নারায়ণগঞ্জ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. জাকারিয়া জানান, নিহতদের মধ্যে সাত জন নারী ও তিনজন পুরুষ; তাদের বেশিরভাগের বয়স পঞ্চাশের বেশি।
পুণ্যার্থীদের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন। নিহতদের সৎকারের জন্য প্রত্যেকের পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, পুণ্যার্থীদের ভিড়ের মধ্যে একটি বেইলি সেতু ভেঙে পড়ার গুজব ছড়িয়ে পড়লে অপ্রশস্ত রাস্তায় হুড়োহুড়িতে পদদলনের ঘটনা ঘটে। হতাহতের জন্য অব্যবস্থাপনাকেও দায়ী করেছেন কেউ কেউ।
ঘটনা তদন্তে স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ পরিচালক ইশরাত হোসেন খানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি কমিটি করেছে জেলা প্রশাসন। কমিটিকে পাঁচ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
প্রতিবছর চৈত্র মাসের শুক্ল পক্ষের অষ্টম তিথিতে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে এই স্নান উৎসব হয়। ১৫ লাখের বেশি পুণ্যার্থী স্নানের মধ্য দিয়ে পাপ মোচনের লক্ষ্যে ব্রহ্মপুত্র তীরে আসেন।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জানান, শুক্রবার ভোর ৫টা ৪৮ মিনিট ৪৭ সেকেন্ডে লগ্ন মেনে স্নান উৎসব শুরু হওয়ার পর পুণ্যার্থীদের ঢল নামে।
সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ঘাটের ৫০ গজ দূরে একটি বেইলি ব্রিজ ভেঙে পড়ার গুজব ছড়িয়ে পড়লে রাস্তাভর্তি মানুষের মধ্যে হুড়োহুড়ি শুরু হয় বলে জানান স্থানীয় দোকানি শাহাবুদ্দিন।
ঘটনার আরেক প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় ইউপি সদস্য আব্দুল কাদির জানান, এবার সকাল থেকে পুণ্যার্থীদের ঢল ছিল অন্যবারের তুলনায় বেশি। সবচেয়ে বেশি ভিড় ছিল রাজঘাট, অন্নপূর্ণা ও গান্ধী ঘাটে।
“একদিকে রাস্তা সরু, বেইলি সেতু তার চেয়েও সরু। রাজঘাটের সামনে ঢোল বাদ্য বাজিয়ে আসছিল ইসকনের কিছু লোক। উল্টো দিক থেকে স্নান সেরে বাড়ির দিকে ফিরছিলেন অনেকে। এ সময় হঠাৎ হুড়োহুড়ি শুরু হয়। পদদলিত হয়ে মারা যায় মানুষ।”
নিহতরা হলেন- মাদারীপুর সদর উপজেলার চরমুগিয়া সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষক নকুল সাহা (৫০), মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওর উপজেলার জাবরা গ্রামের বলাই দাসের স্ত্রী মালতি দাস (৭০), তার ছেলে নিত্য গোপাল দাস (৫০), ঢাকার জিগাতলার নিতাই চন্দ্র দাসের স্ত্রী ভগবতী দাস (৬০), তার মেয়ে লালবাগের জনি চন্দ্র দাসের স্ত্রী রাহী দাস (২৫), কুমিল্লার দাউদকান্দির পরিমল সাহার স্ত্রী কানন সাহা (৫২), নোয়াখালীর কবিরহাটের অনীল নাথের স্ত্রী ভানুমতি নাথ (৫০), কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার রামচন্দ্রপুর এলাকার কালিপদ নন্দির ছেলে রণজিৎ নন্দি (৫৫), মুরাদনগরের পরিমল দেবনাথের স্ত্রী তুলসী দেবনাথ (৫৫) এবং পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার লোহালিয়া গ্রামের দ্বিজেন্দ্র লাল সেনের স্ত্রী সুচিত্রা সেন (৫০)।
ময়নাতদন্ত ছাড়াই তাদের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে বন্দর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোকাররম হোসেন জানান।
গুজব, অব্যবস্থাপনা
পুণ্যার্থীদের কয়েকজন অভিযোগ করেন, ঘাটের পথে চলাচলে কোনো শৃঙ্খলা ছিল না। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীও ব্যবস্থাপনায় তৎপর ছিল না। ফলে গুজবে আতঙ্কিত মানুষ অপ্রশস্ত রাস্তায় হুড়োহুড়ি শুরু করলে হতাহতের ঘটনা ঘটে।
এছাড়া আহতদের হাসপাতাল-ক্লিনিকে নেওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্স না মেলায় নিহতের সংখ্যা বেড়েছে বলেও অভিযোগ করেন কেউ কেউ।
ঘটনার সময় রাজঘাটে স্নান সেরে বেইলি ব্রিজের দিকে আসছিলেন তিন বোন ছবি রানী, রিনা রানী ও স্বপ্না রানী দাশ।
ছবি ও রিনা জানান, তারা তিন বোন একসঙ্গে হাঁটতে থাকলেও হঠাৎ বুঝতে পারেন স্বপ্না তাদের সঙ্গে নেই। হঠাৎ ব্রিজ ভেঙে পড়ার কথা শোনা যায়; সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকে হুড়োহুড়ি। ব্রিজের দিক থেকে মানুষের ধাক্কা আসতে থাকে।
পরে তিন রাস্তার মোড়ে স্বপ্নাকে পান জানিয়ে ছবি বলেন, দুই থেকে তিন জনের ওপর স্বপ্না পড়েছিল। তার ওপরও কয়েকজন ছিল।
ওই মোড়ের অন্য দুই দোকান ‘সলেমুননেসা ওষুধ ঘর’ ও ‘রনি কনফেকশনারি’র কর্মচারীরাও ব্রিজ ভাঙার গুজবের কথা জানান। তবে ওই গুজবের উৎপত্তি কীভাবে হয়েছে সে বিষয়ে কেউ কোনো তথ্য দিতে পারেননি।
নিহত রাহী দাসের স্বামী জনি দাস জানান, স্নানে শেষে ফেরার পথে স্ত্রীর হাত ধেরে রেখেছিলেন তিনি। প্রচণ্ড ধাক্কাধাক্কি ও হুড়োহুড়ি শুরু হলে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যান।
“রাহী আর আমার শাশুড়ি রাস্তায় পড়ে যায়। হাজার হাজার মানুষের পায়ের নিচে পিষ্ট হয়ে তারা মারা গেল। অনেক চেষ্টা করেও আমি কিছু করতে পারলাম না।”
ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পরও রাজঘাট এলাকায় সড়কের মোড়ে শত শত মানুষের জুতা, নারীদের বিচ্ছিন্ন চুল, শাড়ির ছেঁড়া আচলসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র পড়ে থাকতে দেখা যায়।
শৃঙ্খলায় ঘাটতির অভিযোগ অস্বীকার করে নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মোখলেসুর রহমান বলেন, “এ অভিযোগ ঠিক নয়।”
বন্দর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোকাররম হোসেন বলেন, স্নান শুরু হওয়ার আগে থেকেই সহস্রাধিক পুলিশ সদস্য মোতায়েন আছেন। পদদলনের ঘটনার পর প্রত্যেকটি ঘাটে পুলিশ বাড়ানো হয়েছে।
“পুলিশ সদস্যরা রাস্তার মাঝখানে মানব ঢাল তৈরি করে আসা যাওয়ার শৃঙ্খলা রক্ষা করছেন।”
তিনি বলেন, “কারো দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ সত্য নয়। রাস্তা ও বেইলি ব্রিজটি সরু। সড়কের পাশে অবৈধ স্থাপনার কারণেই এটা ঘটেছে। রাস্তা আরও প্রশস্ত হওয়া প্রয়োজন।”
নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য এ কে এম সেলিম ওসমান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সাংবাদিকদের বলেন, “ঘটনাটি দুঃখজনক। পুণ্যার্থীরা যাতে সুশৃঙ্খল পরিবেশে স্নান সম্পন্ন করতে পারে সেজন্য প্রশাসন ও পুলিশকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।”
জেলা প্রশাসক আনিছুর রহমান মিঞা বলেন, “সব রকম প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। তারপরও সরকারি ছুটির দিনের সাথে পুণ্য তিথি যোগ হওয়ায় অতিরিক্ত ভিড়ে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে।”
পুণ্যার্থীরা অভিযোগ করেছেন, লাঙ্গলবন্দে প্রতিবছর স্নান উৎসব হলেও এবার ব্রহ্মপুত্র নদের কচুরিপানা পরিষ্কার করা হয়নি। গোসলের ঘাটগুলোতে কচুরিপানা আর কাদা ছিল। নারীদের কাপড় বদলানোর পর্যাপ্ত ব্যবস্থাও ছিল না।
এ বিষয়ে বাসু দেব চক্রবর্তী বলেন, “কচুরিপানা পরিস্কার করলেও আবার তা ভরে গেছে। এরইমধ্যে পুণ্যার্থীদের ঢলে আমরা তো মানুষের জীবন নিয়েই চিন্তিত হয়ে গেছি।”
‘হে মহাভাগ ব্রহ্মপুত্র, হে লৌহিত্য তুমি আমার পাপ হরণ কর’- এই মন্ত্র উচ্চারণ করে দূর্বা ঘাস, বেল পাতা, কলা, আম, ডাব ও ফুল দিয়ে পাপ মোচনের বাসনায় ব্রহ্মপুত্র নদে পুণ্যার্থীরা ব্রহ্মার কাছে কৃপা প্রার্থনা করে স্নান করেন। শনিবার ভোর ৬টা ৫৯ মিনিট ৩৮ সেকেন্ডে লগ্ন শেষ হওয়া পর্যন্ত স্নান উৎসব চলবে বলে বাসু দেব জানান।
এই উৎসব উপলক্ষে লাঙ্গলবন্দে তিন দিনব্যাপী মেলারও আয়োজন করা হয়েছে। সেখানে নানা পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন দোকানিরা।