‘হামলার সময় দাঁড়িয়ে দেখছিল পুলিশ’

লেখক অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যার সময় পুলিশ কাছাকাছি স্থানে থেকে দেখলেও হামলাকারীদের ঠেকাতে এগিয়ে আসেনি বলে অভিযোগ করেছেন তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 March 2015, 04:56 AM
Updated : 11 March 2015, 11:30 AM

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় ওই সন্ত্রাসী হামলায় বন্যাও আহত হন। চিকিৎসার জন্য বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে আছেন তিনি।

বুধবার ফেইসবুকে পোস্ট করা এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, “যখন অভিজিৎ ও আমার ওপর নৃশংসভাবে হামলা হচ্ছিল তখন পুলিশ কাছেই ছিল এবং তারা কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।”

খুনিদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়ে তিনি লিখেছেন, “হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনতে বাংলাদেশ সরকারের কাছে সামর্থ্য অনুযায়ী সব কিছু করার দাবি জানাচ্ছি আমরা।”

গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে বই মেলা থেকে ফেরার পথে টিএসসি মোড় পেরিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সংলগ্ন ফুটপাতে সন্ত্রাসীদের চাপাতির কোপে আহত হন অভিজিৎ ও বন্যা। তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর কিছুক্ষণের মধ্যে অভিজিৎকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা। চাপাতির আঘাতে একটি আঙুল হারিয়েছেন বন্যা।

যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী প্রকৌশলী অভিজিৎ মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা। ব্লগের পাশাপাশি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে নিয়মিত লিখতেন তিনি। সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে লেখালেখির জন্য ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের হুমকি পেতে হয়েছিল তাকে।

অভিজিৎ বিজ্ঞান ও যুক্তির আলোকে লিখে ধর্মীয় মৌলাবাদীদের সমালোচনা করতেন বলেই ‘তাকে হত্যা করা হয়েছে’ বলে মন্তব্য করেন বন্যা, যিনি নিজেও একজন ব্লগার।

বন্যার সঙ্গে সর্বশেষ কথার ভিত্তিতে তার শ্বশুর অধ্যাপক অজয় রায় বলেছেন, খুনিদের দেখলে বন্যা চিনতে পারবেন বলে তাকে জানিয়েছেন।

বন্যাকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, “হামলাকারীরা অন্তত পাঁচজন ছিল, তাদের বয়স ছিল ২৫/২৬ বছর। তাদের প্রত্যেকের পরনে জিন্সের প্যান্ট ও গেঞ্জি ছিল। তাদের মুখে কোনো দাড়ি ছিল না।”

অবশ্য বিবিসিকে এক সাক্ষাতকারে বন্যা বলেছেন, ঘটনার অনেক কিছুই তার স্পষ্ট মনে নেই।

“আমার কিছুই মনে নেই। মনে আছে আমি একটি গাড়িতে। আমার পুরো শরীর রক্তে ভিজে ছিল। আমি নিশ্চিত নই, সম্ভবত অভিজিতের মাথা আমার কোলো ছিল। আর আমি কোনে একজনকে বলছিলাম, আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন। এটাই আমার মনে পড়ছে।”

হামলার বিষয়টি কখন বুঝতে পারলেন- এমন প্রশ্নে বন্যা বলেন, “ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে অনেক মানুষ এসেছিল, আমি বারবার জ্ঞান হারাচ্ছিলাম। আমার জন্য অনেক কঠিন সে সময়টার কিছু মনে করা। এখনো আমার হৃদপিণ্ডের ক্রিয়া বেড়ে যাচ্ছে।”

হাসপাতালে সেই রাতের কথা মনে করে তিনি বলেন, “প্রথম যেটা বুঝতে পারলাম, আমার একটি হাতের বুড়ো আঙুল নেই। আমার মাথায় কয়েকটি আঘাত। আর আমি রক্তে ভেজা। অভিজিতকে দেখলাম, আমার পাশে একটি স্ট্রেচারে শুইয়ে রাখা হয়েছে। যখনই ডাক্তাররা আসছিলেন, আমি বলছিলাম, প্লিজ আগে ওকে দেখেন, কারণ আমার অবস্থা ওর চেয়ে ভালো। সেটাই প্রথম যখন আমি বুঝতে পারলাম কি হয়েছে।”

বন্যা জানান, অচেতন অবস্থায় অভিজিৎ মাঝে মধ্যে শব্দ করছিলেন। তারপর তাকে ভেতরে (অপারেশন থিয়েটার) নিয়ে যাওয়া হয়। অভিজিতের বিষয়ে আর কিছু মনে করতে পারেন না তিনি।

এই স্থানটিতে হামলা হয় অভিজিৎ রায় ও তার স্ত্রীর ওপর

রাফিদা আহমেদ বন্যা (হামলার পর হাসপাতালে)

এই আঘাতের পরও ধর্মনিরপেক্ষতা ও বিজ্ঞানের পক্ষে কথা বলা না থামানোর প্রত্যয় জানান মুক্তমনা এই ব্লগার।

“আমি যখন ছোট ছিলাম, আশির দশকে, তখনই আমি ধর্মীয় বিশ্বাসের ব্যাপারগুলো নিয়ে পড়তাম। আমার পরিবার, বন্ধু-বান্ধব সবাই বিষয়গুলো জানে। তারা বলতো, ঠিক আছে ও একটু ব্যতিক্রম। কিন্তু নাস্তিকতা কখনোই অপরাধের পর্যায়ে ছিল না। কিন্তু গত কয়েক বছরে যেভাবে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার উত্থান হয়েছে, তাতে বলতেই হবে ধর্মান্ধতা এখানে একটি শক্ত মূল বিকশিত করেছে।”

ফেইসবুকে বন্যা লিখেছেন, ঐতিহাসিকভাবে প্রগতিশীল আন্দোলনের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের পরিচিতি রয়েছে। এখানেই অভিজিৎ বেড়ে উঠেছে।

“হত্যার হুমকি সত্ত্বেও আমরা কখনো ভাবিনি যে এ ধরনের একটি জায়গায় এমন জঘন্য অপরাধ ঘটতে পারে। এটা এমন অপরাধ যা শুধু একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়, বাক স্বাধীনতা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ।”

শুধু হত্যাকারীদের ধরেই সরকারের কাজ শেষ হবে বলে মনে করেন না রাফিদা আহমেদ বন্যা।

“সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি হামলাকারীদের পার পাওয়ার সংস্কৃতি, যেখানে লেখকরা খুন হলেও খুনিদের বিচার হয় না, বন্ধ করতে আমি সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।”

অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডে তার বাবা অজয় রায় মামলা করেছেন, যার তদন্ত করছে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।

তারা এখন পর্যন্ত ইন্টারনেটের মাধ্যমে ধর্মীয় উগ্রবাদের প্রচারক ফারাবী শফিউর রহমানকে গ্রেপ্তার করেছেন, যিনি ফেইসবুকে অভিজিৎকে হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন।

তবে রিমান্ডে নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি বলে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অভিজিৎকে হত্যার ঘটনাটি তদন্তে কাজ করছে এফবিআইও। হত্যাকাণ্ডের আলামত তাদের পরীক্ষাগারে পরীক্ষার জন্য ইতোমধ্যে হস্তান্তর করা হয়েছে।