যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামানের রিভিউ আবেদন

যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া জামায়াত নেতা মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের আইনজীবীরা সর্বোচ্চ আদালতের দেওয়া চূড়ান্ত রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) জন্য আবেদন করেছেন।

সুপ্রিম কোর্ট প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 March 2015, 06:25 AM
Updated : 5 March 2015, 08:15 AM

কামারুজ্জামানের আইনজীবী শিশির মোহাম্মদ মনির বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের জানান, রায় রিভিউয়ের জন্য তারা সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় আবেদন জমা দিয়েছেন।

ওই আবেদন নথিভুক্ত হওয়ার পর ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একরামুল হক টুটুল জানান, তারা এ বিষয়ে শুনানির দিন ধার্যের জন্য চেম্বার বিচারপতির আদালতে যাচ্ছেন।

আগের দিন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামানের সঙ্গে দেখা করেন শিশির মনিরসহ পাঁচ আইনজীবী। তারা কারাগরে কথা বলেন প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা।

কামারুজ্জামানের অন্যতম আইনজীবী তাজুল ইসলাম পরে সাংবাদিকদের বলেন, আপিল বিভাগের রায়ে একজন বিচারক দণ্ডের বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছিলেন, তার পয়েন্টগুলো ধরেই তারা রিভিউ আবেদন করছেন।

আর বৃহস্পতিবার রিভিউ আবেদন জমা দেওয়ার পর কামারুজ্জামানের প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, “আমরা ৪৪টি যুক্তিতে ৪৫ পৃষ্ঠার রিভিউ আবেদন দিয়েছি। আমরা মনে করি, যুক্তিগুলো বিবেচনা করে দেখলে আদালতের রায় ভিন্ন হতে পারে।”

১৯৭৩ সালে দালাল আইনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গঠিত আদালতের প্রধান প্রসিকিউটর ছিলেন খন্দকার মাহবুব হোসেন। এখন তিনি যুদ্ধাপরাধ মামলায় লড়ছেন জামায়াত নেতাদের পক্ষে, যে দলটি একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতায় যুদ্ধাপরাধে অংশ নেয় বলে ট্রাইব্যুনালের রায়ে উঠে এসেছে। 

বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার মাহবুব  বলেন, “আপিল বিভাগে হাজার হাজার মামলা বিচারাধীন। দেশের পরিস্থিতিও ভিন্ন রকম। আমরা আইনজীবীরা অনেকে এখন বাড়িতে থাকতে পারি না। এ অবস্থায় পর্যাপ্ত সময় দিয়ে এ আবেদনের নিষ্পত্তি করা হবে বলে আমরা আশা করি।”

একাত্তরে ময়মনসিংহের আল বদর প্রধান কামারুজ্জামানকে ২০১৩ সালের ৯ মে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদণ্ড দেয়। গতবছর আপিল বিভাগও তার ফাঁসির আদেশ বহাল রাখে।

ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের পর গত ১৯ ফেব্রুয়ারি তার মৃত্যু পরোয়ানায় সই করেন ট্রাইব্যুনাল-২ এর তিন বিচারক। এরপর মৃত্যু পরোয়ানা পাঠিয়ে দেওয়া হয় কারাগারে, কামারুজ্জামানকে তা পড়ে শোনানো হয়। 

নিয়ম অনুযায়ী, রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের দিন থেকে ১৫ দিনের মধ্যে রিভিউ আবেদন করা যায়। আর আসামিপক্ষ রিভিউ আবেদন করায় মৃত্যু পরোয়ানার কার্যকারিতা স্থগিত হয়ে গেছে বলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম জানান।

রিভিউ মীমাংসার পর যে সিদ্ধান্ত হয়, তা কার্যকর হবে বলে এর আগে জানিয়েছিলেন আইনমন্ত্রীসহ আইনজীবীরা।

কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে মোট সাতটি অভিযোগ ছিল। এর মধ্যে তৃতীয় ও চতুর্থ অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল তাকে ফাঁসির আদেশ দেয়। এর মধ্যে তৃতীয় অভিযোগে সোহাগপুর গণহত্যা ও ধর্ষণ এবং চতুর্থ অভিযোগে গোলাম মোস্তফা তালুকদারের হত্যার ঘটনা রয়েছে।

প্রথম অভিযোগে শেরপুরের নালিতাবাড়ির কালীনগরের বদিউজ্জামানকে হত্যা এবং সপ্তম অভিযোগে রোজার দিনে টেপা মিয়ার ছেলেসহ পাঁচজনকে হত্যার কথা রয়েছে। এ দুই অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল তাকে যাবজ্জীবন দেয়।

এছাড়া শেরপুর কলেজের তৎকালীন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রভাষক সৈয়দ আব্দুল হান্নানকে নির্যাতনের ঘটনায় দ্বিতীয় অভিযোগে তার ১০ বছরের সাজা হয়।

পঞ্চম ও ষষ্ঠ অভিযোগ থেকে কামারুজ্জামানকে খালাস দেয় ট্রাইব্যুনাল।

আপিলের রায়ে প্রথম অভিযোগ থেকে কামারুজ্জামানকে খালাস দেয়া হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে দ্বিতীয় ও সপ্তম অভিযোগে সাজা বহাল থাকে।

তৃতীয় অভিযোগে আসামির অপরাধের বিষয়ে চার বিচারপতি একমত হলেও মৃত্যুদণ্ডের রায় আসে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে।

বিচারপতি ওয়াহহাব মিয়া সোহাগপুর গণহত্যায় কামারুজ্জামানকে অভিযুক্ত করলেও এ অভিযোগে তিনি তাকে যাবজ্জীবন দণ্ডের পক্ষে মত দেন। সেই সঙ্গে ১, ২, ৪, ৭ নম্বর অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া দণ্ড থেকে কামারুজ্জামানকে খালাস দেওয়ার পক্ষে মত দেন তিনি।

আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি (বর্তমানে প্রধান বিচারপতি) এসকে সিনহা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও  বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী সর্বোচ্চ সাজার পক্ষে মত দিলে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে আসামির দণ্ড নির্ধারিত হয় মৃত্যুদণ্ড।

চতুর্থ অভিযোগে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে কামারুজ্জামানকে দোষী সাব্যস্ত করা হলেও মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন করা হয়।

এর আগে আপিল বিভাগে আসা যুদ্ধাপরাধের প্রথম মামলায় জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবনের সাজা বাড়িয়ে প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়। তার রিভিউ আবেদন খারিজ হয়ে গেলে দণ্ড কার্যকর করা হয় ১২ ডিসেম্বর।

আর আপিলে আসা দ্বিতীয় মামলায় জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির দণ্ড কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয় সর্বোচ্চ আদালত, যার পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি এখনো প্রকাশিত হয়নি।