বরগুনার জেলা প্রশাসক মীর জহুরুল ইসলাম বলেছেন, বিতাড়িত হিন্দুদের আবার বাড়ি-ঘরে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
“দরকার হলে প্রশাসনের টাকায় আবার তাদের ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হবে,” একথাও বলেছেন জেলা প্রশাসক।
তবে আতঙ্ক পিছু ছাড়ছে না উৎখাত হওয়া হিন্দু পরিবারগুলোর। তারা বলছেন, যথন উৎখাত করা হয়েছিল, তখন বিভিন্ন পর্যায়ে অভিযোগ করা হলেও কোনো প্রতিকার পাননি তারা।
বরগুনার তালতলী উপজেলার পঞ্চাকোড়ালিয়া ইউনিয়নের চন্দনতলা (মগপাড়া হিসেবে পরিচিত) গ্রাম থেকে ২০১৩ সাল থেকে হিন্দুদের উৎখাতের প্রক্রিয়া শুরু হলেও বিষয়টি আলোচনায় আসে গত সপ্তাহে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নির্যাতনের মুখে ২০১৩ সালের শুরুর দিকে প্রথমে তিনটি পরিবার গ্রাম ছেড়ে বরগুনা শহরে আশ্রয় নেয়। ২০১৪ সালের শুরুর দিকে চলে আসে আরও দুটি পরিবার। সবশেষ ১৩ মার্চ নয়টি পরিবার একযোগে ভিটেমাটি ছেড়ে আসে।
হিন্দু পরিবারগুলো উৎখাত করে তাদের জমি দখলের অপচেষ্টার এই অভিযোগ উঠেছে বিএনপি এবং যুবলীগের স্থানীয় দুই নেতা আব্দুর রশীদ আকন (৪২) এবং জাকির হোসেন সরকারের (৪০) বিরুদ্ধে।
নীরবে হিন্দুদের এলাকা ছাড়ার খবরটি প্রকাশ হওয়ার পর আলোচনার ঝড় ওঠে। এরপর প্রশাসনের আশ্বাস পেয়ে ২৩ মার্চ ক্ষতিগ্রস্ত যাদব সরকার বাদী হয়ে রশিদকে প্রধান আসামি করে অজ্ঞাত পরিচয়ের আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন।
মামলার পর ওই দিনই রশিদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে তালতলী থানার ওসি মো. বাবুল আখতার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন।
“গ্রেপ্তার আসামিকে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। মামলাটি গভীরভাবে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।”
রশিদ এলাকায় ‘রশিদ ডাকাত’ নামে পরিচিত। ডাকাতি ও নারী নির্যাতন মামলার একাধিকবার কারাগারে যেতে হয়েছে তাকে। জাকিরের বাড়ি ওই এলাকায় হলেও থাকেন বরগুনা শহরে। জাকির যুবলীগে যুক্ত বলে সংগঠনের বরগুনা জেলা সভাপতি কামরুল আহসান মহারাজ স্বীকার করলেও তিনি বলেন, কোনো কমিটিতে তিনি নেই।
বরগুনার পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি শোনার পর অনুসন্ধান চালিয়ে ঘটনার সত্যতা পেয়ে পদক্ষেপ নেন তিনি। এর পেছনে প্রভাবশালী চক্র আছে বলেও তিনি ধারণা করছেন।
“হিন্দু পরিবারগুলোকে তাদের নিজ ভিটায় স্থায়ী করতে যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
বরগুনা জেলা কমিউনিটি পুলিশের সাধারণ সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা সুখরঞ্জন শীল জানিয়েছেন, হিন্দু পরিবারগুলোর বিচারের দাবি পূরণসহ তাদের বাপ-দাদার ভিটায় পুনরায় বসবাস করাতে সম্মিলিতভাবে সর্বাত্মক চেষ্টা করা হচ্ছে।
মগপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, হিন্দু পরিবারগুলোর ছেড়ে যাওয়া ভিটা শূন্য পড়ে আছে। একই সারিতে আটটি ঘরের চিহ্ন থাকলেও ঘর নেই, পূজার ফুলের গাছগুলো অবহেলায় পড়ে আছে।
ভিটে ছেড়ে চলে যাওয়া পরিবারগুলোর মধ্যে রয়েছে কার্তিক রায় (৬০), হরেন রায় (৫৫), যাদব সরকার (৪২), মাধব সরকার (৪৫), ধীরেন সরকার (৭৫), সুভাষ সরকার (৪৪), রমেশ সরকার (৩২), রিপন রায় (৪০), নীলা রানী (৫০), রনজিৎ সরকার (৬০), শ্যামল (৪১), সুমন্ত (৪২), বাবুল (৩৫) ও জিতেন রায়ের (৬৫) পরিবার।
তারা সবাই বলছেন, ওই গ্রামে বসবাস করার মতো অবস্থা আর তাদের নেই। দীর্ঘদিন ধরে নির্যাতিত হয়ে আসছিলেন তারা। তাদের উঠতি বয়সী মেয়েরা যৌন হয়রানির শিকারও হয়েছেন নিয়মিত।
রশিদের বিরুদ্ধে এর আগে নারী-শিশু নির্যাতন আইনে মামলা করলেও জাকির সরদারের চাপে তা তুলে নিতে হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তারা।
একজন বলেন, “রাতের আঁধারে চলত রামদার মহড়া। ঘুমের মধ্যে বাঁশের লাঠি দিয়ে খোঁচানো হত, কবে তোরা বাড়ি ছেড়ে যাবি।আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে বলেছিলাম, তারাও আমাদের নিরাপত্তা দিতে পারেনি।”
কোথাও কোনো ভরসা না পেয়ে প্রাণ বাঁচাতে ঘর বিক্রি করে চলে এসেছেন বলে জানান তারা।
মামলাকারী যাদব সরকার বলেন, “রশিদের রক্তচক্ষুর ভয় উপেক্ষা করে স্থানীয়ভাবে বিচার চেয়েও না পেয়ে অবশেষে বাধ্য হয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা দায়ের করেছিলাম। মামলায় রশিদ জেলও খেটেছে। জেল থেকে ফিরে সে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।
“পরে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সমন্বয়ে বিচারের আশ্বাসে মামলা তুলে নেওয়া হয়। কিন্তু বিচার পাওয়া তো দূরের কথা, জেল থেকে ছাড়া পেয়ে রশিদ হিন্দু পরিবারগুলোর ওপর বিভিন্নভাবে অত্যাচার শুরু করে।”
পঞ্চাকোড়ালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নজির হোসেন কালু পাটোয়ারী বলেন, রশিদের বিভিন্ন অন্যায় কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে এলাকাবাসী বেশকিছু দিন আগে মানববন্ধন করেছিল। তিনি বেশ কয়েকবার সালিশও করেন, কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি।
হিন্দু পরিবারগুলোর চলে যাওয়ার বিষয়টি কোনোভাবেই মানতে পারছেন না বলেও জানান তিনি।
চন্দনতলা গ্রামের তাসলিমা বেগম (৪০) বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হঠাৎ করেই কাউকে কিছু না বলে তারা (হিন্দু পরিবারগুলো) বাড়ি থেকে একত্রে বেরিয়ে পড়েন। পরে হাকিম আলী সরদারের ছেলে আ. সালাম, যুবলীগ নেতা জাকির ও ইলিয়াসের নেতৃত্বে হিন্দুদের ঘরগুলো একদল লোক এসে ভেঙে নিয়ে যায়। হিন্দুরা বাধ্য হয়ে তাদের কাছে কম মূল্যে বাড়িগুলো বিক্রি করে দেয়।”
আনোয়ারা বেগম (৬৫) নামে আরেক বৃদ্ধা বলেন, “ভয়ে কেউ মুখ খুলতে পারছে না।”
তবে যুবলীগ নেতা জাকির তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রশিদের কোনো দোষ নেই। হিন্দুরা ইচ্ছা করেই এলাকা থেকে ঘরগুলো বিক্রি করে চলে গেছে।”
তবে ওই গ্রামের আব্দুর রশিদ মাস্টারের কথায় ফুটে ওঠে গ্রামবাসীর কথা।
“সবকিছু তো প্রকাশ করা যাবে না। তবে পরিবারগুলো বড় কষ্ট নিয়ে সব ফেলে চলে গেছে।”