জাদুঘরে রূপান্তরিত ঢাকার এই নবাববাড়ির মূল কাঠামোর পরিবর্তন ঘটিয়ে এই লিফট স্থাপনের ক্ষেত্রে পুরাকীর্তি সংরক্ষণের বিষয়টি উপেক্ষিত হয়েছে, তা এর তত্ত্বাবধানকারী জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষের বক্তব্যে স্পষ্ট।
জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জিজ্ঞাসায় বলেন, “ঐতিহ্য ধ্বংস হচ্ছে কি না, তা বিশেষজ্ঞরা বলতে পারবেন। আমরা সরকারি চাকরি করি, সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করি মাত্র।”
তিনি বলেন, জাদুঘরের দ্বিতীয় তলায় প্রতিবন্ধীদের ওঠার সুবিধার জন্য এই লিফটটি লাগানো হয়েছে।
এই লিফট স্থাপন ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাবিষয়ক আইনের লঙ্ঘন দাবি করে ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস বাংলাদেশের সভাপতি আবু সাঈদ আহমেদ বলেন, “আমরা কতটুকু মূর্খ এই কাজ সেটা প্রমাণ করে। আমাদের ঐতিহ্যকে সম্মান করার শিক্ষাই নেই।”
বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে ঢাকার নবাব পরিবারের বসবাসের জন্য ১৮৭২ সালে নির্মাণ শেষ করা হয় আহসান মঞ্জিলের।
বহু ঘটনা ও দলিলের সাক্ষী এই ভবনের ঐতিহাসিক ও স্থাপত্য গুরুত্ব বিবেচনা করে সরকার এটি সংরক্ষণের দায়িত্ব প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে ১৯৯২ সালে জাতীয় জাদুঘরের ওপর ন্যস্ত করে। একই সালে ভবনটিকে জাদুঘরে রূপান্তর করে দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হয়।
কয়েকদিন আগে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, আহসান মঞ্জিলের মূল ভবনের বাইরে গা লাগিয়ে একটি লিফট বসানো হয়েছে। ইট রঙের ভবনের মাঝে সাদা রঙের লিফটের বহিঃকাঠামো দেখতে বিসদৃশ ঠেকছে।
বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে প্রথমে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শিরিন আকতারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আহসান মঞ্জিল জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে। অধিদপ্তরের অধীনে নয়।
এরপর কথা হয় জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরীর সঙ্গে। তার কার্যালয়ের কর্মকর্তারাই লিফট বসানোর বিষয়টি তত্ত্বাবধান করছেন।
ফয়জুল লতিফ বলেন, “যারা সিঁড়ি দিয়ে উঠতে পারে না, সেরকম চলশক্তিরহিত প্রতিবন্ধীরা যেন উপরে যেতে পারে, তার সুব্যবস্থায় এই লিফট লাগানো হচ্ছে।”
বাংলাদেশের আইনে স্পষ্টভাবে ঐতিহ্যবাহী ভবন বা স্থাপনা সংস্কারে বিভিন্ন নিয়ম-নীতি পালনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আইন অমান্য করলে জেল ও জরিমানার বিধানও রয়েছে।
ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮ এর ২০ নম্বর, ৩৯ নম্বর এবং ৬১ (চ), (ছ) ধারায় বলা হয়েছে, ঐতিহ্যবাহী ভবন সংরক্ষণ করতে হবে। এছাড়া এর কোনো সংস্কার করতে হলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি লাগবে।
ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস বাংলাদেশের সভাপতি প্রকৌশলী সাঈদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটি সম্পূর্ণভাবে ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা বিষয়ক আইনের লঙ্ঘন। নান্দনিক মূল্য নষ্ট করে এ ধরনের সংস্কারের নজির পৃথিবীর কোথাও নেই।
“পুরনো সভ্যতাকে সংরক্ষণ করে ভবিষ্যতের হাতে তুলে দেওয়ার যে উদ্দেশ্য, তা এভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এ কাজ করে আহসান মঞ্জিলের স্থাপত্য মূল্য ও নান্দনিকতা নষ্ট করা হয়েছে।”
এই লিফট স্থাপনের খবরে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক মুনতাসির মামুন, ৪০০ বছরের নগরী ঢাকা নিয়ে গবেষণা করছেন যিনি।
অধ্যাপক মুনতাসির বলেন, “অন্য দেশে এরকম কিছু করতেই পারত না। প্রতিবন্ধীদের জন্য স্থাপনার ভেতরে কিছু করা যেতে পারে, তবে তাও যথাযথভাবে বিশেষজ্ঞ মত নিয়ে; কোনোভাবেই নান্দনিক সৌন্দর্য নষ্ট করে নয়।”
ফয়জুল লতিফ দাবি করেন, যে লিফটটি স্থাপন করা হয়েছে তাতে আহসান মঞ্জিলের কাঠামোগত ক্ষতির আশঙ্কা নেই।
বিশেষজ্ঞদের মতের প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, সরকার চাইলে যে কোনো সময় লিফটটি অপসারণ করা সম্ভব।
তবে সার্বিক বিষয়ে হতাশা প্রকাশ করে অধ্যাপক মুনতাসির বলেন, “আইনে আছে, কিন্তু কিছুই মানা হয় না। সরকারের মন্ত্রীদের নান্দনিকতা রক্ষা নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গী নেই, আমলারা কারও কথা মানে না, বাধা দেওয়ারও কেউ নেই। এভাবেই চলবে…।”