লুৎফুরের বিরুদ্ধে তদন্তের কথা ভাবছে পুলিশ

ভোট জালিয়াতিতে পূর্ব লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটসের মেয়র পদ হারানো বিতর্কিত বাংলাদেশি লুৎফর রহমানের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের তদন্তে নামার কথা ভাবছে পুলিশ।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 April 2015, 03:58 AM
Updated : 1 May 2015, 06:31 PM

লুৎফুরের বিরুদ্ধে ভোট জালিয়াতি, ইমামদের দিয়ে ভোটে প্রভাব বিস্তার, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর বিরুদ্ধে বর্ণবিদ্বেষের অপপ্রচার এবং সরকারি অর্থ দিয়ে ভোট কেনার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে অবিলম্বে মেয়রের অফিস ত্যাগ করার নির্দেশ দিয়ে বৃহস্পতিবার রায় দেয় আদালত।

পূর্ব লন্ডনের স্থানীয় ওই কাউন্সিলে নতুন করে ভোটগ্রহণের আদেশ দিয়ে তাতে লুৎফুরের অংশগ্রহণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। সেইসঙ্গে অবিলম্বে তাকে আড়াই লাখ পাউন্ড জরিমানা পরিশোধ করতে বলা হয়েছে।

আদালতের এই আদেশ আসার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে রাতে লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ওই রায় পুলিশের নজরে এসেছে এবং তারা বিষয়টি খতিয়ে দেখছে।

লুৎফুরের বিরুদ্ধে মামলার জন্য যুক্তরাজ্যের ক্রাউন প্রসিকিউশন সার্ভিসের অনুমোদন নিয়ে তাদের এগোতে হবে।

বাংলাদেশি লুৎফুর এক সময় লেবার পার্টিতে যুক্ত ছিলেন, দলটির হয়ে তিনি টাওয়ার হ্যামলেটস বারা কাউন্সিলে কাউন্সিলর হয়েছিলেন।

লেবার পার্টি থেকে মনোনয়ন না পেয়ে ২০১০ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মেয়র নির্বাচন করে বিজয়ী হন। চার বছর পর আবার তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মেয়র পদে প্রার্থী হন।

গত বছর দ্বিতীয় মেয়াদে টাওয়ার হ্যামলেটসে মেয়র পদে ভোটে জয়ী লুৎফরের বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ। উগ্র ইসলামী গোষ্ঠীকে মদদ দেওয়ার পাশাপাশি লন্ডনে থাকা একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে।

লুৎফুরকে ভোট না দিলে তা ‘ইসলামবিরোধী’ হবে বলে ২০১৪ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে প্রচার চালানোর অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে, সেই সঙ্গে নির্বাচনে প্রভাব খাটানোর অভিযোগও ওঠে।

চার ভোটারের ওই অভিযোগ তদন্তের পর রয়েল কোর্টস অফ জাস্টিসে সেই অভিযোগের বিষয়ে ১০ সপ্তাহ শুনানির পর বৃহস্পতিবার রায় হয়।

রায়ে ওই নির্বাচন বাতিলের আদেশ দিয়ে নির্বাচন কমিশনার রিচার্ড মওরি বলেন, নির্বাচনী প্রচারে ‘ধর্ম’ ও ‘বর্ণবাদ’কে কাজে লাগিয়েছেন লুৎফুর রহমান। নির্বাচনের পুরো সময়জুড়ে ‘রেইস ও ইসলামফোবিয়া কার্ড’ খেলেছেন তিনি।

“নিঃসন্দেহে তিনি দুর্নীতি ও অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন।”

ভোটের দিন লুৎফুর রহমানের সমর্থকদের আচরণ নিয়েও আদালতের উত্থাপিত তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে তাকে ‘উদ্বেগজনক’ বলে মন্তব্য করেছেন বিচারক।

“বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণের মানুষের সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা জনগোষ্ঠী থেকে এট আসেনি। কোনো সামাজিক বা অন্য কোনো বঞ্চনা থেকেও এটা হওয়ার নয়। কোনো একজন ব্যক্তির ভয়ানক লালসার ফল এটা। এই ঘটনায় প্রকৃত অর্থে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তারা টাওয়ার হ্যামলেটসের জনগণ।”

এক ব্রিটিশ আইনজীবী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেনে সবচেয়ে বেশি সময় নিয়ে এই মামলার বিচার কাজ চলেছে।”

তিনি বলেন, যুক্তরাজ্যের সব প্রধান রাজনৈতিক দল লুৎফুরের বিরুদ্ধে এক হয়েছে।

“সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলো, একটি উগ্রপন্থী ইসলামী গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতা ও অর্থায়নে তার রাজনৈতিক গ্রুপ গড়ে উঠেছে এবং নির্বাচনী প্রচারে নির্লজ্জভাবে ‘বর্ণ ও ধর্মীয় কার্ড’ ব্যবহার করা হয়েছে।”

লুৎফুর রহমান

রায়ের প্রতিক্রিয়ায় লন্ডনের মেয়র বরিস জনসন বলেন, “আমি খুব আনন্দিত যে, ন্যায়বিচার হয়েছে এবং টাওয়ার হ্যামলেটস থেকে কালো মেঘ কেটে গেছে।

“সামনের নির্বাচন নিয়ে এগিয়ে যাওয়া এবং এমনটি যাতে আর না ঘটে সে বিষয়টি নিশ্চিত করা এখন আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।”

এর আগে লুৎফুরের ক্ষমতা খর্ব করে কাউন্সিলের অনুদানের অর্থ বরাদ্দ ও রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি বিক্রয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা তার কাছ থেকে নিয়ে নিয়েছিল সরকার।

গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লুৎফুরকে অবিলম্বে আড়াই লাখ পাউন্ড পরিশোধ করতে বলা হলেও তার জরিমানার অঙ্ক ১০ লাখ পাউন্ড হতে পারে।

আদালতে শুনানিতে লুৎফুর ‘মিথ্যাচার’ করেছেন বলে বিচারকের মন্তব্য আসায় তার আইন পেশার ওপরও নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে বলে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

শুরু থেকে সব অভিযোগ অস্বীকার করে আসা লুৎফুরের পক্ষ থেকে এই রায়ে হতাশা প্রকাশ করে বলা হয়েছে, তারা এই রায় পুনর্বিবেচনার জন্য আইনি উদ্যোগ নেবেন।

লুৎফুরের পক্ষে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “আজকে যে রায় এসেছে তা অত্যন্ত দুঃখজনক। মেয়র কোনো ধরনের অনিয়মের কথা নাকচ করেছেন এবং বিচারিক ব্যবস্থার উপর তার পূর্ণ আস্থা আছে। তাই বলতে গেলে এই রায় বিস্ময়কর।”

আদালতের রায় চ্যালেঞ্জ করলেও নতুন মেয়র নির্বাচন ঠেকাতে পারবেন না লুৎফুর। আগামী জুনের মাঝামাঝিই আবার ভোট হতে পারে গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। ওই নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না লুৎফুর।

রয়েল কোর্টস অফ জাস্টিসের বাইরে জন বিগস বলেন, এই রায়ের মধ্য দিয়ে ‘সৎ রাজনীতি’র জয় হয়েছে।

লেবার পার্টির এই নেতাকে হারিয়ে গত বছর মেয়র পুনর্নির্বাচিত হয়েছিলেন লুৎফুর।

প্রথম দফা ভোটে লুৎফুর রহমান পেয়েছিলেন ৪৩ শতাংশ ভোট। তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিগস পান ৩৩ শতাংশ ভোট।

কেউ ৫০ শতাংশ ভোট না পাওয়ায় দ্বিতীয় দফা ভোটে বিগসের ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশের বিপরীতে ৫২ দশমিক ৭ শতাংশ ভোট পেলে বিজয়ী ঘোষণা করা হয় লুৎফুরকে।

লুৎফুরের পাশাপাশি নির্বাচনী আইন ভঙ্গের দোষী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন তার সহযোগী আলিবর চৌধুরীও। আদালতের রায়ে তিনিও কাউন্সিলর পদ হারিয়েছেন।

লুৎফুর রহমানের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ করার সাহস দেখানোর জন্য চার আবেদনকারীর প্রশংসা করেছেন বিচারক।

এবার লুৎফুর রহমানের বিরুদ্ধে ফৌজদারি তদন্ত শুরুর আহ্বান জানিয়েছেন তারা। তবে লুৎফুরের সঙ্গে ‘সম্পর্ক’ থাকায় স্থানীয় পুলিশ দিয়ে তা না করানোর পক্ষে তারা।

আজমল হুসেইন নামে আবেদনকারীদের একজন বলেন, মামলায় হারলে ব্রিক লেনের ব্যবসা হারানোর ভয় ছিল তার।

এ রায়কে ‘বর্ণবাদী’ হিসেবে দেখার শঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে তিনি বলেন, “যারা সত্যিকার অর্থে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তারা সব বর্ণ ও গোষ্ঠীর সাধারণ মানুষ। তারা দুর্নীতি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। কারণ এমন একজন এসব দুর্নীতি করেছেন যিনি বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়ছেন বলে দাবি করতেন।”

আদালতে শুনানিকালে একজন হস্তলিপি বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে আসা তথ্য-প্রমাণ তুলে ধরা হয়, যাতে কোনো এক ব্যক্তিই কয়েকশ ব্যালট পেপার পূরণ করেছেন বলে অভিযোগের পক্ষে মত দেওয়া হয়।

প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী লেবার পার্টির জন বিগসের চরিত্র সম্পর্কে ভুয়া বিবৃতি তৈরির অভিযোগও রয়েছে লুৎফুর রহমানের বিরুদ্ধে।

“কোনো বিবেকবান মানুষই জনাব বিগসকে বর্ণবাদী বলবেন না-এটা ছিল বেপরোয়া ও অসৎ প্রচারণা। লুৎফুর রহমান ও আলীবর চৌধুরী ব্যক্তিগতভাবে এর জন্য দায়ী,” বলেন বিচারক।

অভিযোগকারী আজমল হুসাইন, অ্যাঞ্জেলা মুফাত ও অ্যান্ডি এরলাম

রায়ে বলা হয়, উনিশ শতকের পর লুৎফুর রহমানই প্রথম ব্যক্তি হিসেবে যুক্তরাজ্যে ভোটে অবৈধভাবে ধর্মের ব্যবহারের অপকর্ম করেছেন।

লুৎফুরের নির্বাচনী প্রচারে স্থানীয় মুসিলম ভোটারদের বলা হয়, “তাকে ভোট দেওয়া ইসলামী দায়িত্ব।”

আদালতে বলা হয়, সাপ্তাহিক দেশ নামের একটি বাংলা পত্রিকায় ১০১ জন ইসলাম ধর্মীয় নেতার স্বাক্ষরিত একটি চিঠি প্রকাশ করা হয়, যাতে লুৎফুরকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়।

টাওয়ার হ্যামলেটসে অনুদান বরাদ্দের তদন্তে ঘুষ লেনদেনের বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে বলেও বিচারক উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন, “অনুদান বরাদ্দের ক্ষেত্রে জনাব রহমান কাউন্সিল কর্মকর্তা ও এর সদস্যদের মতামত এবং আইনের পুরো বিপরীতে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিতেন।”

অনিয়মের মাধ্যমে নিজের সমর্থকদের সুবিধা দেওয়ার পাশাপাশি নিজের নির্বাচনী প্রচারে লুৎফর কাউন্সিলের অর্থ ব্যয় করেন বলে যুক্তরাজ্যের খ্যাতনামা হিসাব নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান প্রাইস ওয়াটারহাউজ কুপারসের নিরীক্ষায় উঠে আসে।

গত নভেম্বরে ওই নিরীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশের পর মেয়র লুৎফুর রহমানের ক্ষমতা খর্ব করে কাউন্সিলের অনুদানের অর্থ বরাদ্দ ও রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি বিক্রয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা কেড়ে নেয় সরকার।

ভোটে জিততে ঘুষ প্রদান এবং ভোট কেন্দ্রের ভিতরে ভোটারেদের ভয় দেখানোর বিষয়গুলো আদালতে উঠে আসে।

আবেদনকারীদের একজন আদালতে বলেন, তিনি একটি ভোটকেন্দ্রের বাইরে একজন ভোটারকে কাঁদতে দেখেন, যাকে বলা হয়েছিল লুৎফুর রহমানকে ভোট না দিলে তা ‘অনৈসলামিক’ হবে এবং ‘আপনি যদি তাকে ভোট না দেন তাহলে আপনি ভালো মুসলিম নন’।

গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, লুৎফুর রহমানের অনিয়ম সম্পর্কে আইনজীবীদের নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষকে (সলিসিটরস রেগুলেটরি অথরিটি) অবগত করবেন বিচারক। তাতে তার আইন পেশার ওপর নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে।

২০০৮ সালে ‘জার্নালিস্ট অব দ্য ইয়ার’ পুরস্কারে ভূষিত এন্ড্রু গিলিগান গত বছর তার এক লেখায় লুৎফুর রহমানের বিরুদ্ধে উগ্রপন্থী গোষ্ঠী ‘ইসলামী ফোরাম অব ইউরোপ’র সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তোলেন। উগ্রপন্থী এই সংগঠনটি ব্রিটেনে ‘ইসলামী সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা’ চালু করতে চায়।

লুৎফুরের সঙ্গে উগ্রবাদী গোষ্ঠীর সম্পর্ক  নিয়ে সে সময় সরব হয়েছিলেন টাওয়ার হ্যামলেটসের অনেক প্রবাসী বাংলাদেশি। এতে তাদের কম্যুনিটির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছিলেন তারা।

তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, লুৎফুরের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে লন্ডনভিত্তিক জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের, যারা চৌধুরী মুঈনুদ্দিনের মতো দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীকে বাঁচানোর চেষ্টায় আছেন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্ত সাবেক এই আল-বদর কমান্ডার তাকে দেশে ফিরিয়ে বিচারের মুখোমুখি করতে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগকে পাত্তা দেননি।

পূর্ব লন্ডনের এক প্রবাসী বাংলাদেশি পেশাজীবী সে সময় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন,“লুৎফুর রহমানের রাজনীতির সঙ্গে মৌলবাদী ও স্থানীয় পাকিস্তানিদের সম্পর্ক আছে, যা যুক্তরাজ্য প্রবাসী বাংলাদেশিদের উপর বদনাম ছড়াচ্ছে। ১৯৭১ সালের আগে-পরে অনেক ভোগান্তির শিকার, আমরা বাঙালিরা এইসব পাকিস্তানিদের সাথে থাকাকে ঘৃণা করি।”

তবে সম্ভাব্য প্রতিশোধের আশঙ্কায় তিনি নিজের নাম প্রকাশ করতে চাননি।

তিনি বলেন, লুৎফুর মোল্লাদের সমর্থনপুষ্ট, যারা হোয়াইট চ্যাপেল রোডে পূর্ব লন্ডন মসজিদে চরমপন্থীদের জন্য আস্তানা তৈরি করেছে।