শুনানিতে ‘তাড়াহুড়া’ চান না কামারুজ্জামানের কৌঁসুলিরা

জামায়াতে ইসলামীর নেতা মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ডাদেশের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন জানিয়েই শুনানিতে পিছটান দিয়েছেন তার আইনজীবীরা।

সুলাইমান নিলয়বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 March 2015, 02:09 PM
Updated : 5 March 2015, 02:14 PM

পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর মৃত্যু পরোয়ানা জারির চতুর্দশ দিনে বৃহস্পতিবার ১১টার পরে আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিভিউ আবেদন জমা দেন কামারুজ্জামানের আইনজীবী জয়নাল আমিন তুহিন।

বেলা ১টার পর রিভিউটি ওই শাখার তালিকাভুক্ত হয়, যার মাধ্যমে রিভিউটি আনুষ্ঠানিকভাবে দায়ের হয়।

এই আনুষ্ঠানিকতার আগেই সুপ্রিম কোর্টে সংবাদ সম্মেলনে আসেন কামারুজ্জামানের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন, তাজুল ইসলাম ও শিশির মনির।

যেখানে সম্ভাষণ ও সমাপনী বক্তব্য তাজুল দিলেও মূল বক্তব্য রাখেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন, যিনি বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদে রয়েছেন।  

সংবাদ সম্মেলনের এক পর্যায়ে খন্দকার মাহবুব বলেন, “হাজার হাজার মামলা বিচারাধীন আছে। মৃত্যুদণ্ডের অনেক মামলা বিচারাধীন আছে। এক্ষেত্রে যদিও রায়ে রিভিউ দ্রুততার সঙ্গে নিষ্পত্তির বাধ্যবাধকতা রয়েছে, সেখানেও একটা কিন্তু আছে।

“সেক্ষেত্রে আমরা বলব, এখন দেশে একটা অস্থির পরিবেশ বিরাজ করছে। আমরা যারা আইনজীবী আছি, অনেকেই রাতে বাড়িতে ঘুমাতে পারি না। অনেকেই শঙ্কিত। রিভিউ পিটিশন শুনানিতে আসার ব্যাপারে মাননীয় আদালত তাড়াহুড়া করবেন না, সেই আবেদন আমরা করব। আমরা আশা করি, আদালত আমাদেরকে সেই সুযোগ দিবেন।”

অন্য এক সংবাদ সম্মেলনে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, রিভিউয়ের শুনানি দ্রুত নিষ্পত্তি করতে আব্দুল কাদের মোল্লার রায়েই উল্লেখ আছে।

“সেখানে বলা আছে, এটা আপিল না। এটা পুনঃশুনানির বিষয় না। আদালতের যদি কোনো ভুল থাকে, সেটা যেন আদালত শুধরে নিতে পারে, সে জন্যই এই বিধান। রিভিউর বিধান আইনে নাই। রায়ে এটা দেওয়া আছে। একই রায়ে বলা আছে, দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে।”

দুই পক্ষের সংবাদ সম্মেলনের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম রাষ্ট্রপক্ষের অন্য আইনজীবীদের নিয়ে চলে যান চেম্বার বিচারপতির আদালতে।

আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে থেকে নামার পর তাদেরই একজন (সাধারণ সর্বকনিষ্ঠজন) চেম্বার বিচারপতি হিসাবে ভিন্ন একটি কক্ষে আসন গ্রহণ করেন।

আপিল বিভাগে অনুমতিপ্রাপ্ত আইনজীবীরাই এখানে শুনানিতে অংশ নিতে পারেন। তবে অন্য আইনজীবীরাও এই আদালতে যেতে পারেন। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের একমাত্র এই আদালত কক্ষেই সাংবাদিকরা ঢুকতে পারেন না।

সেখানে বিভিন্ন মামলায় হাই কোর্ট ও আপিল বিভাগের মূল বিচার কাজের মধ্যবর্তী স্থানে সংযোগ স্থাপনকারী ভূমিকায় নানা আবেদন শোনেন চেম্বার বিচারপতি।

সাধারণত দুপুর ১টার পর চেম্বার বিচারপতি এজলাসে আসন গ্রহণ করলেও এক আইনজীবীর জানাজার কারণে এদিন কিছুটা দেরি হয়।

এ সময় আসামিপক্ষের আইনজীবী শিশির মনির, তরিকুল ইসলাম তারিককে অনেকক্ষণ সেখানে দেখা যায়। চেম্বার আদালতে কামারুজ্জামানের মামলার বিষয়টি শুনতে এসেছেন বলেও তারা সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসার জবাবে জানান।

শুনানির জন্য নিয়মিত আইনজীবীদের পরিবর্তে অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড জয়নাল আবেদীন থাকবেন বলেও তারা জানান।

এই আদালতে শুনানির পর বেরিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চেম্বার আদালতে শুনানিতে আসামিপক্ষের কোনো আইনজীবী ছিলেন না। আমরা বলেছি, এটা শুনানি হওয়া দরকার। আদালত বলেছে রোববার তারিখ জানিয়ে আদেশ দেওয়া হবে।”

যুদ্ধাপরাধ মামলার আইনজীবীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে শুনানিতে দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টির অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে দ্রুত শুনানি করতে ট্রাইব্যুনাল এবং আপিল বিভাগ তাদেরকে তাগিদও দিয়েছে।

কখনও কখনও শুনানি দ্রুততর করতে আদালতে থেকে রাষ্ট্রপক্ষের প্রতিও তাগাদা এসেছে।

‘আসামি পক্ষের বক্তব্য অবমাননা’

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, আসামি পক্ষে রিভিউ দায়ের করেই যদি আইনজীবীরা বলেন ‘রায় বদলে যাবে’, তাহলে তো কোনো কথা বলার থাকে না। এ ধরনের কথা কোনো আইনজীবীর বলা ঠিক না।

“আদালতে রিভিউ দায়ের করা হয়েছে, এখন সে মামলায় বিচারকরা দেখবেন, এখানে কী করা যায়। এটা রিভিউযোগ্য আদেশ কি না, সত্যিকার অর্থেই প্রতিকার পাবেন কি না।”

আপিলের রায়ে কামারুজ্জামানকে যাবজ্জীবন প্রদানকারী বিচারকের মতো করে অন্যরা সাক্ষ্য পর্যালোচনা করলে রায় ভিন্ন হত-আসামিপক্ষের এমন বক্তব্য দৃষ্টিতে আনলে মাহবুবে আলম বলেন, “একজন মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামির মাথা ঠিক নাও থাকতে পারে বা তিনি একটা উদভ্রান্তির মধ্যে কথা বলতে পারেন বা অনেক সময়ে নানা রকম কথা বলতে পারেন। উনি তো জেলের ভিতরে।

“তার এই কথাগুলো বাইরে এসে তার আইনজীবী যেভাবে মিডিয়ার সামনে বলছে, এটা তো আইনজীবীদের আদালত অবমাননা হয়।”

“দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির বিষয়ে আমি কোনো বক্তব্য দিতে চাই না। কারণ উনি সত্যিকার অর্থে এসব কথা বলেছেন কি-না, সেটাও একটা বিচার্য বিষয়। কিন্তু একজন আইনজীবী কি আদালত সম্পর্কে এই ধরনের কথা বলতে পারেন?”

ঘুরে ফিরে পুরনো যুক্তি

রিভিউ আবেদনে ৪৪টি যুক্তি দেখানো হয়েছে বলে আসামি পক্ষের আইনজীবীরা জানালেও কোন যুক্তিতে রিভিউ করা হয়েছে- সেই প্রশ্নে পুরনো যুক্তিই সাংবাদিকদের কাছে তুলে ধরলেন খন্দকার মাহবুব।

সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিক এক পর্যায়ে বলেন, “এই যুক্তিগুলো তো আপনারা ট্রাইব্যুনালে বলেছেন, আপিল বিভাগেও বলেছেন।”

এ সময় ওই সাংবাদিককে থামিয়ে দেন খন্দকার মাহবুব। তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, “তাহলে কি আপনি রিভিউর বিধান রাখতে চাচ্ছেন না?”

তিনি বলেন, “আদালত অনেক ক্ষেত্রে অনেক সাক্ষ্য-প্রমাণ নজরে আসে না। এ কারণেই রিভিউ বিধান রাখা হয়েছে। নতুবা আদালত রায় দিয়েছে, সেটা শেষ হয়ে যেত। রিভিউ করা হচ্ছে, রায়টা দেওয়ার পর আইনজীবীরাও পড়বেন, তারাও পড়বেন। পড়ে তারা যদি বিবেচনা করেন, এই ক্ষেত্রে সঠিক মূল্যায়ন হয়নি, করবেন।”

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চান খন্দকার মাহবুব

স্বাধীনতার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সঙ্গে যুক্ত খন্দকার মাহবুব এখন মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিতদের পক্ষে দাঁড়িয়েও দাবি করেছেন, তিনি যুদ্ধাপরাধের বিচার চান। 

“আমরা বারবার বলেছি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই। সত্যিকার যুদ্ধাপরাধী যারা, তাদের বিচার চাই। বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তানিদের ১৯৫ জন সৈনিককে যুদ্ধাপরাধী হিসাবে সনাক্ত করেছিল, তাদের বিরুদ্ধে হত্যা, নারী নির্যাতনের অভিযোগ ছিল। যেভাবেই হোক তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।”

“তারপর অনেকদিন পর হঠাৎ করে বিচারের নামে বিচার শুরু হয়েছে। বিচারে আমাদের আপত্তি নাই। পদ্ধতিগত বিষয়ে সারা পৃথিবীতে একটা বিতর্ক রয়েছে, আমারও দ্বিমত রয়েছে।”

নিজের অবস্থানের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে খন্দকার মাহবুব বলেন, “একজন আইনজীবী কোনো অপরাধ সমর্থন করেন না। উনি যখন খুনের আসামির জন্য আদালতে যান, উনি খুনকে সমর্থন করেন না। উনি দেখেন, আইনের বিধান অনুসারে বিচার হচ্ছে কি না।”

কামারুজ্জামানের বিষয়ে তিনি বলেন, “তখন (একাত্তরে) তার বয়স ছিল ১৯ বছর। উনি এইচএসসি ক্লাসের একজন ছাত্র ছিলেন। পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীর সামনে তার নাকি বিশাল নেতৃত্ব ছিল। এটাই আজকে প্রশ্ন উঠেছে।”

খন্দকার মাহবুব বলেন, রিভিউয়ের মানে এই নয় যে তারা আদালতকে অনাস্থা জানাচ্ছেন।

“আমরা বিনয়ের সঙ্গে বলছি, সাক্ষী প্রমাণ পর্যালোচনার ক্ষেত্রে বিচারকগণ হয়ত সঠিকভাবে মূল্যায়ন করেননি। করলে রায় হয়ত ভিন্ন হত।”

“আমরা বিদেশে দেখি, ৭০ পর আবার বিচার হয়েছে। ফাঁসি হওয়ার পর দেখা গেল নির্দোষ। আমাদের দেশে এই ধরনের ঘটনা যাতে না হয়, সে জন্য মাননীয় আদালতের কাছে বলব, আপনারা সঠিকভাবে সাক্ষী প্রমাণ মূল্যায়ন করুন।”