হুমকিতে আতঙ্কে রাবি শিক্ষকরা

টেলিফোনে চাঁদা চেয়ে একের পর এক প্রাণনাশের হুমকির ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 March 2015, 08:06 AM
Updated : 24 March 2015, 01:18 PM

এ পরিস্থিতিতে অনেকেই পেশাগত কাজকর্ম কমিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি চলাফেরাও সীমিত করেছেন। জরুরি প্রয়োজনে ঘর থেকে বেরোতে হলে বিশ্বস্ত কাউকে সঙ্গে নিচ্ছেন কেউ কেউ।

বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনেও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে জানিয়ে উপ-উপাচার্য অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান বলেন, “এভাবে শিক্ষকদের কাছে চাঁদা চাওয়া ও হত্যার হুমকি উদ্বেগের।”

গত বছর অধ্যাপক শফিউল ইসলামকে দিনের বেলায় কুপিয়ে হত্যার পর থেকেই আতঙ্ক ছড়ায় প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার শিক্ষকদের ভিতরে। এখন নতুন করে চাঁদার দাবিতে প্রাণনাশের হুমকিতে মানসিকভাবে ‘বিপর্যস্ত’ হয়ে পড়ার কথা জানিয়েছেন তাদের কয়েকজন।

নিষিদ্ধ ‘পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি’, ‘লাল বাহিনী’সহ বিভিন্ন পরিচয়ে শিক্ষকদের মোবাইলে ফোন করে চাঁদা চাওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তারা। চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে কিংবা বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরে আনলে দেওয়া হচ্ছে প্রাণনাশের হুমকি।    

বিশ্ববিদ্যালয় ও পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত দেড় মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ১০ জন প্রগতিশীল শিক্ষককে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে।

ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক শিক্ষক সমিতির সভাপতি আনন্দ কুমার সাহার মোবাইল ফোনে অজ্ঞাত একটি নম্বর থেকে কল দিয়ে চাঁদা দাবি করেন একজন। নিজেকে তিনি ‘লাল বাহিনী’র সদস্য হিসেবে পরিচয় দেন।

এরপর গত ১০ মার্চ ‘লাল বাহিনী’র পরিচয়ে মুঠোফোনে চাঁদা দাবি করা হয় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক মো. আবুল কাশেমের কাছে। ১৬ মার্চ একই ধরনের হুমকি পান দর্শন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।

সর্বশেষ গত ২১ মার্চ ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান মজুমদার ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক বিধান চন্দ্র দাসকেও এভাবে হুমকি দেওয়া হয়।

অধ্যাপক এ কে এম শফিউল ইসলামের খুনিদের গ্রেপ্তার ও বিচার দাবিতে মঙ্গলবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন

প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক বিধান চন্দ্র দাস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হুমকি পাওয়ায় আমি কিছুটা শঙ্কিত হয়েছি, যার প্রভাব পড়ছে আমার গবেষণা কাজে। এখন খুব সতর্কভাবে চলাফেরা করতে হচ্ছে।”

মৌলবাদীরাই এ ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে বলে মনে করেন অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা।

তিনি বলেন, “মৌলবাদী কোনো গোষ্ঠী প্রগতিশীল শিক্ষকদের মানসিক চাপে রাখতেই অব্যাহতভাবে হুমকি দিচ্ছে।”

একের পর এক হুমকির ঘটনায় হুমকিদাতাদের সনাক্তে পুলিশ প্রশাসনকে তাগাদা দেওয়া হয়েছে বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক তারিকুল হাসান জানিয়েছেন।

“শিক্ষকদের হুমকি দেওয়ার বিষয়টি জেলা প্রশাসক ও পুলিশ প্রশাসনকে জানিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে,” বলেন তিনি।

প্রাণনাশের হুমকির পর সহকারী অধ্যাপক আনিসুজ্জামান মানিক, ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান মজুমদার ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক বিধান চন্দ্র দাসসহ চারজন শিক্ষক নিরাপত্তা চেয়ে থানায় জিডি করেছেন বলে মতিহার থানার ওসি আবদুর রউফ জানিয়েছেন। 

অভিযোগগুলো পুলিশ গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখছে বলে দাবি করেন তিনি।

মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার ইফতেখায়ের আলম বলেন, শিক্ষকদের অভিযোগের ভিত্তিতে একজন হুমকিদাতাকে সনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে।

“দর্শনবিভাগের শিক্ষক আনিসুজ্জামানকে গত ১২ মার্চ ঢাকার মোহাম্মদপুর থেকে ফোন করা হয়েছিল। এছাড়া বাকি শিক্ষকদের মুঠোফোনে কল দেওয়া নম্বরগুলো খতিয়ে দেখে দোষীদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে।”

অধ্যাপক শফিউল ইসলাম

গত বছর ১৫ নভেম্বর বিকালে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস সংলগ্ন শিক্ষকদের আবাসিক এলাকা বিহাস পল্লীতে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শফিউল, যিনি বাউল সাধক লালনের ভক্ত ছিলেন।

তার আগে ২০০৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এস তাহেরকে তার ক্যাম্পাসের বাসায় হত্যা করা হয়। তার লাশ বাসার পাশের ম্যানহোলে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছিল।

ওই হত্যাকাণ্ডের দায়ে অধ্যাপক তাহেরের বিভাগের শিক্ষক মিয়া মো. মহিউদ্দিন, বাসার তত্ত্বাবধায়ক জাহাঙ্গীর আলমের পাশাপাশি আব্দুস সালাম ও নাজমুল নামে আরো দুজনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল বিচারিক আদালত।

ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হলে হাই কোর্ট মহিউদ্দিন ও জাহাঙ্গীরের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে সালাম ও নাজমুলের দণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়।

এর আগে ২০০৪ সালে ক্যাম্পাস সংলগ্ন বিনোদপুর গ্রামে খুন হয়েছিলেন অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মো. ইউনূস আলী। তাকে হত্যার দায়ে দুই জঙ্গির মৃত্যুদণ্ড হয়।