সহিংসতায় ক্ষতি ১৭ হাজার কোটি টাকা: বিশ্ব ব্যাংক

বছরের শুরুতেই তিন মাসের রাজনৈতিক সহিংসতায় ১৭ হাজার ১৫০ কোটি টাকার (২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার) ক্ষতির তথ্য দিয়ে চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের নিচে নেমে আসার পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্ব ব্যাংক।

প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 April 2015, 07:06 AM
Updated : 12 April 2015, 11:34 AM

উৎপাদন খাতের এই আর্থিক ক্ষতির মধ্যে সেবা খাতের ক্ষতির পরিমাণই ৬৮ শতাংশ। এছাড়া ২৫ শতাংশ শিল্প খাতে এবং ৭ শতাংশ কৃষি খাতের ক্ষতি বলে বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।

রোববার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে সংবাদ সম্মেলন করে ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ শীর্ষক এ প্রতিবেদনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন।

তিনি বলেন, সহিংসতায় আর্থিক ক্ষতির এই পরিমাণ মোট জাতীয় উৎপাদনের (জিডিপি) এক শতাংশ।

“যদি রাজনৈতিক অস্থিরতা না থাকত তাহলে চলতি ১০১৪-১৫ অর্থবছরে ৬ দশমিক ৪ থেকে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হত। যেহেতু এক শতাংশ ক্ষতি হয়ে গেছে, সেহেতু আমাদের হিসাবে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে।”

জাহিদ হোসেন বলেন, গত ৫ জানুয়ারি সারা দেশে অবরোধ শুরু হয়; পরে হরতাল। টানা তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে চলে অবরোধ-হরতাল।

“তবে শেষ দিকে এসে এর ধার কমে গিয়েছিল। সে কারণে আমরা ৬০ দিনের উৎপাদনের ক্ষতির হিসাব করে এই তথ্য দিয়েছি।”

কোন পদ্ধতিতে ক্ষতির এই হিসাব করা হয়েছে- এমন প্রশ্নে জাহিদ হোসেন বলেন, “এই ৬০ দিনে উৎপাদনশীল খাতে দৈনিক যে ক্ষতি হয়েছে তার ভিত্তিতে হিসাব করা হয়েছে। ২০১৩ সালে যে অস্থিরতা-সংঘাত হয়েছিল তার হিসাবও একইভাবে করা হয়েছিল।”

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, গত ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে ৬ দশমিক ১২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। আর বিশ্ব ব্যাংক ৫ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছিল।

গত অর্থবছরে বিশ্ব ব্যাংকের পূর্বাভাসের চেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন প্রসঙ্গে জাহিদ হোসেন বলেন, “বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে অন্তর্নিহিত শক্তি আছে। সেই শক্তি দিয়ে নানা বাধা-বিপত্তির মধ্যে তারা অর্থনীতিতে অবদান রেখে চলেন।

“তাছাড়া বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, যে বছর রাজনৈতিক অস্থিরতা হয়েছে তার পরের বছরই ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ২০১৩ সালের প্রথম দিকের সহিংসতার পর ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৬ দশমিক ১২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি সেটাই প্রমাণ করে।”

একই কারণে নতুন করে অস্থিরতা তৈরি না হলে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতে পারে বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। 

এরপর ২০১৬-১৭ অর্থ বছর শেষে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ  প্রবৃদ্ধি হতে পারে পূর্বাভাস দিয়ে বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, “এজন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পাশপাশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে।”

জিডিপি হচ্ছে মোট দেশজ উৎপাদন, অর্থ্যাৎ দেশের অভ্যন্তরে যে পরিমাণ পণ্য ও সেবার উৎপাদন হয়, তার যোগফল।

গত ২০১৩-১৪ অর্থবছরের জিডিপির আকার ছিল চলতি মূল্যে ১৩ লাখ ৫০ হাজার ৯২০ কোটি টাকা। এ থেকে চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধির আশা করছে সরকার।

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমার বিষয়টিকে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য ‘সুখবর’ অভিহিত করে জাহিদ বলেন, “শুধু তেল নয়; সার, খাদ্যপণের দামও কম। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সব কিছুই বাংলাদেশের অনুকূলে। বাজেটে সরকারের ভর্তুকি খাতে খরচ অনেক কম হবে।”

বিশ্ব ব্যাংকের এই অর্থনীতিবিদ বলেন, তেলের দাম কমায় অতীতের পুঞ্জিভূত ক্ষতি থেকে লাভের মুখ দেখতে শুরু করেছে বাংলাদেশের জ্বালানি তেল বিপণন ও সরবরাহকারী সংস্থা বিপিসি। গত বছরের অক্টোবর থেকে লাভ করছে সংস্থটি। কেবল পেট্রোল-অকটেনে নয়, ডিজেল-কেরোসিনেও লাখ করছে বিপিসি।

বর্তমানে বাজেট ঘাটতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই (৫ শতাংশ) আছে বলে মনে করছেন জাহিদ হোসেন।

বাংলাদেশের অর্থনীতির চালচিত্র বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, গড় মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৬ দশমিক ৭ শতাংশে নেমে এসেছে। খাদ্য ও খাদ্য বহির্ভূত দুই ধরনের মূল্যস্ফীতিই সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে।

তবে চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাব ভারসাম্যে (ব্যালান্স অফ পেমেন্ট) ১০৯ কোটি ডলারের ঘাটতি (ঋণাত্মক) রয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে যা ১৮০ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত ছিল। এছাড়া বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ৬৪০ কোটি ডলারে উঠেছে।

“অর্থনীতির সূচকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় রয়েছে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ। বর্তমানে রিজার্ভে আছে ২৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এটা দিয়ে ছয় মাসের বেশি সময়ের আমদানি দায় মেটানো সম্ভব।”

জুলাই-মার্চ সময়ে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় বেড়েছে ৩ শতাংশ। বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়া না হলেও সঞ্চয়পত্র থেকে অনেক বেশি ঋণ নেওয়ায় ভবিষ্যতে সরকারের ঋণের বোঝা বেড়ে যাবে বলে মন্তব্য করেন জাহিদ হোসেন।

চলতি বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে নয় হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিল সরকার। কিন্তু বিক্রি বাড়ায় আট মাসেই (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) লক্ষ্যমাত্রার দ্বিগুণের বেশি, প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ হয়ে গেছে সরকারের।

বিশ্ব ব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি ইয়োহানেস জাট সংবাদ সম্মেলনে স্বাগত বক্তব্য দেন।