খালেদাহীন শুনানিতে যা হল

গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রত্যাহারে খালেদা জিয়ার আবেদনের শুনানিতে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ে জড়িয়েছেন দুদক ও আসামিপক্ষের আইনজীবীরা, যার শেষ হয়েছে পরোয়ানা বহাল রাখার আদেশে।  

প্রকাশ বিশ্বাসপ্রকাশ বিশ্বাসবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 March 2015, 12:43 PM
Updated : 4 March 2015, 12:44 PM

খালেদার আইনজীবীরা বিচারককে উদ্দেশ্য করেও শুনানিতে তীর্যক মন্তব্য করেন যা অবমাননার শামিল বলে উল্লেখ করেন ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ আবু আহমেদ জমাদার। 

৫ জানুয়ারি কার্যালয় থেকে বের হতে বাধার মুখে খালেদা জিয়া

এক সপ্তাহ আগে তিনিই জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট ও জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। এরপর থেকেই খালেদা গ্রেপ্তার হচ্ছে কি না- সে আলোচনা চলছে সারা দেশে।  

আদালতের পরোয়ানা সাত দিনেও থানায় না যাওয়ায় গ্রেপ্তার হননি বিএনপি চেয়ারপারসন; তিনি আত্মসমর্পণও করেননি। তার বদলে পরোয়ানা প্রত্যাহারসহ কয়েকটি আবেদন করেন তার আইনজীবীরা, যা নিয়ে বুধবার প্রায় দুই ঘণ্টা শুনানি হয়।     

বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বকশীবাজার এলাকার আলিয়া মাদ্রাসা সংলগ্ন মাঠে অস্থায়ী এজলাসে এ দুই মামলার কার্যক্রম শুরু হয় খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতেই।

শুরুতে তার অন্যতম আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া পাঁচ মিনিট সময় নিয়ে কার কার পক্ষে কি কি আবেদন করেছেন তা বিচারককে জানান।

‘শুনানি সম্ভব?’

শুরুতেই গ্রেপ্তারি পেরোয়ানা প্রত্যাহারে খালেদার আবেদনের ওপর শুনানি শুরু হয়। এর পাশাপাশি আদেশ সংশোধন, জামিন বহাল রেখে তার পক্ষে আইনজীবকে প্রতিনিধিত্ব করতে দেওয়া এবং সাক্ষ্য পেছানোর আবেদন করেন তার আইনজীবীরা।

এছাড়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদার বড় ছেলে তারেক রহমানের অনুপস্থিতিতে আইনজীবীর মাধ্যমে হাজিরা এবং এ মামলার আসামি বিআইডব্লিউটিএর নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জিয়াউল ইসলাম মুন্না এবং ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খানের জামিনের আবেদনও দেওয়া হয়।

গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর আসামির অনুপস্থিতিতে কীভাবে এ সব আবেদনের শুনানি সম্ভব আসামিপক্ষের আইনজীবীর কাছে তা জানতে চান বিচারক।

উত্তরে সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, “আমরা তাকে (খালেদা জিয়াকে) আদালতে আসার কথা অথবা পরোয়ানার ব্যাপারে জানাতে পারিনি।”

এরপর বিচারক রাষ্ট্রপক্ষে দুদকের আইনজীবী মেশাররফ হোসেন কাজলের কাছে জানতে চান- এ বিষয়ে আইনে কী আছে।

কাজল বলেন, “গত ২৫ ফেব্রুয়ারি পরোয়না জারির পর তিনি এ পর্যন্ত আদালতে আসেননি । ওয়ারেন্টের কথা  জেনেও যেহেতু ম্যাডাম আদালতে আসেননি সেহেতু পলাতক আসামির পক্ষে এ সব দরখাস্তের শুনানির কোনো আইনি এখতিয়ার নেই।”

এরপর খালেদার পক্ষে শুনানি শুরু করেন সাবেক এটর্নি জেনারেল এ জে মোহাম্মদ আলী ।

তিনি বলেন, “মিডিয়া ট্রায়াল করা হচ্ছে , যা বিচারকের আদেশে রিফ্লেক্ট হচ্ছে। আমরা গত তারিখে এই বিচারকের প্রতি অনাস্থা জানিয়েছিলাম এবং উচ্চ আদালতে গিয়েছি। আগামীকাল তা শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।”

‘মাংকি বিজনেস’ 

শুনানির এ পর্যায়ে আসামিপক্ষের অন্যতম আইনজীবী ব্যরিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন চিৎকার করে বলে ওঠেন, “এটা মাংকি বিজনেস। এটার নাম বিচার না।”

জবাবে দুদকের অন্যতম আইনজীবী আশরাফুল হক জর্জ বলেন, “হোয়াই ইউ শাউটিং লাইক এ মাস্তান?”

উত্তেজনা কিছুটা কমলে মোহাম্মদ আলী বলেন, জামিন বাতিল করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আগে কারণ দর্শাও নোটিস দেওয়াসহ যেসব পদক্ষেপ পার হয়ে আসতে হয়, খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে তা করা হয়নি।

“আমরা প্রথমে দেখলাম পরোয়ানা থানায় পাঠানো হয়েছে। পরে দেখলাম তা সেখানে যায়নি।”

‘আদালত ক্লাস রুম নয়’

খালেদার পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে এক পর্যায়ে ফৌজদারি কার্যবিধি নিয়ে বক্তৃতা শুরু করেন মোহাম্মদ আলী।

আসামির ব্যক্তিগত হাজিরা মওকুফ করে কীভাবে আইনজীবীর মাধ্যমে তাকে বিচারের মুখোমুখি করা যায় এবং এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে উচ্চ আদালত কী কী সিদ্ধান্ত দিয়েছে সবিস্তারে তার বর্ণনা শুরু করেন তিনি।

এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে বিচারক বলেন, “প্লিজ, ইটস নট এ ক্লাসরুম। এটা ইউনিভার্সিটি বা কলেজ নয়। আমরা আপনার ছাত্র না। দয়া করে ক্লাস নেবেন না।”

মোহাম্মদ আলী এ সময় কিছু বলতে চাইলে তার মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে মাহবুব উদ্দিন খোকন ক্ষোভের সঙ্গে বলতে থাকেন, “ইটস আনফরচুনেট। কোর্টের কাছে আমরা এ রকম কথা আশা করি না।”

এরপর দুইপক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে আবারও  শুরু হয় উত্তেজনা।

বিচারক বলেন, “বক্তব্য সংক্ষিপ্ত করে আসল কথা বলুন।”

ব্যারিস্টার খোকন এ সময় মোহাম্মদ আলীকে ‘স্টার লইয়ার’ অভিহিত করে তাকে ‘যথাযথ সম্মান’ দেখাতে অনুরোধ করেন।

তারেক প্রসঙ্গ

মোহম্মদ আলী বালুর ট্রাক দিয়ে খালেদা জিয়ার গুলশানের কার্যালয় অবরুদ্ধ করে রাখা, রাস্তায় বোমাবাজি ও বিশৃঙ্খলা এবং ‘নিরাপত্তাহীনতার’ কথা উল্লেখ করে বিচারককে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে এর মধ্যে বিএনপি চেয়ারপারসনের আদালতে আসা সম্ভব নয়।

হাই কোর্টে খালেদার দুটি আবেদন নিষ্পত্তির অপেক্ষায় থাকার কথাও তিনি বিচারককে বলেন।

বিএনপির জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ব্যাপারে দাখিল করা দরখাস্তের বক্তব্য তুলে ধরে এই আইনজীবী বলেন, “তারেকের জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে তাকে চিরতরে শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা করছে সরকার। তার মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া হয়েছে ।”

মাত্র সাত দিনের নোটিশে লন্ডন থেকে তারেককে কীভাবে আদালতে হাজির করা সম্ভব এমন প্রশ্ন করে মোহাম্মদ আলী বলেন, “উনার ব্যক্তিগত হাজিরা মওকুফ করে এতোদিন মামলার বিচার চলেছে। কোনো বিঘœ ঘটেনি, এখনো ঘটবে না।”

‘এতক্ষণে অরিন্দম’

এ পর্যায়ে বিচারকের আদেশে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে আসেন মোশাররফ হোসেন কাজল।

তিনি বলেন, আসামিপক্ষ আরও আগেই খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত হাজিরা মওকুফ চাইতে পারতেন, কিন্তু তা তারা করেননি।

“পরোয়ানা জারি হওয়ার পর গ্রেপ্তারের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এখন আর তারা তা চাইতে পারেন না। সে লগ্ন পার হয়ে গেছে।”

খালেদার আইনজীবীদের কটাক্ষ করে দুদকের এই আইনজীবী মেঘনাদবধ কাব্য থেকে উদ্ধৃত করেন- ‘এতক্ষণে অরিন্দম কহিলা বিষাদে...।’

‘এটা অবমাননা’

শুনানি শেষে বিচারক আসামিপক্ষের আইনজীবীদের বলেন, “আপনাদের কথায় মনে হচ্ছে আমিই আসামি। আর আপনারাই হচ্ছেন বিচারক। আমাকে হিউমিলিয়েট করে বায়াসড বলছেন আপনারা। এটা তো আসলে কনটেম্পট অব কোর্ট।”

পরোয়ানা বহাল

দুই পক্ষের বক্তব্য শুনে খালেদা জিয়ার আবেদন গ্রহণ বা নাকচ না করে সব আবেদন নথিভুক্ত করেন বিচারক, যার ফলে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আগের আদেশই বহাল থাকে।  

পরে দুদকের আইনজীবী কাজল সাংবাদিকদের বলেন, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হওয়ায় খালেদা জিয়া আইনের দৃষ্টিতে পলাতক। যেহেতু তিনি আত্মসমর্পণ করেননি, সেহেতু তার কোনো আবেদন শোনার সুযোগ নেই।

“তারপরও তার পক্ষে সিনিয়র আইনজীবীরা এসেছেন। এ কারণে তাদের বক্তব্য আদালত শুনেছেন। সবগুলো আবেদন তিনি নথিভুক্ত রেখেছেন, গ্রহণ করেননি।”

তবে তারেক রহমান আগের মতোই তার আইনজীবী সানাহউল্লাহ মিয়ার মাধ্যমে হাজিরা দিতে পারবেন বলে আদেশে জানানো হয়।

এক মাস মুলতবি

জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট ও জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার সাতজন সাক্ষী এদিন উপস্থিত থাকলেও তাদের জবানবন্দি নেওয়া সম্ভব হয়নি।

বিচারক সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ৫ এপ্রিল দিন ঠিক করে আদালত মুলতবি করে দেন।

এই সাত সাক্ষী হলেন- দুদকের উপ-পরিচালক ও মামলার বাদী হারুনুর রশীদ, সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপক হারুন অর রশিদ, ক্যাশ বিভাগের কর্মকর্তা শফিউদ্দিন মিয়া, কর্মকর্তা আবুল খায়ের, প্রাইম ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম, জ্যেষ্ঠ সহকারী ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দা নাজমা পারভীন ও ভাইস প্রেসিডেন্ট আফজাল হোসেন।

গতবছর ১৯ মার্চ অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে খালেদা জিয়াসহ আসামিদের বিচার শুরু করে আদালত। ২২ সেপ্টেম্বর এতিমখানা দুর্নীতি মামলায় বাদী হারুন অর রশীদের জবানবন্দি শোনার মধ্য দিয়ে শুরু হয় সাক্ষ্যগ্রহণ।

বুধবার এতিমখানা দুর্নীতি মামলায় দ্বিতীয় সাক্ষীর বক্তব্য উপস্থাপনের কথা ছিল।

জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার ছয় আসামির কেউ এদিন আদালতে হাজির না থাকলেও দাতব্য ট্রাস্ট মামলার পাঁচ আসামির মধ্যে জিয়াউল হক মুন্না ও মনিরুল ইসলাম খান উপস্থিত ছিলেন।

প্রায় দুই ঘণ্টার শুনানিতে তারা দুজন কাঠগড়ায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন।

খালেদা প্রসঙ্গে শুনানি হওয়ায় এ দুই আসামির সঙ্গে বিচারক কোনো কথা বলেননি। কিছু জানতেও চাননি।