যৌন নিপীড়ন: পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ভূমিকায় ‘ধিক্কার’

পয়লা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নারীদের যৌন হয়রানির ঘটনায় পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ভূমিকার নিন্দা জানিয়ে অবিলম্বে নিপীড়কদের গ্রেপ্তারের দাবি এসেছে এক প্রতিবাদ কর্মসূচি থেকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 April 2015, 05:49 PM
Updated : 17 April 2015, 06:34 PM

শুক্রবার টিএসসি মোড়ের সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ছাত্র ইউনিয়ন এই ‘ছাত্র-শিক্ষক-জনতা সংহতি সমাবেশ’ এর আয়োজন করে।

সমাবেশে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি ও প্রবীণ সাংবাদিক কামাল লোহানী বলেন, “যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাঙালির সকল আন্দোলনের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করেছিল, সব আন্দোলনে নায়কের ভূমিকায় ছিল যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা, সেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে নারীদের ওপর পাশবিক ও নারকীয় নির্যাতনের প্রতিবাদ জানাতে লজ্জা হচ্ছে।

“যে বিশ্ববিদ্যালয়ে এতো আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছিল, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন কোনো প্রতিবাদ হচ্ছে না কেন? এই ধরনের ঘটনায় তো এখানকার ছাত্র-শিক্ষকদেরই তুমুল প্রতিবাদে এগিয়ে আসার কথা ছিল।”

যৌন নিপীড়নকারীদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ‘আশ্চর্যজনক’ নীরবতার নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষক এখনো ঘটনার প্রতিবাদ করছেন না, তাদের অবস্থানও ধিক্কারজনক।”

বর্ষবরণের দিন মঙ্গলবার সন্ধ্যায় টিএসসিসংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ফটকে ভিড়ের মধ্যে এক দল যুবক নারীদের ওপর চড়াও হয়। তাতে বাধা দিতে গিয়ে আহত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি লিটন নন্দীসহ কয়েকজন।

অভিযোগ উঠেছে, সেদিন পুলিশ থাকলেও নারীদের ওপর হামলা ঠেকাতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও পুলিশের দায়িত্বহীনতাকে দায়ী করেছে।

সমাবেশে কামাল লোহানী বলেন, “টিএসসি প্রাঙ্গণে সবসময় পুলিশ থাকে। অথচ এখানে কিছুদিন আগে খুন হয়েছে অভিজিৎ রায়। এবার আমরা দেখলাম একদিকে নারীদের ওপর নারকীয় নির্যাতন চালানো হচ্ছে, অন্যদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে পুলিশ সদস্যরা এবং দাবা খেলছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর।

“এখন প্রক্টর বিভিন্ন রকম মিথ্যাচার করছেন আর পুলিশ বলছে বিচ্ছিন্ন ঘটনা। যারা নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত তারা কি পুলিশের কাছে পরিকল্পনা ও ম্যাপ জমা দিয়ে ঘটনা সংঘটন করবে?”

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক আনু মুহম্মদ বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের অবস্থান ও তাদের যে বক্তব্য, তাতে আমরা তাদেরকে যৌন নিপীড়নকারীদের সহযোগী হিসাবে দেখতে পাচ্ছি।”

“আমরা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও প্রক্টর নিপীড়নকারীদের রক্ষা করার চেষ্টা করছে। নিপীড়নকারীদের রক্ষা করার ইচ্ছা যদি তার থাকে তাহলে কম্পিউটারে বসে দাবা খেলা তো তার দায়িত্বের মধ্যে পড়বে।”

উইমেন চ্যাপ্টারের সম্পাদক সুপ্রীতি ধর বলেন, ‘আমি সাংবাদিকতা করি, বক্তব্য দেই না। কিন্তু গত কয়েকদিনের ঘটনায় আমরা নারীরা অনেক ক্ষুব্ধ হয়েছি। এখন আর চুপ করে থাকার সময় নেই। কারণ চুপ থাকলে আঘাত আসতেই থাকবে।”

বিপ্লবী নারী সংহতির সমন্বয়ক শ্যামলী শীল বলেন, ‘‘পুলিশের বক্তব্য ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অবস্থান দেখে মনে হচ্ছে, রাষ্ট্র এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছে গেছে হাজারো পুলিশ দিয়ে এবং হাজারো সিসিটিভি ক্যামেরা দিয়ে এই ধরনের পাশবিক নিপীড়ন বন্ধ করা সম্ভব নয়।”

ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হাসান তারেকের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক লাকী আক্তারের পরিচালনায় সমাবেশে অন্যান্যের মধ্যে সংহতি জানান সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সিপিবির নারী সেলের আহ্বায়ক লক্ষ্মী রানী চক্রবর্তী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন, অধ্যাপক কাবেরী গায়েন ও ফাহমিদুল হক ও মাসিক শিক্ষাবার্তার সম্পাদক অধ্যাপক এএন রাশেদা ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র প্রার্থী কাফি রতন।

সমাবেশে যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঠেকাতে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর আমজাদ আলীর অপসারণসহ সাত দফা দাবি জানিয়েছে ছাত্র ইউনিয়ন।

এগুলোর মধ্যে রয়েছে - সংগঠিত যৌন নিপীড়নকারীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার ও বিচার, কর্তব্যরত পুলিশের ধারাবাহিক অবহেলার নির্মোহ তদন্ত ও বিচার, বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক কার্যকর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের হাইকোর্ট নির্দেশিত যৌন নিপীড়ন বিরোধী নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা, বাসস্থল-শিক্ষাঙ্গন-কর্মস্থলে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে জাতীয়ভাবে যৌন নিপীড়নবিরোধী নীতিমালা প্রণয়ন ও উচ্চশব্দ সৃষ্টি করে বিভিন্ন উৎসবে সমস্যা সৃষ্টিকারী ‘ভুভুজেলা’ নিষিদ্ধ করা।

এই দাবি আদায়ের লক্ষ্যে কর্মসূচি ঘোষণা করেন ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি হাসান তারেক, যার মধ্যে রয়েছে শনিবার দুপুর ২টায় মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলন, রোববার সারাদেশে বিক্ষোভ ও সংহতি সমাবেশ, ২০ এপ্রিল সকাল ১১টায় অপরাজেয় বাংলার পাদদেশ থেকে কার্জন হল পর্যন্ত মানববন্ধন এবং ২১ এপ্রিল সকাল ১১টায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি পেশ।

এদিকে বিকেলে টিএসসি চত্বরে সমাবেশ থেকে পহেলা বৈশাখে নিপীড়নের ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তারের জন্য চার দিনের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট।

সমাবেশে জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, “আগামী ২১ তারিখের মধ্যে নিপীড়নের ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার দেখতে চাই। আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উৎসবকে নষ্ট করার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের অবস্থান দেখতে চাই।”

সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন জোটের সাবেক সভাপতি নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার ও জোটের সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ।