল না বলেই পরের দিন এ দুর্ঘটনা ঘটেছে,” বলেন ডা. রইছ।

সিনিয়র জেল সুপার শফিকুল ইসলাম খান বলেন, “২৫ এপ্রিল পিন্টুর ফলোআপ চিকিৎসার ডেট ছিল। ওই দিন তাকে মেডিকেলে দেখিয়ে আনা হয়েছিল। আজ দুপুরে তিনি বুকের ব্যথার কথা জানানোর সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নেওয়া হয়।”

পূর্ব পরিচয়ের সূত্র ধরে পিন্টুর সঙ্গে পরিচয় ছিল দাবি করে এই কারা কর্মকর্তা বলেন, “উনি (পিন্টু) এক সময় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ঠিকাদার ছিলেন। তখন থেকেই তিনি আমার পরিচিত এবং তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা।

“রাজশাহী কারাগারে আসার পর তার প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। চিকিৎসায় অবহেলার কারা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ তোলা হয়েছে তা উদ্দেশ্যমূলক।”

পরিকল্পিত হত্যার অভিযোগ

পিন্টুর মৃত্যুর পর পুরান ঢাকার হাজারীবাগের মনেশ্বর রোডে তার বাসায় পরিবারের সব সদস্যই পরিকল্পিতভাবে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ তোলেন সাংবাদিকদের কাছে।

পিন্টুর মা হোসেনে আরা বলেন, “আমার ছেলেকে রাজশাহীতে নিয়ে খুন করা হয়েছে। এই সরকারের অনেক গুম-খুনের মতো আমার ছেলেকেও রাজশাহীতে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে।”

“আমি এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই। আল্লাহ তুমি বিচার কর,” কাঁদতে কাঁদতে বলেন তিনি। 

মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর থেকে পিন্টুর স্ত্রী নাসিমা আখতার কল্পনা দুই দফা মূর্ছা যান বলে পরিবারের সদস্যরা জানান।

বিকালে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “আমার স্বামী কিছুতেই মরতে পারে না। তাকে হত্যা করা হয়েছে। তাকে মেরে ফেলা হয়েছে।”

মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমে প্রকাশের পর থেকেই পিন্টুর বাসায় জড়ো হন লালবাগ, হাজারীবাগ, কামরাঙ্গীরচরের কয়েকশ’ বিএনপিকর্মী।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান, মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক শিরিন সুলতানাসহ বেশ কয়েকজন নেতা পিন্টুর বাসায় গিয়ে পরিবারের সদস্যদের সমবেদনা জানান।

পিন্টুর ভাই নাসিম আহমেদ রিন্টু বলেন, “আমার ভাইকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। মেডিকেল বোর্ডের সুপারিশ অনুযায়ী হাই কোর্ট বিশেষায়িত হাসপাতালে রেখে তার চিকিৎসা করাতে নির্দেশ দিয়েছিল। এরপরও আমার ভাইকে গত ২০ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ কারাগার থেকে রাজশাহী নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তার কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে আমরা জানতে পেরেছি।”

স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল এবিষয়ে সাংবাদিকদের বলেন, “বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে এ অভিযোগ করা হয়েছে। এসব বক্তব্যের কোনো ভিত্তি নেই।”

তিনি বলেন, “একজন বন্দি যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা পান, তাকে তা দেওয়া হয়েছে। আমি যতটুকু জানতে পেরেছি, তার হার্ট হ্যাটাক হয়েছিল।”

বিকাল ৬টার দিকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পিন্টুর ময়নাতদন্ত শেষ হয় বলে রাজপাড়া থানার ওসি মেহেদি হাসান জানিয়েছেন।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কফিল উদ্দিন আকাশ ময়নাতদন্ত করেন। এর আগে জেলা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শিমুল আকতারের উপস্থিতিতে পুলিশ তার সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে। 

কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পিন্টুর লাশ তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে বলে জানান ওসি মেহেদি।

নিজের দলের আমলেই গ্রেপ্তার

গত শতকের শেষভাগে হাবিব-উন নবী খান সোহেলের নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক হন পিন্টু। পরে আসেন সভাপতির দায়িত্বে।

ছাত্রদলের সভাপতি থাকা অবস্থায় ২০০১ সালের নির্বাচনে ঢাকার লালবাগ-কামরাঙ্গীর চর আসন থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন তিনি।

পিলখানা হত্যা মামলার রায়ের দিন আদালতে নাসির উদ্দিন পিন্টু

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পাঁচবছরে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ নানা ঘটনায় বহুবার পত্রিকার শিরোনাম হন পিন্টু।

এরকম একটি ঘটনায় সন্ত্রাস ও টেন্ডারবাজির মামলায় নিজের দল সরকারে থাকা অবস্থায় কারাগারে যেতে হয় তখনকার এই সংসদ সদস্যকে।

জরুরি অবস্থার সময় গ্রেপ্তার হওয়ার পর ২০০৮ সালে কারাগারে একজন ডেপুটি জেলারকে পিটিয়ে আহত করেছিলেন পিন্টু। ত্রাণের টিন আত্মসাতের একটি মামলার শুনানি চলাকালে গতবছর ঢাকার আদালতে এক পুলিশ কর্মকর্তাকে ‘মালাউন’ গালি দিয়ে মারতে উদ্যত হয়েছিলেন তিনি।

প্রার্থী হওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনে দেওয়া হলফনামা অনুযায়ী পিন্টুর জন্ম ১৯৬৭ সালে।

হলফনামার সঙ্গে শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রমাণ হিসাবে তিনি হিসাব বিজ্ঞানে ‘মাস্টার্স’ ডিগ্রির একটি সার্টিফিকেট দাখিল করেছিলেন, যদিও সেটি ‘আসল’ কিনা সে প্রশ্ন উঠেছিল তিনি ছাত্রদলের সভাপতি থাকা অবস্থাতেই।   

পিন্টুর মৃত্যু নিয়ে অভিযোগ জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসে ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, “স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ জনগণের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। আমি যখন ছাত্রদলের সভাপতি ছিলাম, পিন্টু লালবাগের আহ্বায়ক ছিল। সে ছিল একজন সাহসী ছাত্রনেতা।”

পিন্টুর মৃত্যুতে শোক জানাতে সোমবার সারা দেশে দলীয় কার্যালয়ে কালো পতাকা উত্তোলন করবে বিএনপি। সোমবার বেলা সাড়ে ১১টায় নয়া পল্টনের কার্যালয়ের সামনে পিন্টুর জানাজা হবে।