হত্যাকাণ্ডের ১১ মাসের মাথায় পুলিশ অভিযোগপত্র দিলেও তা নিয়ে আপত্তি রয়েছে নিহতদের পরিবারের সদস্যদের।
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল দুপুরে নারায়ণগঞ্জ আদালতে একটি মামলায় হাজিরা দিয়ে ঢাকার ফেরার পথে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ফতুল্লার লামাপাড়া থেকে অপহরণ করা হয় নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র ও ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, তার বন্ধু সিরাজুল ইসলাম লিটন, সহযোগী মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, স্বপনের গাড়ি চালক জাহাঙ্গীরকে ।
ওই ঘটনা দেখে ফেলায় নজরুলের গাড়ির পেছনে থাকা আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহিমও অপহৃত হন।
ওই ঘটনা সারা দেশে আলোচনার ঝড় তোলে। হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠে র্যা ব-১১ এর শীর্ষ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে, যাদের মধ্যে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরীর মায়ার মেয়ের জামাতা এবং ওই ক্যাম্পের অধিনায়ক মোহাম্মদ তারেক সাঈদও রয়েছেন।
নিহত নজরুল ইসলামের ছোট মেয়ে তানহা ঢাকার ভিকারুন্নিসা স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছে। বড় ছেলে নাঈম পড়ে রাজউক মডেল স্কুল ও কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক শাখায়। ছোট ছেলে ফাহিম একই প্রতিষ্ঠানের নবম শ্রেণির ছাত্র।
স্বামীর ওয়ার্ডে পরে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি। তিনি জানান, তার এবং নজরুলের রেখে যাওয়া সম্পত্তি থেকে যে আয় হয় তা দিয়েই চলছে তাদের সংসার।
কিন্তু যুবলীগ নেতা মনিরুজ্জামান স্বপনের দুই মেয়ে মাহি ও স্বর্ণালীকে নির্ভর করতে হয় চাচাদের ওপর। বাবাই ছিল তাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।
স্বপনের গাড়ির চালক জাহাঙ্গীর যখন নিহত হন, তখন তার স্ত্রী নুপুর আট মাসের অন্তঃস্বত্ত্বা। ওই বছরের ৪ জুলাই নুপুর কন্যা সন্তানের জন্ম দেন।
শিশুসন্তান আর নিজের জীবন বাঁচাতে নুপুর কাজ নিয়েছেন একটি গার্মেন্টে। স্বল্প আয়ে কষ্টেসৃষ্টে দিন চালাতে হচ্ছে তাকে। মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে তার দুশ্চিন্তা কাটছে না।
নুপুর বলেন, “ঘটনার পর আমরা গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন। সে সময় প্রধানমন্ত্রী সবার দায়িত্ব নেওয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু এখনও কোনো সহযোগিতা তো পেলাম না।”
পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে বিপদে আছে চন্দন সরকারের গাড়ির চালক ইব্রাহিমের পরিবারও।
হত্যাকাণ্ডের পর থেকে ইব্রাহিমের দুই স্ত্রী মাহমুদা ও হনুফা আক্তার, তাদের পাঁচ সন্তান ও বাবা-মা সোনারগাঁওয়ের আলগীর চরে গ্রামের বাড়িতে থাকছেন। পরিবারের এতগুলো মানুষের মুখে খাবার তুলে দিতে একমাত্র ভরসা কাপড় সেলাইয়ের আয়।
মাহমুদা জানান, এই আয়ে তার দুই ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া তো দূরের কথা, খাবার জুটছে না ঠিকমতো।
ইব্রাহিমের দ্বিতীয় স্ত্রী হনুফা আক্তার প্রশ্ন করেন, “আমাদের দুই ঘরে পাঁচটা ছেলেমেয়ের এখন কী হবে?”
অনিশ্চয়তা গ্রাস করেছে নিহত নজরুলের বন্ধু সিরাজুল ইসলাম লিটন ও তাজুল ইসলামের পরিবারেও। আর্থিক অনিশ্চয়তার পাশাপাশি এক বছরেও বিচার না পাওয়ায় আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন তারা।
মামলা ও বিচার
ঘটনার পর নজরুল ইসরামের শ্বশুর শহিদুল ইসলাম ওরফে শহীদ চেয়ারম্যান অভিযোগ তোলেন, ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নূর হোসেন র্যা বকে ৬ কোটি টাকা দিয়ে নজরুলকে হত্যা করিয়েছেন।
এই ঘটনায় কাউন্সিলর নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি ফতুল্লা মডেল থানায় নূর হোসেন, সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইয়াসিন মিয়া, হাসমত আলী হাসু, আমিনুল ইসলাম রাজু, আনোয়ার হোসেন আশিক ও ইকবাল হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা করেন।
নিহত আইনজীবী চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা করেন।
পরে র্যা বের তিন কর্মকর্তা লে. কর্নেল মোহাম্মদ তারেক সাঈদ, মেজর আরিফ হোসেন ও লে. কমান্ডার এমএম রানাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে তারা অপহরণ ও হত্যার কথা স্বীকার করেন।
গত ৮ এপ্রিল মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ওসি মামুনুর রশিদ মণ্ডল নারায়ণগঞ্জ জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম চাঁদনী রূপমের আদালতে ৩৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন। এদের মধ্যে পলাতক দেখানো হয়েছে ১৩ জনকে; মামলায় মোট ১২৭ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে।
অভিযোগপত্রে তদন্ত কর্মকর্তা বলেছেন, এলাকায় আধিপত্য নিয়ে বিরোধ থেকে কাউন্সিলর নজরুল ইসলামকে হত্যার এই পরিকল্পনা করেন আরেক কাউন্সিলর নুর হোসেন।
তবে নুর হোসেনের সঙ্গী আরও পাঁচজনকে অব্যাহতি দেওয়ায় অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি আবেদন দেবেন বলে জানিয়েছেন নিহত কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম।
এছাড়া নারায়ণগঞ্জে অপহরণ ও হত্যার ওই ঘটনায় প্রশাসনের কেউ বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সদস্যের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা বা সংশ্লিষ্টতা ছিল কি না- গণতদন্তের মাধ্যমে তা উদঘাটন করতে হাই কোর্টের নির্দেশে একটি প্রশাসনিক তদন্ত কমিটি গঠন করে সরকার।
ওই কমিটি চার শতাধিক ব্যক্তির সাক্ষ্য নিয়ে প্রতিবেদন চূড়ান্ত করলেও এখন পর্যন্ত তা আদালতে জমা পড়েনি।