ধর্মবিশ্বাসকে পুঁজি করেছেন লুৎফুর

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত লুৎফর রহমান কেবল দুর্নীতির মাধ্যমে লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটসকে ‘লজ্জায়’ ডোবাননি, নির্বাচনে তিনি যে অবৈধভাবে ধর্মীয় প্রভাব খাটিয়েছেন, তাও উঠে এসেছে আদালতের রায়ে। 

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 April 2015, 09:13 PM
Updated : 24 April 2015, 09:13 PM

ইমামদের দিয়ে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর বিরুদ্ধে বর্ণবিদ্বেষের অপপ্রচার এবং ভোট জালিয়াতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় বৃহস্পতিবার লুৎফরকে টাওয়ার হ্যামলেটসের মেয়র পদ ছাড়ার নির্দেশ দেয় যুক্তরাজ্যের একটি  আদালত।

সেইসঙ্গে তাকে নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষণা করে  আড়াই লাখ পাউন্ড জরিমানা করা হয়েছে।

যুক্তরাজ্যের দি টাইমস অনলাইনে শুক্রবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্রিটেনের ইতিহাসে গত একশ বছরে লুৎফুরই প্রথম ব্যক্তি, যাকে অবৈধভাবে ধর্মীয় প্রভাব খাটানোর অভিযোগে শাস্তি দেওয়া হল।

প্রতিবেদক ডোমিনিক কেনেডি লিখেছেন, “ব্রিটেনে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত প্রথম মুসলিম মেয়র হওয়ার সম্মান অর্জনের পর লুৎফুর রহমান কেবল তার অফিসকেই লজ্জার মুখে ফেলে নিজের পতন ডেকে আনেননি, নির্বাচনে তিনি যে ধর্মকে পুঁজি করেছিলেন, তাও উঠে এসেছে আদালতের রায়ে।”  

“বহু সংস্কৃতির দেশ ব্রিটেনের একটি শহুরে জনগোষ্ঠীর মধ্যে ইসলামী পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতি কীভাবে শিকড় গেড়েছে, তা বেরিয়ে এসেছে ভোটের প্রচারে তার দুর্নীতি ও অবৈধ কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে”, বলা হয়েছে পত্রিকাটির আরেক প্রতিবেদনে। 

দি টাইমস লিখেছে, লুৎফুরের রাজনৈতিক উচ্চাশার পথে যিনিই দাঁড়িয়েছেন, ‘বর্ণবাদ ও ইসলামভীতির’ অভিযোগ তুলে তাকেই সরে যেতে বাধ্য করা হয়েছে।

“তার কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে প্রায় সবাই।”

২০০৮ সালে যুক্তরাজ্যে ‘জার্নালিস্ট অব দ্য ইয়ার’ পুরস্কারে ভূষিত অ্যান্ড্রু গিলিগান গত বছর তার এক লেখায় লুৎফুর রহমানের বিরুদ্ধে উগ্রপন্থী গোষ্ঠী ‘ইসলামি ফোরাম অব ইউরোপ’-এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তোলেন।

উগ্রপন্থি এই সংগঠনটি ব্রিটেনে ‘ইসলামি সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা’ চালু করতে চায়।

‘মোল্লাদের সমর্থনপুষ্ট’ লুৎফুর হোয়াইট চ্যাপেল রোডে পূর্ব লন্ডন মসজিদে চরমপন্থিদের আস্তানা গড়ে তুলেছেন বলেও অভিযোগ করে আসছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশিদের অনেকে। 

পূর্ব লন্ডনের যে অংশটিকে লুৎফুর তার ক্ষমতাকেন্দ্রে পরিণত করেছিলেন, সেই টাওয়ার হ্যামলেটস বরো গত কয়েকশ বছরে বহুবার অভিবাসীদের আকর্ষণের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে এর ডকইয়ার্ড ও পোশাক ব্যবসার কারণে।

বর্তমানে এই সিটি কাউন্সিলের ৩৫ শতাংশ অধিবাসী মুসলিম এবং ৩২ শতাংশ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত।   

আদালতের রায়ে বিচারক রিচার্ড মওরি বলেন, “লুৎফুর ও তার সহযোগীরা বরাবরই টাওয়ার হ্যামলেটসের বাংলাদেশি বাংশোদ্ভূতদের দেখিয়েছেন একটি ‘সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী’ হিসাবে, যারা ‘বিরাট এক বর্ণবাদী সমাজের’ চাপের মধ্যে রয়েছে। কিন্তু আদালতকে বাস্তবতার দিকে তাকাতেই হবে।”  

টাইমস অনলাইনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৬৫ সালে বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া লুৎফুর শৈশবেই যুক্তরাজ্যে যান। আইন পেশায় যুক্ত হওয়ার পর তিনি যোগ দেন একটি ফার্মে। ব্রিটেনের লেবার পার্টিতে তিনি যোগ দেন ১৯৮৯ সালে।   

টাওয়ার হ্যামলেটসের কাউন্সিলর হওয়ার পর লেবার পার্টি থেকে মনোনয়ন না পেয়ে ২০১০ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন লুৎফুর। একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত হিসাবে সহজেই তিনি মেয়র নির্বাচিত হন। কিন্তু শিগগিরই তার প্রশাসনের বিরুদ্ধে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির অভিযোগ ওঠে।  

টাইমস লিখেছে, লুৎফুর কাউন্সিল চালাতেন কেবল বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কাউন্সিলরদের নিয়ে। আর স্থানীয় কমিউনিটির মধ্যে প্রভাব ধরে রাখতে তিনি কাজে লাগান স্থানীয় মসজিদ কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মওলানা শামসুল হকের সঙ্গে তার বন্ধুত্বের বিষয়টি।  

“টাওয়ার হ্যামলেটসের কাউন্সিল চেম্বারের পাবলিক গ্যালারি প্রায়ই মেয়র লুৎফুরের উচ্ছৃঙ্খল সমর্থকে পূর্ণ থাকত। প্রায়ই তারা অভিযোগ করত করজারভেটিব কাউন্সিলর পিটার গোল্ডসকে নিয়ে, কেননা তিনি একজন ইহুদি ও সমকামী। এটা ঠেকানোর কোনো চেষ্টা মেয়রকে কখনো করতে দেখা যায়নি।”   

কালো রঙের কার্ডিগান পড়ায় লেবার পার্টির একজন নারী কাউন্সিলরকে একবার ফ্যাসিস্টদের সঙ্গে তুলনা করেন লুৎফুরের ‘ডানহাত’ আলিবর চৌধুরী।  

অথচ সেই নারী কাউন্সিলর এক আত্মীয়র মৃত্যুতে শোক জানাতেই কালো কার্ডিগান পড়েছিলেন বলে আদালতের রায়ে উল্লেখ করা হয়।

টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, লুৎফুর কেবল সেইসব সংগঠনকেই কাউন্সিল থেকে আর্থিক সহায়তা দিতেন, যারা বাংলাদেশিদের নিয়ে কাজ করে। আর সেইসব সংবাদমাধ্যমই কাউন্সিলের টাকা পেত যারা লুৎফুরের প্রচার চালাত।  

“এই আর্থিক সহায়তাকে বিচারক বিবেচনা করেছেন ঘুষ হিসাবে। এমন কিছু বাংলাদেশি ও মুসলিম লাঞ্চ ক্লাবকে মেয়র ১ লাখ পাউন্ড দিয়েছেন, যারা কখনো অনুদানের জন্য আবেদনই করেনি।”

লুৎফুরের আমলে লন্ডনের পপলার টাউন হল মাত্র ৮ লাখ ৭৫ হাজার পাউন্ডে বিক্রি করে দেওয়া হয় এমন এক ব্যক্তির কাছে, যিনি মেয়রের নির্বাচনী প্রচারে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। পরে ওই ভবনটিকে হোটেলে রূপান্তর করা হয় মেয়রের অনুমতি নিয়েই।

প্রাইস ওয়াটারহাউস কুপার্সের নিরীক্ষা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পরে ব্রিটিশ সরকার এসব বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে, শুরু হয় লুৎফুরের বিচার।  

লুৎফুর কীভাবে সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করেছেন, তা আরও স্পষ্ট হয় ২০১৪ সালে তিনি দ্বিতীয় দফায় মেয়র প্রার্থী হওয়ার পর।

টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই কাউন্সিল এলাকায় ৪৫টি মসজিদ রয়েছে এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের একটি বড় অংশ ধার্মিক মুসলমান। এই বাংলাদেশিদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা ব্রিটেনে জন্ম নিলেও তাদের প্রথম ভাষা ইংরেজি নয়। 

এ প্রসঙ্গে আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, যে রাজনীতিবিদ এই মুসলিম ভোটারদের টানতে পারবেন, তিনি ‘সহজেই’ টাওয়ার হ্যামলেটসের মেয়র নির্বাচিত হবেন। 

গতবছর ওই নির্বাচনের আগের শুক্রবার ১০১ জন ইমাম ও মুসলিম নেতা স্থানীয় বাংলা সংবাদমাধ্যমগুলোতে একটি চিঠি পাঠান, যাতে বলা হয়, লুৎফুরকে ভোট দেওয়া ‘মুসলমানদের ইমানী দায়িত্ব’।  

আদালতের রায়ে এ বিষয়টিকে তুলে ধরা হয়েছে একজন রাজনীতিবিদের ‘ধর্মীয় আবেগের অপব্যবহার’ হিসাবে।

পুলিশ ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরুরও ইংগিত দিয়েছে। ফলে লুৎফুরকে জেলও খাটতে হতে পারে।   

এই রায়ের ফলে ইতোমধ্যে লুৎফুরের দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম হয়েছে, কেননা তার আইনজীবী হিসাবে কাজ করার অধিকার কেড়ে নিয়েছে আদালত।

বিচারক বলেছেন, লুৎফুর ও তার সাক্ষীরা শুনানিতে যা বলেছেন, তা ‘একগাদা মিথ্যা’ ছাড়া আর কিছুই নয়।