অভিজিৎ হত্যাকাণ্ড তদন্তে সন্তুষ্ট নন বাবা অজয় রায়

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 March 2015, 09:54 AM
Updated : 14 March 2015, 09:54 AM

২৬ ফেব্রুয়ারি খুন হয়েছিলেন লেখক-ব্লগার অভিজিৎ রায়, যে মৃত্যু শিরোনাম হয়েছিল আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে সেই খুন, তদন্ত, ছোট্ট ‘গুল্লু’ অভিজিৎ, নিরীশ্বরবাদী অভিজিৎ- এসব নানা কিছু নিয়ে কথা বলেছেন একুশে পদকপ্রাপ্ত অধ্যাপক অজয় রায়, যার দুটি গবেষণা নোবেল কমিটিতে আলোচিত হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রে তার গবেষণা কক্ষে বসে অভিজিতের বাবা অজয় রায় কথা বলেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে।

সাক্ষাৎকারে তিনি তদন্ত প্রক্রিয়া নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “‍‍আমার পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, আই অ্যাম নট স্যাটিসফাইড উইথ দ্য প্রগ্রেস অব দ্য এনকোয়ারি অব দ্য কিলিং অব অভিজিৎ।”

অভিজিৎ খুন হওয়ার আগের কিছু ঘটনা নিয়ে নিজের সন্দেহের কথাও জানিয়েছেন অজয় রায়। ঘটনার দিন বইমেলায় একটি বৈঠক নিয়ে তার সন্দেহের কথা জানান তিনি, যাতে কয়েকজন ‘অপরিচিত’ যুবক ছিল বলে পুত্রবধূ রাফিদা আহমেদ বন্যার কাছে তিনি জানতে পেরেছেন।  

নিজেকে লেখায় দ্বিধাহীনভাবে নিরীশ্বরবাদী বা নাস্তিক হিসাবে পরিচয় দেওয়া অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ডের পর প্রধানমন্ত্রী নিজে ফোন করেছিলেন এবং আরো চারজন মন্ত্রী সরাসরি তার বাসায় গিয়ে সমবেদনা জানিয়েছিলেন। সেটা কেন গণমাধ্যমে আসেনি, তা যে নিজের মনে একটু প্রশ্ন জাগিয়েছে, সেটাও বলেছেন তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অভিজিতের হত্যাকাণ্ড মুক্তবুদ্ধি চর্চাকারীদের প্রতি জঙ্গিবাদীদের চরম হুমকি বলেই মনে করেন এই অধ্যাপক।

তার ভাষায়, “এটা এই বার্তা দেয় যে- তোমরা যারা মুক্তবুদ্ধির চর্চা কর, তোমরা মনে কর তোমরা একটা নিরাপদ এলাকায় আছ। ... তোমরা নিরাপদ ভাব এই চত্বরটাকে, কিন্তু আসলে তোমরা নিরাপদ নও, আমরা ইচ্ছা করলেই তোমাদের খুন করতে পারি।”

সফটওয়্যার প্রকৌশলী ছেলের সঙ্গে ইলেকট্রনের অনুরণন নিয়ে কাজ করা পদার্থ বিজ্ঞানী বাবার আত্মার সম্পর্কের কথা কখনও উচ্ছ্বসিত হয়ে হা হা করে হেসে, কখনও একটুখানি থেমে গিয়ে অথবা চুপ থেকে ঘাড়ের ওপর জমে থাকা সন্তান হারানোর ভার প্রকাশ করেছেন; কিন্তু একবারের জন্যও বিষণ্ন হননি, কাতর হননি। নিভৃতে কাঁদেন, কিন্তু সেই কান্না দেখান না এই মুক্তিসংগ্রামী।

(গত বুধবার এই সাক্ষাৎকারটি নেন শামীমা বিনতে রহমান। এর শ্রুতিলিখন করেছেন মিথুন বিশ্বাস ও ফয়সাল আতিক। ভিডিও ধারণ ও সম্পাদনা করেছেন ফারুক নিপু)

শামীমা বিনতে রহমান: স্যার, আপনাকে স্বাগত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে। প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, অভিজিৎ তো অনেক বারই হত্যার হুমকি পাচ্ছিলেন, প্রথম কবে থেকে উনি হত্যার হুমকি পান?

অজয় রায়: অতো ক্রোনলজিকালি তো বলতে পারব না। সেটা ২০১৪ সাল হচ্ছে লেটেস্ট। আমার ধারণা নভেম্বর মাসের দিকে, ফারাবী বলে এক ব্যক্তি তাকে তার ফেইসবুকের মাধ্যমে বোধ হয় ওকে হত্যার হুমকি দেয়। এরকম মাঝে মাঝেই তাকে হুমকি দিত। লাস্ট আমার মনে হয়, ২০১৪ সালের নভেম্বর মাসের দিকে। সেখানে লিখেছিল, সেটা আমাকে পরে ফরোয়ার্ড করেছে ও, ‘অভিজিৎ রায় তো আমেরিকার নাগরিক, ওখানে ওকে হত্যা করা যাবে না। কিন্তু ও যদি দেশে ফেরে তখন তাকে হত্যা করা হবে’। এইটা তারা একটা হুমকি দিয়েছিল। তো এইভাবে মাঝে মাঝেই তাকে হুমকি দিত ফেইসবুকে, আমাকে ফরওয়ার্ড করত।

শামীমা বিনতে রহমান: পুলিশকে কি ইনফর্ম করেছিলেন?

অজয় রায়: হ্যাঁ, পুলিশকে আমি ইনফর্ম করে রেখেছিলাম। ওরা তখন অতো সিরিয়াসলি নেয়নি মনে হয়। এ রকম কতো থ্রেট তো দেয় লোকে। তো যাই হোক ওরা কোনো রেকর্ড নেয়নি। তো আমি আর এইটা নিয়ে পারস্যু করিনি।

শামীমা বিনতে রহমান: উনি সাধারণত আপনাকে ঠিক কিভাবে প্রকাশ করতেন, যে ধরনের হুমকিগুলো পেতেন?

অজয় রায়: ওই ইমেইলে।

শামীমা বিনতে রহমান: উনি কি ভয় পেতেন?

অজয় রায়: না, সে ভয় পেত না। সে যদি ভয় পেত, তাহলে তো আসত না। সেই বিষয়টি যখন উঠেছে তাহলে বলি।

ফেব্রুয়ারির ৯ তারিখে ও আমাকে একটা ইমেইল করে বলল যে- আমি বাংলাদেশে অনেক দিন যাইনি। তো এবার বইমেলায় যাব। তোমাদের অনেক দিন দেখি না। বিশেষ করে মাকে অনেক দিন দেখি না। মাকে ভারী দেখতে ইচ্ছে করছে।

আমি ওকে পাল্টা লেখলাম যে, এখন বাংলাদেশের পরিস্থিতি খুব একটা ভালো না, আর তুমি তো মার্ক্ড, টার্গেটেড পার্সন। এসময় তোমার না আসা-ই ভালো। সে এর কোনো জবাব দিল না। সে একটা ইমেইল পাঠিয়ে দিল, আসার শিডিউলটা আরকি। কোন ফ্লাইটে আসবে, কখন আসবে, কখন ফিরে যাবে, এই সব। যাই হোক, ও যখন এসেই পড়ল, আমাদের বাসায় সরাসরি আসেনি। দুজনই আসছে হাজবেন্ড-ওয়াইফ। ১৬ তারিখে ওরা ঢাকা এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করেছে। ওখানে ওদের, বন্যার, মানে আমার পুত্রবধূর এক মামা থাকেন ইন্দিরা রোডে। এয়ারপোর্ট থেকে কাছে। তো ওরা গিয়ে, মামা গিয়ে ওদেরকে রিসিভ করেছে। আর আমাকে টেলিফোন করে বলল ওর মামা, ‘আপনার এয়ারপোর্টে যাওয়ার দরকার নাই, বা গাড়ি পাঠানোর দরকার নাই। আমি ওদেরকে রিসিভ করে আমার বাসায় নিয়ে যাব। পরে বিকেলে আপনাদের ওখানে পাঠিয়ে দেব’।

সেটা ১৬ তারিখে সকাল বেলা। তো ও যখন বাসায় এল বিকেলে তখন আমি তাকে বললাম- তুমি এসেছ এটা প্রচার করার দরকার নাই। এটা ফ্যামেলি লেভেলে রাখ। মেইনটেইন অ্যা ভেরি লো প্রোফাইল।

শামীমা বিনতে রহমান: কত বছর পর দেশে ফিরল?

অজয় রায়: এটা তিন বছর, হ্যাঁ, তিন বছর পর। তার মধ্যে এল। আসার পরেও বললাম যে, তুমি একা একা, বা হাজবেন্ড-ওয়াইফ শুধু যাবে না। বন্ধু-বান্ধব সাথে নিয়ে যাবে। দরকার হলে পুলিশকে বলে রাখবে।

শামীমা বিনতে রহমান: হ্যাঁ, উনি কি পুলিশকে জানিয়েছিলেন?

অজয় রায়: না, আমার মনে হয় না। ও যে নেচারের ছেলে, ও পুলিশকে জানিয়েছিল বলে আমার মনে হয় না। পুলিশও বলেছে, আমাদেরকে তো কিছু বলেনি।

শামীমা বিনতে রহমান: উনি যুক্তরাষ্ট্রে গেলেন কবে?

অজয় রায়: ও গেলো......। তার আগে ওর একটা ছোট বেলার কথা বলি। যদিও সাধারণভাবে ধরা যায় ওর জন্মস্থান ঢাকা। ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭২ সাল, এটা মেট্রিকুলেশন সার্টিফিকেইট অনুযায়ী। ওর মা হচ্ছে শেফালী রায়। ওর বয়স এখন ৭৫ বছর। ওর মার জন্মস্থান হচ্ছে কুমিল্লায়।

আমি যেহেতু ভিক্টোরিয়া কলেজের ফিজিক্সের প্রফেসর, আর মফস্বল শহরে তো এসব লোকেরা খুব গণ্যমান্য বলে বিবেচিত হত। তো সামাজিক অনুষ্ঠানে, দুতিনটা সামাজিক অনুষ্ঠানে, ওর বাবাও যেহেতু নামকরা উকিল ছিলেন। সেজন্য সামাজিক অনুষ্ঠানে দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে। এবং তোমার কাছে বলতে দ্বিধা নাই, আমাকে খুব ভালো লেগেছে আরকি। তারপরে আমরা ধীরে ধীরে পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হই। আলটিমেইটলি আমরা বিয়ে করি।

শামীমা বিনতে রহমান: কত সালে বিয়ে করলেন আপনারা?

অজয় রায়: ১৯৬৩ সাল।.......ছেলেটির নাম হচ্ছে গুল্লু, ডাক নাম হচ্ছে গুল্লু।

শামীমা বিনতে রহমান: আচ্ছা, ও কি একটু গোলগাল, মোটুসটু ছিল?

অজয় রায়: হ্যাঁ, সেজন্যই তো। একটু গোলগাল ফোলা ফোলা, সেই জন্যই তাকে আমরা গুল্লু বলে ডাকতাম। তো যদিও ওর জন্মস্থান সাধারণত ঢাকা বলে ধরা হয়, ইনফ্যাক্ট সে কিন্তু ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেনি। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে যখন ক্র্যাকডাউন হল, তখন তো আমি ফুলার রোডে। আমার বাড়িতে আর্মিরা এসেছিল। খুব ধাক্কা.. আমি দরজা-টরজা বন্ধ করে রেখেছিলাম, আর একটা ফলস তালা লাগিয়ে রেখেছিলাম আমার ড্রইংরুমের সামনে, আর দরজাটা খোলা রেখেছিলাম যাতে দেখা যায়, মনে হবে যেন কেউ নাই। তা দরজা অনেকক্ষণ লাথি-টাথি মেরে চলে গেছে। তো যাই হোক তারপরে যখন কারফিউ উঠল, দেখলাম যে আমার আর ঢাকায় থাকা সম্ভব না। তো আমি ওই মে মাসের দিকে ২৩শে মে ইনফ্যাক্ট, আমি ভারত সীমান্তে প্রবেশ করলাম, কুমিল্লার সোনামুড়া দিয়ে। সেখানে আমার আরেক কলিগের সাথে দেখা হল। বেশিরভাগই ছাত্র। আমরা শিক্ষকের মধ্যে তিন-চারজন ছিলাম। ওরা ট্রেইনিং দিল। থ্রি নট থ্রি রাইফেল, একে রাইফেল, মেশিনগান, ব্র্যান্ডগান, ইয়ে ছোড়া, গ্রেনেড ছোড়া, এইগুলো ট্রেইনিং নিয়ে তারপর আমরা বেশ কয়েকটা অপারেশন চালিয়েছিলাম।

শামীমা বিনতে রহমান: কোথায়?

অজয় রায়: কুমিল্লা সোনামুড়ায়। আমরা প্রায় ২৫/৩০ জন পাকিস্তানিকে মেরে ফেলেছি। এটা তখনকার সময় বাংলাদেশ যে আমাদের বেতার ছিল, সেখানে প্রচারিত হয়েছিল। তো রণাঙ্গনে সরে যাওয়ার আগে আমার সঙ্গে তো স্ত্রী ছিলেন আর মা ছিলেন। তো ওদেরকে তখন আপার আসামে আমার বড়ভাই ছিলেন, তিনি ওয়েল অ্যান্ড ন্যাচারাল গ্যাস কমিশনে একজন বড় অধিকর্তা এবং বড় প্রকৌশলী। তো আমরা ওর ওখানে গেলাম। ওর ওখানে গিয়ে, জায়গাটার নাম হচ্ছে আপার আসামের শিব সাগর জেলার নাজিরা, তো নাজিরাতে গেলাম। তখন মাই ওয়াইফ ওয়াজ ক্যারিয়িং অ্যাট দ্যাট টাইম (উনি তখন অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন)। চলে গেলাম। তারপরে রণাঙ্গনে একজন স্বেচ্ছাসেবক আমাকে বলল, ‘স্যার একটা খবর আছে, শুভ খবর আছে, আমরা খবর পেয়েছি নাজিরায় আপনার যে স্ত্রী এবং মাকে রেখে এসছিলেন, আপনার একটি পুত্র সন্তান হয়েছে’। তো সেইটা হচ্ছে তোমার ১৯৭১ সনের ১২ই সেপ্টেম্বর, রোববার সকাল বেলা ১২টা ৪২ মিনিটে। আমার এই ছেলের জন্ম। এখানে একটা নাজিরা ম্যাটারনিটি হোমের বার্থ সার্টিফিকেট আছে। সেই হল আমার অভিজিৎ (স্মিত উচ্ছল হাসি)

অভিজিৎ রায়

তারপরে আমি যখন ওর মাকে দেখতে গেলাম, ওই নাজিরা ম্যাটারনিটি হসপিটালে, মার পাশে একটা কটে শুয়ে আছে, আর জুল জুল করে তাকাচ্ছে। বিশ্বের দিকে পরম বিস্ময়ে। তো আমি ওকে আদরে কোলে তুলে নিলাম। কাঁদল না কিন্তু, কাঁদল না, সাধারণত শিশুরা তো কেঁদে ওঠে। 

তারপরে যুদ্ধ শেষ হলে বঙ্গবন্ধু যেদিন, ১০ই জানুয়ারি যেদিন ফিরেছিলেন আমরা তারপরের দিন ১১ই জানুয়ারি, আমরা ঢাকা বিমান বন্দরে নামলাম স্ত্রী এবং শিশুটিকে নিয়ে। আমার মুক্তিযুদ্ধের সহযোদ্ধারা তারপর বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি যেটার কথা তুমি বললে, সেটার সেক্রেটারি ছিলাম। এই সহযোদ্ধারা, আমাদেরকে বিমানবন্দরে সংবর্ধনা দিল। ড. আহমেদ শরীফ গিয়েছিলেন, তার গাড়িতে করে আমরা কাকরাইলে এলাম।

ওর প্রিয় খেলা ছিল ক্রিকেট; ফুটবলও খেলত। যেদিন তাকে নিউ মার্কেট থেকে একটা ক্রিকেট ব্যাট কিনে দিলাম, ওর তখন আনন্দ কে দেখে। ও আনন্দের আতিশয্যে বলে উঠল, ‘বাবা তুমি গ্রেট’। হা হা হা. . .(হেসে উঠলেন)। এ সম্পর্কে তার একটা স্মৃতিচারণ আছে- ‘আমার বাবা’ নামে। আমার ওপর তার একটি আর্টিকেল আছে। সেখানে সে লিখছে- ‘বাবার কাছে বায়না ছিল ভালো একটা ক্রিকেট ব্যাট। আমার মনে আছে প্রথম যখন বাবা ভালো একটা ক্রিকেট ব্যাট নিউমার্কেট থেকে কিনে দিয়েছিল, আনন্দে প্রায় কেঁদে ফেলেছিলাম’। আর ছোটবেলা থেকেই ওর বইয়ের প্রতি খুব আগ্রহ ছিল।

শামীমা বিনতে রহমান: অভিজিৎ রায় ঢাকায় আসার পর, ১৬ ফেব্রুয়ারিতে আসার পর, উনি কাদের কাদের সঙ্গে বেশি চলাফেরা করতেন?

অজয় রায়: আমার মনে হয়, ও খুব বেশি বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে ঘোরে নাই। ও ওই মামার গাড়িটা ব্যবহার করত। গাড়িটা পার্ক করে ওই বন্যা আর ও, দুজনেই তারপরও মেলার মধ্যে যে কয়জনের সঙ্গে দেখা হয়েছে।

শামীমা বিনতে রহমান: ২৬ ফেব্রুয়ারি উনার সঙ্গে আপনার সকাল বেলা কি যোগাযোগ হয়েছিল? সারাদিনে কী রকম যোগাযোগ ছিল?

অজয় রায়: সকাল বেলার দিকে যোগাযোগ হয়েছিল তখন বোধ হয় ১০টা না ১১টা। সেদিন আমি বাড়িতেই ছিলাম। ও টেলিফোনটা ধরল, ওদের দুজনেরই একটা টেলিফোন ছিল বন্যার এবং অভিজিতের। কখনও বন্যার কাছে থাকত কখনও ওর। তখন ওই সকাল বেলায়, দুইজনে একসঙ্গে ছিল, মামার বাসায়। তো গুল্লুই ধরল টেলিফোনটা। আমি বললাম যে তোমাদের তো আজকে আসবার কথা আছে মা বলছিল, আজকে তোমরা আমাদের এখানে খাওয়া দাওয়া করবে। আমাকে বলল যে ‘আমি রাতে যাব’। ২৬ তারিখ সেটা।

পরে এই সাড়ে ৭টা-৮টার দিকে আবার টেলিফোন করলাম, তখন সে রিসিভ করছে না ফোনটা। কিন্তু ফোনটা পকেটের চাপে হতে পারে, ফোনটা ওপেন (রিসিভ) হয়ে গেছে, আওয়াজ পাচ্ছি, মেলার আওয়াজ। আমি অবাক হচ্ছি ফোন ধরছে না কেন? যাই হোক তারপরে ডিসকানেকটেড হয়ে গেল, এই হল তার সাথে আমার ... (শেষ আলাপ)।

শামীমা বিনতে রহমান: এটা রাত ৮/ সাড়ে ৮টার দিকে?

অজয় রায়: অ্যা অ্যা. . . ৮টা . . . সাড়ে ৭টা/৮টা এরকম হবে।

শামীমা বিনতে রহমান: আমরা খবর থেকে যতদূর জানি যে, উনি প্রথমে শুদ্ধস্বরের আহমেদুর রশীদের এখানে, তারপরে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যলয়ের কোনও এক শিক্ষকের বাসায় তার আড্ডায় যাওয়ার কথা ছিল।

অজয় রায়: (টেবিলের ওপর থাকা ডায়েরি টেনে নিয়ে পাতা খুলতে খুলতে . . .) এই ছেলেটি, এ হচ্ছে ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী। এ হল বুয়েটের শিক্ষক, ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের। একে কিন্তু ইয়ারা (অভিজিৎরা) চেনে, আমাকে বন্যা পরে বলেছে। বন্যা এবং গুল্লু দুজনেই একে চেনে। এ-ই টেলিফোন করেছিল ওদেরকে। শুদ্ধস্বরের পরে একটা ওপেন জায়গায় বসে আলোচনা করার জন্য।

শামীমা বিনতে রহমান: ওখানে কি গিয়েছিলেন উনি?

অজয় রায়: হ্যাঁ, গিয়েছিল।

শামীমা বিনতে রহমান: ওখান থেকে কি বইমেলায় গিয়েছিল?

অজয় রায়: না বই মেলাতেই তো এটা। এটা বাসায় না। এটা বইমেলাতেই ওই ভদ্রলোক ওদেরকে টেলিফোন করেছিলেন যে- তোমাদের বই নিয়ে একটা আলোচনা হবে, তুমি কি আসতে পারবে? তখন ও শুদ্ধস্বরের ওখানে। বলল যে হ্যাঁ, আমি শুদ্ধস্বরের এখানে একটা প্রোগ্রাম করছি। এখান থেকে তোমাদের ওখানে যাব। তারপরে অভিজিৎ গেছে ওখানে।

অভিজিৎ জিজ্ঞেস করছিল, আর কে কে আসবে ওখানে? তো বলল যে, আসিফ আসবে। আসিফ, ও বোধহয় ব্লগার, সাইন্সের ওপরে আর্টিকেল-টার্টিকেল লেখে খবরের কাগজে, বক্তৃতা দেয়।

শামীমা বিনতে রহমান: ওনাদের একটা গ্রুপ আছে সম্ভবত, ওই ফারসীম মান্নান মোহাম্মদীর?

অজয় রায়: হ্যাঁ, গ্রুপ আছে একটা। তো ও ওকে বলেছে তোমাদের বই নিয়ে আলোচনা হবে। তো ওরা গেল সাড়ে ৭টার দিকে। ওটা ৫টার সময় হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ওরা ফোন করে জানাল, ৫টা ‘টু আরলি’ লোকজন আসবে না, তোমরা ৭টা, সাড়ে ৭টার দিকে আস।

তারপরে যখন গেল, গিয়ে দেখে যে, অপরিচিত কয়েকজন বসে আছে। ফারসীম ছিল। বন্যার কাছ থেকে যা শুনেছি। বন্যা-অভিজিৎ জিজ্ঞাস করল- কই আসিফ কোথায়, নিত্য কোথায়? বলল যে ওরা আসবে। কিন্তু ইনফ্যাক্ট আর আসেনি। এটাই কাল হল।

শামীমা বিনতে রহমান: কাল হল মানে?  

অজয় রায়: কাল হল মানে ওইখানে যাওয়াটাই। এইটা হল অ্যারেইঞ্জড। আমার মনে হয় মান্নান খুব ইনোসেন্টলি কাজটা করেছে। মানে ও-যে এটার মধ্যে ইনভলভড, তা না। কিন্তু সে অনেক লোকজন ডেকেছে, অনেকে এসেছে শুনে। এই যে আননোন ছেলে কতগুলো বসে আছে ওখানে। তারপরে করল কী, ফারসীম ওর সঙ্গে আলোচনা-টালোচনা করে ওরা গুল্লুকে এসকর্ট করে যেখানে স্পটটা হয়েছে ওই গেইট দিয়ে বেরিয়েছে। তখন বলল যে, চলেন অভিজিৎদা, আমরা চা খাই। ওই ছেলে গুলা আননোন ছেলেগুলা। ইতোমধ্যে ফারসীম মান্নান মোহাম্মদ কেটে পড়েছে। কেটে পড়েছে মানে ও নিজের কাজে হয়ত চলে গেছে। তার পরে বেরিয়েছে, বেরুনোর পরে তাকে ইমিডিয়েটলি ……।

শামীমা বিনতে রহমান: উনারা কি দুজনই ছিলেন, না কি সঙ্গে আরও কেউ ছিল?

অজয় রায়: না, ওর সঙ্গে (পরিচিতদের মধ্যে কেউ ছিল না)। ওই যে বললাম না, আসিফের আসার কথা ছিল, সে আসেনি। নিত্যের আসার কথা কথা ছিল, আসেনি। আর বাকিরা তো আননোন। শুধু ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী পরিচিত। কিন্তু সে তো বন্যাদের সঙ্গে আসেনি, ও নিজের কাজে হয়ত চলে গেছে। তার পরে ওর একটা টেলিফোন নাম্বার আছে আমার কাছে। কিন্তু ওটা সুইচ অফ করা। আমি একদিন যাব বুয়েটে, ওদের খোঁজে। কাউকে পরিচিত বন্ধুকে সাথে নিয়ে, একা যাব না। 

আসিফের সঙ্গে বন্যাদের কথা হয়েছে অনেক পরে। তখন বন্যাকে ও বলেছে যে, আমাকে তো বলেনি। আসিফকে বলেনি, নিত্যকেও বলেনি। ফারসীম বলেছিলেন, আসিফ আমন্ত্রিত ছিলেন। কিন্তু ওরা যখন যায়, তখন আসিফ-নিত্য কেউ ছিল না। আসিফ পরে বলেছে যে, ‘আমাকে তো নিমন্ত্রণও করা হয়নি’। এটা ওদের মারা-টারার পরে যখন আসিফকে বন্যা টেলিফোনে জিজ্ঞাস করেছিল। সে বলেছে, ‘কই আমাকে তো এরকমভাবে বলেনি। তারপরেও আমি রাতে খবরে দেখে অবাক হয়ে গেলাম, অভিজিৎকে মারা হয়েছে’। তারপরে সে (আসিফ) হাসপাতাল-টাসপাতালে গেছে।

শামীমা বিনতে রহমান: আপনি কিভাবে, কখন জানলেন অভিজিৎকে মারার খবরটি?

অজয় রায়: সাড়ে ৯টার দিকে আমাদের ঢাকা ইউনিভার্সিটির অ্যাসিসট্যান্ট প্রক্টর, উনি আমাকে টেলিফোন করলেন, ‘স্যার, অভিজিৎ রায় বলে কাউকে চেনেন নাকি? আমি বললাম, হ্যাঁ ও তো আমার বড় ছেলে। বলল, ‘স্যার, শিগগির হাসপাতালে যান। হি হ্যাজ বিন ব্রুটালি উনডেড’। আমি বললাম কে উন্ড করেছে? বললেন, ‘স্যার, সেটা তো বলতে পারি না স্যার। ওকে টিএসসি চত্বরের কাছে পেছন থেকে চাপাতি দিয়ে কোপানো হয়েছে এবং ওর বউও আহত’।

ঘটনার দিন হাসপাতালে অজয় রায়

কিন্তু তখন তো সে আর ফোন ধরছিল না। আমি তো আমার ছোট ছেলেকে নিয়ে ইমিডিয়েটলি রাশ্ড টু দি হসপিটাল। তখন রাত পৌনে ১০টার মতো হবে। গিয়ে দেখি বন্যা, ক্যাজুয়ালিটি ডিপার্টমেন্টে গিয়েই দেখি বন্যা। মাল্টিপল ইনজুরি, ব্যান্ডেজ-টেন্ডেজ করা। বললাম কী হয়েছে বন্যা?

বলল যে- ‘বাবা আমার দিকে তাকাতে হবে না, আপনার ছেলেকে বাঁচান’। তারপর ওখানে একটা নার্স দাঁড়িয়েছিল, বন্যা ওখানে হুইল চেয়ারে বসা। নার্স বলল- ‘স্যার আমরা ওকে সিটিস্ক্যান করাতে নিয়ে যাচ্ছি। আর ওকে ব্লাড দিতে হবে’। আমি বললাম, যা ব্যবস্থা করার করেন। আর আমার ছোট ছেলেটাকে বললাম- তুমি বন্যার সাথে যাও। তারপরে আমি অপারেশন থিয়েটারের দিকে অগ্রসর হলাম। সেখানে দরজা তো ক্লোজ্ড, আমি নক করলাম। একজন ড্রেস পরা ইয়ে বেরিয়ে আসল। বোধ হয় ডাক্তারই হবে।

আমি পরিচয় দিয়ে জানতে চাইলাম কী অবস্থা? বলল- ‘স্যার খুব ক্রিটিক্যাল অবস্থা, অপারেশন চলছে’। আমি বললাম যে- এনি হোপ? তারা বলল- ঘাবড়াবেন না, আমরা চেষ্টা করছি। তারপরে আমি তো অপেক্ষা করছি। আর হোপিং এগেইনস্ট হোপ।

তারপরে বারকাত (অধ্যাপক আবুল বারকাত) আসল, ইমরান সরকার আসল, আমার অনেক বন্ধু বান্ধব আসল, তারা আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল। বলল, ‘স্যার চিন্তা করবেন না, একটা কিছু হবে’। তখন ১০টা বেজে গেছে। আমি তাকে বললাম- টেল মি ফ্র্যাঙ্কলি হোয়েদার অভিজিৎ ইজ এলাইভ?

তখন বলল যে- ‘ওকে আমরা লাইফ সাপোর্ট দিয়ে রেখেছি, পালস এখনও আছে’।

আমি বললাম, এই পরিস্থিতিতে তাকে কি সিঙ্গাপুর বা ব্যাংককে এয়ার লিফট করা যাবে কি-না। খরচপাতি কেমন লাগবে? বলল- ‘নরমালি এটা ৩৮ হাজার ডলার লাগে। আপনার জন্য আমরা অনেক রিডিউস করব, ২০/২২ থাউজেন্ড ডলারের বেশি হবে না। ওটা নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না। আপনাকে তো এখন পে করতে হবে না’। তখন বোধ হয় ১১টা, সাড়ে ১১টা হবে। বারকাত আসল, বলল, ‘স্যার এসব আর করে লাভ নেই। অভিজিৎ ইজ নো মোর. . . (অভিজিৎ মারা গেছেন)’।

আমি টোটালি ব্রোকেন ডাউন। আমার টিয়ার্স রোল্ড। কিন্তু আমি একদিক দিয়ে খুব শক্ত মনের মানুষ। আমার তখন মনে হচ্ছিল, আমাকে তো নিজেকে সামলাতে হবেই, অভিজিতের মাকে সামলাতে হবে, পুত্রবধূ আছে, ওদেরকে সামলাতে হবে, কাজেই আমার একেবারে ভেঙে পড়লে চলবে না। আই হ্যাভ টু ফেইস দিস সিচ্যুয়েশন কারেজিয়াসলি অ্যান্ড ম্যাটেরিয়ালি।

হাসপাতালে রাফিদা আহমেদ বন্যা

তারপরে বাসায় যখন ফিরে গেলাম- ওর মাকে, সে তো তখন জেগে আছে। সে নিজেও খুব অসুস্থ্, চলাফেরা করতে পারে না। এখন ওর মাকে বলব কি বলব না, এনিয়ে দ্বিধায় আছি। তো আমার বৌমা (ছোটছেলে অনুজিতের স্ত্রী) বলল, ‘বাবা আমি এদিকটা সামলাচ্ছি’। তারপরে তার মার কাছে ডিসক্লোজ করা হল অভিজিৎ ইজ নো মোর। তারপর কান্নাকাটি করল, ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর ওষুধ প্রয়োগে ঘুমিয়ে রাখা হল।

সেই সময়ের একটা কথা বলি- এরাউন্ড ১টার দিকে, ভাতটাত তো আর খেতে পারিনি, বৌমা জোর করে কিছু খাবার মুখে তুলে দিল, নইলে তো ভেঙে পড়ব। তো অল্প একটু মুখে দিয়ে আমি ড্রইং রুমে বসেছি, টিভিতে নিউজটা দেখতেছি, অভিজিৎকে দেখাচ্ছে। তখন একটা টেলিফোন আসল আননোন নাম্বার থেকে। যাই হোক অন করলাম। সেই টেলিফোন থেকে বিড় বিড় বিড় করে কিসব বলছে। তখন একটু মনোযোগ দিয়ে শুনলাম যে এগুলো কোরানের আয়াত বা সূরা এইসব। ওই নিজে কিছু বলছে না ওই লোক। শুধু এইগুলো আওড়াচ্ছে।

তো আমি বললাম- ভাই আপনি এত রাত্রে, আমি বিধ্বস্ত হয়ে ফিরেছি হাসপাতাল থেকে। আপনি এত রাত্রে কী জন্য ফোন করেছেন, বলেন তো? তখন বলল যে, ‘আপনি আল্লার ওপর বিশ্বাস রাখেন’। তো আমি বললাম যে, এত রাতে এই কথা বলার জন্য আপনি ফোন করেছেন? তখন বলল যে, ‘দেখলেন না অভিজিতের কী পরিণতি?’ তো আমি তো ফোনটা কেটে দিলাম।

শামীমা বিনতে রহমান: তখন রাত কয়টার সময়?

অজয় রায়: এই একটা/টেকটার দিকে। আর ১০ মিনিট পরে আবার টেলিফোন করেছে। আবার সেই একই কথা। তখন আমি আমার বৌমাকে দিলাম যে, তুমি ওর সঙ্গে কী বলবে বল, আর নাহয় ফোনটা কেটে দাও। এত রাতে ফাইজলামি করে একটা….। তারপর বৌমা ফোনটা ধরে বললে যে, ‘আপনি আর ডিস্টার্ব করবেন না আমাদের’ বলে ফোনটা কেটে দিল।

শামীমা বিনতে রহমান: এই এলাকার মধ্যে (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) এ ধরনের নৃশংস হামলা এক ধরনের বার্তা দেয় কী?

অজয় রায়: এক ধরনের বার্তা দেয়, এই বার্তা দেয় যে- তোমরা যারা মুক্তবুদ্ধির চর্চা কর, তোমরা মনে কর তোমরা একটা নিরাপদ এলাকায় আছ। আমরা ফান্ডামেন্টালিস্টরা ইচ্ছে করলেই তোমাদের তথাকথিত মুক্তবুদ্ধি চর্চার ধারক-বাহককে যে কোনো সময় হত্যা করতে পারি। এবং হুমায়ূন আজাদকে দিয়ে সেই মেসেজ দিয়েছে, অভিজিৎকে দিয়ে শেষ আরেকটা মেসেজ দিল যে তোমরা নিরাপদ নও। তোমরা নিরাপদ ভাব এই চত্বরটাকে, কিন্তু আসলে তোমরা নিরাপদ নও, আমরা ইচ্ছা করলেই তোমাদের খুন করতে পারি।

শামীমা বিনতে রহমান: অভিজিৎ খুন হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর, বইমেলার সময়ে, বইমেলার শেষ দিকে। আবার হুমায়ুন আজাদ স্যার, উনিও খুন হলেন বইমেলার শেষের দিকে। একই চত্বরে, মোটামুটি কাছাকাছি এলাকায়। তো কেন বইমেলা চলাকালীন, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাকে এই ধরনের সন্ত্রাসীরা খুনের যোগ্য জায়গা বলে মনে করে?

অজয় রায়: আমরা মনে করতাম, কিছুদিন আগেও যে এইটা আমাদের এলাকা।

অভিজিতের রক্তভেজা ফুটপাত

আমরা যারা মুক্তবুদ্ধির চর্চা করি। আমরা যারা উদারনৈতিক চিন্তাধারায় বিশ্বাস করি, লিবারেল ডেমোক্রেসিতে বিশ্বাস করি, সেক্যুলারিজমে যারা বিশ্বাস করি, সর্বোপরি বাংলাদেশ একটা মুক্ত কান্ট্রি, যেখানে সবাই নির্ভয়ে বসবাস করতে পারবে- এই ধারণাগুলোর যারা লালন করি, সেইটার বিচরণ ক্ষেত্র হচ্ছে এই টিএসসি চত্বর, বাংলা একাডেমি, এই এলাকাটা। এখন এটি হুমায়ুন আজাদ থেকে শুরু হল, এই অভয়ারণ্যটা, সুযোগটা এক ধরনের ডিটারমাইন্ড ফান্ডামেন্টালিস্টরা গ্রহণ করল। যে এরা এই এলাকায় নিজেদের সম্পর্কে সতর্কতা অবলম্বন করে না, অসতর্ক থাকে।

শামীমা বিনতে রহমান: আপনার কি মনে হয় যে এরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার না এবং বহিরাগত, যারা খুনি বা খুনের পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত? কী মনে হয় আপনার কাছে? একদম সাধারণ জ্ঞান থেকে কী মনে হয়?

অজয় রায়: একেবারে নাই তা বলব না। যদিও এখনও প্রকাশ্যে ওই ধরনের ইসলামিক ছাত্রগ্রুপ বা সংঘরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সে ধরনের আধিপত্য করে নাই, অন দি সারফেস। কিন্তু ভেতরে ভেতরে হয়ত ওদের এক ধরনের গোপন সংগঠন রয়েছে, যারা কিলিংয়ের সাথে জড়িত, তাদেরকে হয়ত ইনফরমেশন দেয়, এখানে এখন হুমায়ুন আজাদ আসবে, বাংলা একাডেমি থেকেই হয়ত খবর দিল যে, অভিজিৎ এখন তার দলবল নিয়ে, অভিজিৎ দম্পতি এখান দিয়ে বেরুবে। এই খবরগুলো নিশ্চয় ভেতর থেকে দেওয়া হয়।

শামীমা বিনতে রহমান: বন্যা আপনাকে কিভাবে ঘটনাটি বলেছে? বইমেলা থেকে হেঁটে হেঁটে বের হওয়ার পর, কী দেখলেন? উনি তো একজন প্রতক্ষ্যদর্শী, মানে ওইটার কী বর্ণনা উনি আপনাকে দিয়েছেন?

অজয় রায়: সেইটার বর্ণনা দিল যে আমরা তো বেরিয়ে আসছিলাম আর ওদের গাড়িটা ছিল বোধ হয় টিএসসির ওই পাড়ে, যেখানে গাড়িগুলো পার্ক করে দেখছো তুমি মিলন স্কোয়ার যেখানে তার পাশ দিয়ে যে গাড়িগুলো ওইখানে বোধ হয় কোথায় ছিল। তো ওরা ওইখান থেকে নেমে ওই গাড়ির দিকে যাচ্ছিল। সেইসময় পেইভমেন্টেই (ফুটপাতে) তাকে, তাদেরকে ইন্টারসেপ্ট করা হয়।

শামীমা বিনতে রহমান: ওনারা কি চা খাচ্ছিলেন? 

অজয় রায়: না, চা ওরা খায়নি। তবে আমাকে একজন বলেছে, আমি নিজে জানি না, ওখানে নাকি একটা চায়ের দোকান ছিল, ফুচকার দোকান। তো ওইখানে নাকি ওরা ওই যে দুইজন মেরেছে, ওরা ওখানে নাকি দাঁড়িয়েছিল চায়ের দোকানটার পাশে এবং তখন নাকি ওই ছেলেটা জিজ্ঞেস করেছে, ‘স্যার, আপনাদেরকে চা দেব?’ তো ওরা বলল যে, ‘না, চা আমরা পরে খাব’। এই এইটুকুই তার কথা এবং সে বর্ণনা দিয়েছে যে ওই ছেলে দুটোর বয়স বলেছে নাকি যে অভিজিতের মতোই হাইট, আর তার আন্দাজমতো ২০ থেকে ২৫ এর মধ্যে যে কোনো বয়স এবং খুব বেশ বলিষ্ঠ চেহারা।         

শামীমা বিনতে রহমান: ছাত্রলীগ অর্থাৎ ক্ষমতাসীন দলের সাথে সম্পর্কিত কোনো ছাত্র সংগঠন, তারা যদি মারামারি করে এবং তাদের মারামারির ইতিহাস এখানে এরকম যে- গা সহনীয়; পুলিশও মনে করে আমার ওখানে যাওয়ার কিছু নাই এবং সেই সুযোগটাই আরেকটা গ্রুপ নিতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরের মতো জায়গায় এরা সবসময় বা প্রায় সময়ই মারামারি করে বলে পুলিশ এখানে নিশ্চুপ থাকবে- এটা কেন?

অজয় রায়: না, ওটা তো পুলিশের অ্যাজাম্পশন (ধারণা)। ছাত্রলীগ মারামারি করছে, না জাতীয় দল (জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল) মারামারি করছে তোমরা ওখান থেকে বসে কী করে জানলে? তোমরা অকুস্থলে যাবে, তারপরে যদি দেখ যে ক্ষমতাসীন দল মারামারি করছে, তোমরা তখন বলতে পার যে আচ্ছা বাবা আমাদের ওখানে কিছু করার নেই। অথচ যদি বিএনপির ছাত্রদলের মারামারি হয় তখন কী? তখনও বসে থাকবে? ছাত্রলীগ সরকারি দল, কিন্তু তোমরা তো জান না, আসলে যে ছাত্রলীগ, না কারা ওখানে মারামারি করছে?  

শামীমা বিনতে রহমান: অথবা আপনার কি মনে হয়ে, আসলে নৃশংস খুনের সংস্কৃতি আমাদের গা সহা হয়ে গেছে?

অজয় রায়: ... আমি বলব না গা সহা হয়েছে। কিন্তু এই রকমভাবে যদি একটার পর একটা হত্যাকাণ্ড চলতে থাকে এবং তার যদি কোনোরকম বিচার বা দোষীরা যদি ধরা না পড়ে তাহলে ক্রমশ এটা আমাদের গা সহা হয়ে যাবে। আমি তো একটা জায়গায় বলেছি যে আমরা টিএসসি চত্বরকে শেষ পর্যন্ত কি বলব যে হত্যা চত্বর? হত্যা চত্বর? ওখানে মিলন মারা গেছে, হুমায়ুন আজাদ ওখানে ওপাশে খুন হয়েছে, তারপরে অভিজিৎ খুন হল। তো এই যে পর পর খুনগুলো তো এটা নিয়ে আমরা একটা কিলিং স্কয়ার বানাব নাকি?

শামীমা বিনতে রহমান: আচ্ছা, এবার একটু অভিজিতের লেখালেখি প্রসঙ্গে একটু আসতে চাই। অভিজিতের সবশেষ লেখাটি প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছিল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের আর্টস বিভাগে এবং লেখাটা প্রকাশিত হওয়ার পর ফেইসবুকে সেটাকে শেয়ারও করেন। তার সেই শেয়ারটা ছিল ৫টা বা সাড়ে ৫টার দিকে (২৬ ফেব্রুয়ারি বিকাল)। এবং আমরা যদি ঘটনাক্রমও দেখি, ৯টার দিকে, এর সাড়ে তিন থেকে চার ঘণ্টার মাথায় তিনি মারা গেলেন।

অজয় রায়: হুম, এই তো ৯টা, সাড়ে ৯টা. . .

এই বছরে এই বইমেলায় ওর দুটো বই প্রকাশিত হয়েছে একটা হচ্ছে তোমাকে এইটা একটু বলি তোমার জানা দরকার সেটা হল একটা হচ্ছে ‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’, এটা দুইজন মিলে করেছে। একজন আমার কলিগ, অভিজিতের খুব প্রিয় পাত্র এবং অভিজিতকেও সে খুব স্নেহ করে। উনি কানাডা প্রবাসী কিন্তু মারা গেছেন। স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে, এই গত বছর মারা গেছেন হার্টফেইল করে। আর অভিজিৎ...  

শামীমা বিনতে রহমান: ওনার নামটা হচ্ছে মীজান রহমান। মীজান রহমানকে নিয়ে উনি লিখেছিলেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের মতামত বিশ্লেষণে

অজয় রায়: আরেকটা বই হল ‘ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো: এক রবি বিদেশিনীর খোঁজে’। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর কথা বলি তোমাকে। অভিজিৎ ২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে আর্জেন্টিনা গেছে। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক একজন আর্জেন্টাইন বিদুষী মহিলা। এই চৌদ্দ সালে যখন নভেম্বর মাসে অভিজিৎ আর্জেন্টিনা গেল, ওরা এমনি দেশটা দেখতে গেছিল। দুইজনই, হাজবেন্ড ওয়াইফ তখন ওকাম্পোর ভিলা দর্শন করে, মিউজিয়াম দেখে। পরে অনেক তথ্য সংগ্রহ করে এবং রবীন্দ্রনাথের চিঠিগুলি ওরা জেরক্স (প্রতিলিপি) করে নিয়ে আসে। তারপর সেটার উপরে ওকাম্পোর বইটা।

শামীমা বিনতে রহমান: এক রবি বিদেশিনীর খোঁজে, নামটাও বেশ আকর্ষণীয়...

অজয় রায়: হ্যাঁ, আর রবীন্দ্রনাথের চিঠিগুলি বংলা অনুবাদ করে। ষাটটা চিঠি অনুবাদ করেছে।

শামীমা বিনতে রহমান: এই কথাটা আমি বলতে পারি যে উনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লেখালেখিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। ওনার লেখালেখির উৎসাহটা কিভাবে এবং কবে থেকে শুরু হল? নিশ্চয় আপনিও উনার উৎসাহ হিসেবে ছিলেন।

অজয় রায়: সেইটাই বলি। ওর নিজের লেখাতেই আছে। আমার সম্পর্কে যখন লিখছে ‘বাবা বৃদ্ধ হলেন’ (উচ্ছ্বল হাসি) এই টাইটেলে এই জায়গাটা তোমাকে পড়ে শোনাই। ছোটবেলা থেকেই, আমি অভিজিৎ সম্পর্কে বলছি, ছোট বেলা থেকেই ওর বইয়ের প্রতি ছিল আকর্ষণ। সত্যজিৎ রায়, উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর বই ও গোগ্রাসে গিলত। যতই বড় হতে থাকল, আমি বঙ্কিমচন্দ্র, মধুসূদন, হেমচন্দ্র, কায়কোবাদ এবং রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচয় করাতে থাকি। অচিরেই সে একজন রবীন্দ্রভক্ত পাঠক হয়ে দাঁড়ায়। ফাঁকে শেক্সপিয়ারের কাজের সাথে ওর পরিচয় ঘটতে থাকে নিজের আকর্ষণে।

অভিজিৎ রায় ও রাফিদা আহমেদ বন্যা

এ সম্পর্কে একটি স্মৃতিচারণে অভিজিৎ বলেছে- ‘বাবা আমাকে রাজপুত্রের মতো বড় করতে পারেননি বটে; কিন্তু বাবাই আমাকে যত রাজ্যের বইয়ের জগতের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। আমাদের সেলফে ছিল মুক্তধারার কিশোর বিজ্ঞানের মজার মজার সমস্ত বই। জাফর ইকবালের মহাকাশে মহাত্রাস কিংবা স্বপন কুমার গায়েনের সাতের কীর্তি, কিংবা বার্নোডের তারা এগুলো তার কল্যাণেই পড়া। বাবাই আমাকে হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন সুকুমার রায়ের রচনা সমগ্র, হ-য-ব-র-ল এর বিড়াল, পাগলা দাশু আর হেসোরামের হুঁশিয়ারীর ডায়েরির কথা জেনেছি তার কাছ থেকে। বাবাই আমার মনে বপন করেছিলেন মুক্তবুদ্ধি আর সংশয়ের প্রথম বীজ। বাবাই আমাকে আবৃত্তি করতে শিখিয়েছিলেন রবি ঠাকুরের প্রশ্ন কবিতা’।

বুয়েট থেকে পাস করার পরে মাস ছয়েক ও বুয়েটে শিক্ষকতা করে। বছর দুয়েক পরে সিঙ্গাপুর চলে যায় ওখানকার খুব নামকরা বিশ্ববিদ্যলয় ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর, একটি বৃত্তি নিয়ে। ওখানে চারবছর পড়া ও গবেষণা করে বায়োটেকনোলজিতে এমফিল ও পিএইচডি করে।

ও গবেষণা করত সিঙ্গাপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইন্সটিটিউট অব বায়োটেকনোলজিতে। ওখানে তিন-চার বছর গবেষণা ও চাকরি করে অভিজিৎ যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেয় এবং একটি কম্পিউটার কোম্পানিতে যোগ দেয়।   

শামীমা বিনতে রহমান: স্যার যেটা সবার অনেক আগ্রহ, সবার অনেক বোঝার জায়গা, সেটা হচ্ছে যে উনি (অভিজিৎ রায়) তো  ব্লগিং করতেন। মুক্তমনা ব্লগে, আপনিও..  

অজয় রায়: এই জিনিসটা খুব একটা বুঝি না। ব্লগার কী জিনিস। আমি নিজে ব্লগ করি না (হাসি…)

শামীমা বিনতে রহমান: কিন্তু আপনার লেখা পড়েছি আমি ওইখানে (মুক্তমনা ব্লগে). . .

অজয় রায়: মুক্তমনাটা (ব্লগ সাইট) কিন্তু শুরু করেছিলাম আমি, খুব ছোট আকারে। তারপরে ও যখন বড় হল, তখন ও বলল যে ওটাকে আরেকটু আপডেট করতে হবে। তারপরে ওর বন্ধুবান্ধব মিলে এটাকে এই স্টেজে নিয়ে আসছে। শুরুটা আমি করে দিয়েছিলাম।

শামীমা বিনতে রহমান: কবে সেটা?

অজয় রায়: সেটা অনেক আগের এটা বোধ হয়, মুক্তমনা শুরু হল বোধ হয় ২০০১ এ নাকি । তারপরে আমি ওই ২০০০ এর দিকেই ও যখন টেইক আপ করল তখন তো আমি ছেড়ে দিলাম, আমি খালি লেখা পাঠাতাম।  

শামীমা বিনতে রহমান: আপনি এবং অভিজিৎ, আপনাদের দুজনের মধ্যে মিলের জায়গা কোথায়?

অজয় রায়: মিলের জায়গা তো অনেকগুলোই আছে। আবার পার্থক্যও আছে। মিলের জায়গা হল যে আমাদের চিন্তা ধারার মধ্যে একটা ঐক্য আছে। আমিও সেক্যুলার হিউম্যানিস্ট, লিবারেল ডেমোক্র্যাট। ও সেই চিন্তা ধারার ধারক। আর অমিল হল, ও বাবাকে এক্সেল করে (ছাপিয়ে) গেছে তার লেখালেখিতে।

হি ওয়াজ নেভার অ্যান অ্যাক্টিভিস্ট। আমার মতো, আমি তো অ্যাক্টিভিস্ট। আমি তো রাস্তায় গিয়ে ৫২ এর আন্দোলন করেছি, ৬৯ এর গণআন্দোলন করেছি, ৭১ এর নন কো-অপারেশন মুভমেন্ট করেছি। এবং তার অনিবার্য পরিণতি আমি মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র বন্দুক হাতে যুদ্ধ করেছি। অভিজিৎ তো সেই রকম না। তার অবশ্য মুক্তিযুদ্ধ করার প্রশ্ন আসে না। কিন্তু হি হ্যাজ নেভার বিন এ স্ট্রিট ফাইটার। কিন্তু তার লেখালেখির মধ্যে, ব্লগের মধ্যে...

শামীমা বিনতে রহমান: কলম যোদ্ধা....

অজয় রায়: কলমযোদ্ধা সেই দিক দিয়ে বলা যায়। এটা হচ্ছে অমিল আমাদের। এই কারণে যে তাকে হত্যা করতে হবে বা হতে পারে, আমার কল্পনায় আসেনি। আমি ভেবেছিলাম তার লেখালেখির কারণে বড়জোর ফান্ডামেন্টালিস্টরা তাকে ধরে হয়ত চড়-থাপ্পড় মারবে, হুঁশিয়ার করে দেবে, খবরদার এসব লেখালেখি করবা না, আজকে তোমাকে ছেড়ে দিলাম পরে আর ছাড়ব না। কিন্তু তারা যে ডিটারমিনড হয়ে আছে যে একজন থিউরিটিক্যাল যিনি খালি মুক্তমনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ, লেখালেখির মধ্যে তাকে কেন হত্যা করতে হবে। হি ইজ নট অ্যান ফিজিক্যাল থ্রেট টু ফান্ডামেন্টালিস্টস সেই অর্থে। সে কলম যোদ্ধা।  কিন্তু সে তো হাতে তরবারি নিয়ে কোনো ফান্ডামেন্টালিস্টকে মারতে আসেনি। কিন্তু তাকে কেন মারা হবে? ধর্মের নামে তাকে কেন মারা হবে? এতে ধর্মের কোন মহান উদ্দেশ্য সাধিত হবে? এরা তো ইসলামের কলঙ্ক। 

শামীমা বিনতে রহমান: অভিজিৎতো নিজেই নিজেকে খুব স্পষ্টভাবে বলতেন যে উনি হচ্ছেন অনিশ্বরবাদী বা নাস্তিক। আপনি নিজেও তা বলেন। আপনাদের, আপনি এবং অভিজিৎ অথবা আপনি আপনার জায়গাটা এবং অভিজিৎকে যেভাবে বুঝেছেন দুটোকে মিলিয়ে যদি আমাকে বলেন।

অজয় রায়:  আমি হচ্ছি অজ্ঞেয়বাদী। ইংরেজিতে বলে অ্যাগনস্টিক। অভিজিৎ তো প্রকাশ্যেই বলে। 

শামীমা বিনতে রহমান: ওনার যে লেখাগুলি আমি পড়েছি তাতে আমি দেখতে পেয়েছি যেমন কোনো কিছু ধারণা থেকে বলছেন না উনি। একদম মনে হচ্ছে তত্ত্বও তথ্য দুটো সান্নিবেশ করে ওনার লেখাগুলি দাঁড়াত।

অজয় রায়: সেটাই ওর হচ্ছে লেখার মূল মেটেরিয়াল। যে সে তথ্য এবং বিশ্লেষণ এবং সেগুলির প্রত্যেকটাই বিজ্ঞানের ভিত্তিতে। এই যে যেমন যেটাকে নিয়ে সমালোচনা হয় ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’,  আমি বইটা অনুপুঙ্ক্ষরূপে পড়েছি। বিশ্বাসের ভাইরাসটা একটা বায়োলজিক্যাল সাইন্সের ওপর ভিত্তি করে লেখা।

নিজের বই হাতে অভিজিৎ রায়

তুমি যদি পড় ওটা দেখবা আমাদের বিশ্বাসের জায়গাগুলো কোথায়। কেন একজন মানুষ অবিশ্বাসী হয়। কেন একজন মানুষ বিশ্বাসী হয়। আবার নানান ধরনের বিশ্বাস হয়। কেউ হিন্দু ধর্মে বিশ্বাস করছে, কেউ খ্রিস্টিয়ানিটিতে বিশ্বাস করছে, কেউ ইসলামে বিশ্বাস করছে। ইসলামেরও আবার অনেক তরিকা আছে। তো এইগুলো জেনেটিক্যাল পয়েন্ট অব ভিউ থেকে, বায়োলজিক্যাল পয়েন্ট অব ভিউ থেকে কী ব্যাখ্যা বিজ্ঞানীরা দিতে পারে, সেটারই একটা বই।  এটার জন্য কাউকে খুন করতে হবে বা অথরকে (লেখককে) খুন করতে হবে? এটা তো একটা বিজ্ঞানের অ্যানালিটিক্যাল বই।

শামীমা বিনতে রহমান: এই যে আপনার কাছ থেকে শুনতে শুনতে আমার মনে হল যে আপনি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, দেশ স্বাধীন করেছেন আপনারা; সেই দেশটিতেই এখন ধর্ম সম্পর্কে নিজের মতামত প্রকাশ করার জন্য আপনার সন্তান অভিজিৎকে খুন হতে হল, মানে...

অজয় রায়: এইটা বলা মুশকিল এক কথায়। আমি সাধারণ মানুষকে কোনো সময় দোষ দেইনা। রোজার ঈদের সময় হিন্দু পরিবাররা মুসলমানদের ঈদের উৎসবে যোগ দিত। উল্টোটাও হত। পূজা পার্বনে মুসলিম প্রতিবেশীরা আসতেন। পূজার মণ্ডপে আসতেন প্রসাদ খেতেন, এইটিই ছিল বাংলাদেশের ইসলামের বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এই যে ওয়াহাবি আন্দোলন যেইটা শুরু হল সৌদি আরব বেইজড, এইটাই আমাদেরকে ক্রমশ এক ধরনের ফান্ডামেন্টালিস্ট মুসলমানে পরিণত করার চেষ্টা করেছে এবং তার কিছু ফল হয়েছে। একদল জিহাদী ফান্ডামেন্টালিস্ট হল, প্রয়োজন হলে খুন করার জন্য একটা গ্রুপ তৈরি হয়ে যায়।

শামীমা বিনতে রহমান: আপনার কি মনে হয় সুনির্দিষ্টভাবে কোনো ধর্মীয় চরমপন্থী গ্রুপ এর সাথে সম্পৃক্ত থাকতে পারে?

অজয় রায়:  আমি ওভাবে ঠিক তো আর চিহ্নিত করতে পারব না। পুলিশরা পারে চিহ্নিত করতে। কিন্তু আমার নিজের ধারণা, এরা একটা সংঘবদ্ধ চক্র তৈরি হয়েছে। যারা ডিটারমিন্ড টু এলিমিনেট (চিরতরে সরিয়ে দিতে সংকল্পবদ্ধ) যাদেরকে মুরতাদ বলা হয়। মুরতাদ, বিধর্মী, কাফের মানে যারা বেশি বাড়াবাড়ি করতেছে আরকি। আমি চুপচাপ থাকলে আমারে কিছু বলবে না।

শামীমা বিনতে রহমান: সম্ভবত আপনাকেও মুরতাদ ঘোষণা করা হয়েছিল?

অজয় রায়: হ্যাঁ, অনেকবার। এইযে কিছুদিন আগে ইনসানিয়াত নামের একটি পত্রিকায়। আমার ছোট ছেলে ওটা দেওয়াল থেকে তুলে নিয়ে এসেছে। বলে যে, ‘বাবা এই দেখ’। আমি বলেছি, এইগুলি দেখে কী করব? ওখানে অভিজিতের নাম আছে, আমার নাম আছে। এর আগে যখন আহমেদ শরীফ বেঁচে ছিলেন, তার নাম ছিল হুমায়ুন আজাদের নাম ছিল। এখন হয়ত আরও অনেকের নাম অ্যাড (যোগ) হইছে। ব্লগারদের নাম থাকে।

শামীমা বিনতে রহমান: এরকম অনেককে বলতে শোনা গেছে যে প্রধানমন্ত্রী নিজে কেন কোনো রকমের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেননি? এবং প্রধানমন্ত্রী ২০১৩ সালে যখন ব্লগার রাজীবকে (আহমেদ রাজীব হায়দার) খুন করা হল, সে সময়টায় উনি ব্যক্তিগতভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন, উনি তার অনুভূতির কথা জানিয়েছিলেন।

অজয় রায়: কাগজে বেরিয়েছে সেটা?

শামীমা বিনতে রহমান: হ্যাঁ, রাজীবের বাসাতেও গিয়েছিলেন। ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সময়, তো অনেকে এরকম বলছিলেন প্রধানমন্ত্রী একটা প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারতেন, এই বিষয়টায় আপনাকে ফোন করতে পারতেন বা আপনাকে সমবেদনা দিতে পারতেন, কথা বলতে পারতেন। এই প্রশ্নটা এই কারণে যে আওয়ামী লীগ যে ধরনের চিন্তা ভাবনা করে, সেই ধরনের চিন্তা-ভাবনার সাথে মিলে যায় এরকম কর্মকাণ্ডের সাথে আপনি অনেকদিন থেকে রাস্তায় ও লেখালেখিতে যুক্ত আছেন।

অজয় রায়: আমার তারিখটা ঠিক মনে নাই, ২৮ তারিখে (ফেব্রুয়ারি) যখন বাসায় ফিরলাম এসব কাণ্ড-টাণ্ডের পরে, আমার তো অনেক জায়গায় ছোটাছুটি করতে হয়েছিল। রাত সাড়ে ৯টা ১০ টার দিকে বাসায় ফিরেছি। তখন আমার বৌমা (ছোট ছেলে অনুজিতের স্ত্রী) আমাকে একটা টেলিফোন নম্বর দিল। বলল যে ‘পিএম টেলিফোন করেছিলেন, তুমি তো ছিলে না, আমাকে একটা নাম্বার দিয়ে বলেছে- স্যার যত রাতেই ফিরুক, এই নাম্বারে যেন আমাকে যোগাযোগ করে’।
তা আমি যোগাযোগ করেছিলাম। একটু ধরতে উনার দেরি হয়েছে কিন্তু আধা ঘণ্টার মতো,  ওনার তো ফোন খুব এনগেইজড থাকে। তো তারপরে কানেক্টেড হল।
তারপরে সমবেদনা প্রকাশ করলেন, আমাকে বলল- ‘স্যার আমি কী করতে পারি আপনার জন্য’।
আমি বললাম তুমি তো আমার ছাত্রী তুল্য, তোমার হাজবেন্ড আমার একবারে সরাসরি ছাত্র। বলল- ‘সেগুলো তো আমি জানি স্যার’।

এই স্থানেই হামলা হয় অভিজিতের ওপর

আমি বললাম দেখ তুমি এখন ক্ষমতার শীর্ষে আছ। এখন তোমার আমলে এসব ঘটনা ঘটবে, এটা তো সহ্য করা যায় না।
তো বললো যে (প্রধানমন্ত্রী) – ‘স্যার আই উইল ট্রাই মাই বেস্ট স্যার। আপনার প্রতি তো সহানুভূতি আছেই। আপনার এই দুর্ঘটনার জন্য আপনার পাশে আছি আমি’। আর বললো যে, ‘আমি আপ্রাণ চেষ্টা করব আমাদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এবং ডিবি দিয়ে। অভিজিতের খুনিরা যাতে চিহ্নিত হয়’।

শামীমা বিনতে রহমান: ও! আপনাদের কথা হয়েছে তাহলে? এটা কিন্তু গণমাধ্যমে আসেনি।

অজয় রায়:  উনি দেননি, আমি তো আর দিতে পারি না। শুধু তাই না, এরা কেন লুকোচুরি করছে, তা জানি না। আমার সঙ্গে অন্তত চারজন মন্ত্রী দেখা করেছে। মুহিত ভাই (আবুল মাল আবদুল মুহিত, অর্থমন্ত্রী), ‍তিনি তো আমার পুরোনো মানুষ, আমরা যখন ছাত্র ছিলাম তিনি আমাদের তিন বছরের সিনিয়র ছিলেন, এসএম হলের ভিপি ছিলেন। তার পরে ইনু (হাসানুল হক ইনু, তথ্যমন্ত্রী) এসছিলেন, রাশেদ খান মেনন (বেসামরিক বিমান চলাচলমন্ত্রী) এসছিলেন, আমার ছাত্র, সাংস্কৃতিককর্মী নূর (আসাদুজ্জামান নূর, সংস্কৃতিমন্ত্রী) এসছিল। কেউ কিন্তু বিষয়টা প্রচার মাধ্যমে, গণমাধ্যমে দেয়নি। কিন্তু কেউ প্রচারমাধ্যমে দেয়নি কেন? কেন এই লুকোচুরিটা করছেন ওনারা, জানি না।

শামীমা বিনতে রহমান: আপনি ভালো বলতে পারবেন...

অজয় রায়: আমি তো জানি না। আমার পক্ষে তো বলা মুশকিল, কেন তারা মিডিয়ায় দেয় নাই। এখন তোমরা দিতে পার, (হাসি) তোমরা যদি চাও।

তিনি হয়ত ব্যক্তিগতভাবে কথা বলেছেন, মানে প্রাইম মিনিস্টার হিসেবে হয়ত বলেননি।

শামীমা বিনতে রহমান: না, আপনাদের তো পরিচয় অনেক পুরনো সম্পর্ক তার সঙ্গে

অজয় রায়: অনেক দিনের পরিচয়

শামীমা বিনতে রহমান: এবং অনেক পুরোনো সম্পর্ক। আমরা এখন তদন্তের বিষয়ে একটু ফেরত যেতে পারি, আচ্ছা তার আগে আমাকে একটু বলবেন কি- অভিজিতের স্ত্রী রাফিদা রহমান বন্যা, উনি কেমন আছেন এখন?

অজয় রায়: খুব সম্ভব এখন মিনেসোটাতে আছে, ওখানে একটা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। সেখান থেকে কালকে না পরশুদিন কথা হয়েছিল। ও বোধ হয় আরেকটা হাসপাতালে এখন এসেছে। ওর তো বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা নিতে হবে। তো ওর বোনরা ওকে টেইকিং কেয়ার অব (দেখভাল করছেন)। আর ওর মেয়েটি, বন্যার ও অভিজিতের মেয়েটি জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। তো এখন ওর খালার বাসায় আছে আপাতত। আমার সঙ্গে কথা হয়েছিল পরশুদিন।

শামীমা বিনতে রহমান: বন্যার এখন কোনও অপারেশন বা এধরনের কোনও ...

অজয় রায়: না, ওর অপারেশন হয়েছে কিছু। আর বুড়ো আঙ্গুল যেটা কেটে গেছে সেইটা আর জোড়া দেওয়া যাবে না। ওরা প্লাস্টিক সার্জারি করে বুড়ো আঙ্গুলে আর্টিফিসিয়াল বৃদ্ধাঙ্গুল লাগিয়ে দেবে।

শামীমা বিনতে রহমান: এখন যে প্রশ্ন, সেটা হচ্ছে অভিজিৎ হত্যাকাণ্ড তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে আপনার কী মনে হচ্ছে?

অজয় রায়: আমার পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, আই অ্যাম নট স্যাটিসফাইড উইথ দ্য প্রগ্রেস অব দ্য এনকোয়ারি অব দ্য কিলিং অব অভিজিৎ। একমাত্র সারফেসে যেটা দেখা যাচ্ছে যে ফারাবী নামে একটা উন্মাদকে তারা ধরেছে, যে অভিজিৎকে বহুবার থ্রেট করেছে। তাকেই কেবল হত্যার জন্য অ্যারেস্ট করেছে, আর ফারাবীর সিলেটের যে বাড়ি, যেখানে তার মা-বোনরা থাকে, সেইটাতে তল্লাশি চালিয়েছে।

যদিও আগে থেকেই হয়ত খবর পেয়েছে, মা-বোনরা ওখান থেকে সরে গেছে। বাড়িটা তালাবদ্ধ পায়। তারপরে পুলিশ তালা ভেঙে ওর বাড়ি সার্চ করে এবং কিছু ওই ইসলামী কাগজপত্র, ল্যাপটপ আর অনান্য কিছু ম্যাটেরিয়াল পেয়েছে, তারা সিজ করে নিয়ে গেছে। এইটুকুই আমার জানা। আর কাগজে যেটা বেরিয়েছে, এইটা আমি বলতে পারব না যে ১০/১২জন সন্দেহভাজন যারা অভিজিতের কিলিং এর সাথে (জড়িত বলে সন্দেহ) তাদেরকে নজরদারিতে রেখেছে। এই শব্দের অর্থ কী আমি জানি না। নজরদারিতে রেখেছে মানে কী? তাদেরকে চিনতেছে, কিন্তু ধরছে না?

শামীমা বিনতে রহমান: আচ্ছা, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় তদন্ত সংস্থা এফবিআই, এফবিআইয়ের তদন্ত বা তাদের সংশ্লিষ্টতা আপনাকে কি আশাবাদী করে তুলছে? 

অজয় রায়: আমি এফবিআইকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তোমরা আসছ কেন? এইটা কি-বিকজ অ্যামেরিকান সিটিজেন ইজ ইনভলবড? বলল, ইয়েস আমরা সেই জন্যই এসেছি। বাংলাদেশের নরমাল সিটিজেন হলে আমরা তো আসতাম না। সিনস অভিজিৎ ইজ অ্যান অ্যামেরিকান, অ্যামেরিকান গভর্নমেন্ট হ্যাজ আ রেসপনসিবিলিটি টু ফাইন্ড আউট দ্য কিলার। সেই জন্যই আমাদেরকে পাঠিয়েছে।

আমরা (এফবিআই) কেবল বাংলাদেশ গভর্নমেন্টকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, তখন বাংলাদেশ গভর্নমেন্টেরও কোনও গত্যন্তর ছিল না না করার। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বললেন, যে এফবিআই আসতে আমাদের কোনও আপত্তি নেই।

শামীমা বিনতে রহমান: এই মামলার ভবিষ্যত নিয়ে আপনার ভেতরে কি কোনও ভাবনা তৈরি হয়েছে, কোনও আশাবাদী ভাবনা?

অজয় রায়: আমি বিশ্বাস করি আমাদের বাংলাদেশ সরকারের যে গোয়েন্দা বিভাগ আছে ওরা যাদি চায়, এই চাওয়াটা কতটা, সেইটাই অনেক সময় প্রশ্নবোধক। ওরা যদি চায় মাটির গভীর থেকে ওরা আসল হত্যাকারীদের ধরে ফেলতে পারে।