লুৎফুরকাণ্ডে ‘তোপের মুখে’ লন্ডন পুলিশ ও নির্বাচন কমিশন

ভোট জালিয়াতির অপরাধে আদালতের রায়ে পূর্ব লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটসের মেয়র পদ হারানো বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত লুৎফুর রহমানের দীর্ঘদিনের দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় সমালোচনার মুখে পড়েছে লন্ডন পুলিশ ও নির্বাচন কমিশন।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 April 2015, 02:07 PM
Updated : 24 April 2015, 09:43 PM

লুৎফুরের বিরুদ্ধে আদালতে প্রধান অভিযোগকারী অ্যান্ডি এরলামকে উদ্ধৃত করে যুক্তরাজ্যের টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে  বলা হয়, এক কর্তৃপক্ষ লুৎফুরকে ‘রক্ষার চেষ্টা’ করেছে। আরেক কর্তৃপক্ষ ‘বর্ণবাদের অভিযোগ ওঠার ভয়ে’ তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।

ভোট জালিয়াতি, ইমামদের দিয়ে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর বিরুদ্ধে বর্ণবিদ্বেষের অপপ্রচার এবং সরকারি অর্থে ভোট কেনার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় বৃহস্পতিবার লুৎফুরকে মেয়র পদ ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছে আদালত।

ওই কাউন্সিলে নতুন করে ভোটগ্রহণের আদেশ দিয়ে তাতে লুৎফুরের অংশগ্রহণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ  করেছে আদালত। সেইসঙ্গে অবিলম্বে তাকে আড়াই লাখ পাউন্ড জরিমানা পরিশোধ করতে বলা হয়েছে।

রায়ের পর স্থানীয় একটি রেডিওতে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এরলাম বলেন, নির্বাচন কমিশন বা পুলিশ কেউ লুৎফুরের দুর্নীতির বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি, সহযোগিতাও করেনি।

“কার্যত একটা সময়ে এসে মনে হয়েছে, লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশ অনেক বছর ধরেই মি. রহমানকে রক্ষা করে আসছে।”

টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে জানানো হয়, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি, দর্শন ও অর্থনীতির স্নাতক এবং সাবেক চলচ্চিত্রকার এরলাম গত মে মাসে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল নির্বাচনে মেয়র পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সামান্য ভোটের ব্যবধানে লুৎফুরের কাছে হেরে যান। উগ্র ইসলামী গোষ্ঠীকে মদদ দেওয়ার অভিযোগে লেবার পার্টি বহিষ্কৃত লুৎফুর ভোটে দাঁড়ান স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে।

ভোটে দুর্নীতি দেখে ‘হতবাক’ হয়ে যান এরলাম; দাবি তোলেন পুনর্নির্বাচনের। তার সঙ্গে যোগ দেন আরও তিন জন- আজমল হুসাইন, অ্যাঞ্জেলা মুফাত ও ডেবি সিমন।

২০১৪ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে লুৎফুরের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, তাকে ভোট না দিলে তা ‘ইসলামবিরোধী’ হবে বলে প্রচার চালানো হচ্ছে। সেই সঙ্গে নির্বাচনে প্রভাব খাটানোরও অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে।

অভিযোগ তদন্তের পর রয়েল কোর্টস অফ জাস্টিসে ১০ সপ্তাহ শুনানি হয়। শেষ পর্যন্ত বৃহস্পতিবার রায় হয়।

রায়ে ওই নির্বাচন বাতিলের আদেশ দিয়ে নির্বাচন কমিশনার রিচার্ড মওরি বলেন, নির্বাচনী প্রচারে ‘ধর্ম’ ও ‘বর্ণবাদ’কে কাজে লাগিয়েছেন লুৎফুর রহমান। নির্বাচনের পুরো সময়জুড়ে ‘রেইস ও ইসলামফোবিয়া কার্ড’ খেলেছেন তিনি।

লুৎফুর রহমানের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ করার সাহস দেখানোর জন্য চার আবেদনকারীরও প্রশংসা করেছেন বিচারক।

এরলাম বলেন, “কর্তৃপক্ষ অংশত বর্ণবিদ্বেষের অভিযোগের ভয়ে ছিল এবং আমি বিশ্বাস করি স্থানীয় পুলিশের প্রভাবশালী গোষ্ঠী রয়েছে, যারা দুর্নীতিবাজ।

“অনেক বছর ধরেই টাওয়ার হ্যামলেটসে কী ঘটছে তা মানুষ জানলেও কেউ কিছু করতে চায়নি। আমরা জানি, আমরা কোনো আর্থিক সুবিধার জন্য লড়ছি না। আমাদের লড়াই ব্যক্তিগতভাবে লুৎফুরের বিরুদ্ধে নয়, তার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে।”

তিনি বলেন, “আমাদের মনে হয়েছে, টাওয়ার হ্যামলেটসের পুরো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ভেঙে পড়েছে। রায়েও আমরা সঠিক প্রমাণিত হয়েছি। বিচারক পরিষ্কারভাবে বলেছেন, এই বরোতে পুরো প্রক্রিয়া ভেঙে পড়েছে।

“এখন আমরা কমিশনারের কাছে দাবি জানাব, যাতে গত মের নির্বাচনে সংঘটিত ভোট জালিয়াতির ঘটনার সম্পূর্ণরূপে নতুন তদন্ত করা হয়।”

টেলিগ্রাফ লিখেছে, ২০০৮ সালে মেয়র হওয়ার পর থেকে লুৎফুরের সন্দেহজনক আচরণ নিয়ে বারবার অভিযোগ করা হলেও পুলিশ তাতে কান দেয়নি। এরপর চার সাধারণ ভোটার সাহস করে আদালতে অভিযোগ করেন।

এরলাম বলেন, পুলিশ এবং নির্বাচন কমিশন ‘অপদার্থ’। তারা লুৎফুরকে বিচারের মুখোমুখি করতে ‘কিছুই করেনি’।

“আদালতে অভিযোগের আগে ভোট জালিয়াতির ঘটনাগুলো পুলিশের নজরে আনা হলেও তারা গুরুত্ব দেয়নি। এটা মোটেই ঠিক না যে তারা ব্যক্তির ঘাড়ে দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকি ফেলবে। আমরা যদি হেরে যেতাম তাহলে ১০ লাখ পাউন্ড আমাদের দিতে হত; আমরা সর্বস্বান্ত হতাম।”

এরলাম বলেন, পুলিশ বরং তার বিরুদ্ধে লুৎফুরের সমর্থকদের করা অভিযোগকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের হুমকি দিয়েছেন। কিন্তু এই মামলায় লুৎফুরের বিরুদ্ধে সাক্ষীদের ‘মারাত্মকভাবে প্রভাবিত’ করার গুরুতর অভিযোগের বিরুদ্ধে তারা কিছুই করেনি।

“এ কারণে কয়েকজন সাক্ষী নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছেন অথবা সাক্ষ্য পরিবর্তন করেছেন।”

এর আগে ফেব্রুয়ারিতে টাওয়ার হ্যামলেটসের নির্বাচনে দুর্নীতি ঠেকাতে লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে বলে অভিযোগ করেন টাওয়ার হ্যামলেটস পরিষদে কনজারভেটিভ গ্রুপের নেতা পিটার গোল্ডস।

শুনানিতে তিনি বলেন, মেট্রোপলিটন পুলিশ ‘খুবই দুর্বলভাবে’ কাজ করেছে।

গোল্ডস বলেন, “দীর্ঘ দিন ধরে’ লন্ডন পুলিশের বিষয়ে ‘অনেকগুলো বিষয় নিয়ে প্রশ্ন’ উঠেছে। আমি মনে করি মেট্রোপলিটন পুলিশ খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছে।”

নিজের সম্পর্কে আদালতকে জানান, ১৯৭০ এর দশকের শুরুতে ও ৮০-এর দশকের শেষ দিকে তিনি কনজারভেটিভ পার্টির পেশাদার প্রতিনিধি ছিলেন। লন্ডনের ১০টি ভিন্ন বরোতে তিনি নির্বাচনী প্রতিনিধি হিসেবে এবং ৩২টি কাউন্সিলে নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিয়েছেন। 

১৫ বছর আগে ইস্ট লন্ডনে বসবাস শুরুর পর থেকে তিনি কনজারভেটিভ পার্টির স্থানীয় শাখায় সক্রিয় রয়েছেন।

“আমার অভিজ্ঞতায় লন্ডনে আমি দেখেছি, (টাওয়ার হ্যামলেটসে) নির্বাচনগুলিতে স্বচ্ছতার খুবই অভাব থাকে, ব্যবস্থাপনায় চরম দুর্বলতা থাকে এবং দুর্নীতি হয়।

“গত এক দশকে পুলিশ ও নির্বাচনী কর্তৃপক্ষের কাছে আমি অসংখ্য চিঠি পাঠিয়েছি, যেগুলোর বেশিরভাগই উপেক্ষিত হয়েছে অথবা ফেলে রাখা হয়েছে।”