খালেদার পরোয়ানা বহাল

দুর্নীতির দুই মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জারি করা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বহাল রেখেছে আদালত।

আদালত প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 March 2015, 07:33 AM
Updated : 4 March 2015, 04:44 PM

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদার অনুপস্থিতিতে বুধবার প্রায় দুই ঘণ্টা শুনানি করে ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ আবু আহমেদ জমাদার পরোয়ানা প্রত্যাহারের আবেদন নথিভুক্ত রেখে আগের আদেশই বহাল রাখেন।

তবে খালেদার বড় ছেলে তারেক রহমান আগের মতোই আইনজীবীর মাধ্যমে হাজিরা দিতে পারবেন বলে আদেশে জানানো হয়।

জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট ও জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার সাতজন সাক্ষী এদিন উপস্থিত থাকলেও তাদের জবানবন্দি নেওয়া সম্ভব হয়নি। বিচারক সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ৫ এপ্রিল দিন ঠিক করে আদালত মুলতবি করে দেন।

আদেশের পর দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল সাংবাদিকদের বলেন, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হওয়ায় খালেদা জিয়া আইনের দৃষ্টিতে পলাতক। যেহেতু তিনি আত্মসমর্পণ করেননি, সেহেতু তার কোনো আবেদন শোনার সুযোগ নেই।

“তারপরও তার পক্ষে সিনিয়র আইনজীবীরা এসেছেন। এ কারণে তাদের বক্তব্য আদালত শুনেছেন। সবগুলো আবেদন তিনি নথিভুক্ত রেখেছেন, গ্রহণ করেননি।”

গ্রেপ্তারি পরোয়ানার আদেশ স্থগিতে বিচারিক আদালতের পাশাপাশি হাই কোর্টেও একটি আবেদন করেছেন খালেদা জিয়া। বৃহস্পতিবার ওই আবেদনের সঙ্গে দুর্নীতির দুই মামলায় খালেদার বিচারক পরিবর্তনের আবেদনের শুনানি হবে বলে তার আইনজীবী জানিয়েছেন।

লাগাতার অবরোধ ডেকে গত দুই মাস ধরে গুলশানের কার্যালয়ে অবস্থানরত খালেদা টানা কয়েকটি ধার্য দিনে আদালতে অনুপস্থিত থাকায় গত ২৫ ফেব্রুয়ারি বিচারিক আদালত তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।

একইসঙ্গে এতিমখানা দুর্নীতি মামলায় খালেদার ছেলে ও বিএনপির জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ৪ মার্চ আদালতে হাজির করতে তার আইনজীবীদের নির্দেশ দেওয়া হয়, যিনি চিকিৎসার কথা বলে উচ্চ আদালতের জামিনে গত ছয় বছরের বেশি সময় ধরে লন্ডনে অবস্থান করছেন।

এ দুই মামলার শুনানির আগের দিন মঙ্গলবার বিচারিক আদালতে পরোয়ানা প্রত্যাহারের আবেদন করেন খালেদা। তিনি যে এদিনও আদালতে যাবেন না, তা স্পষ্ট হয় তার আইনজীবীদের কথায়।

আত্মসমর্পণের ক্ষেত্রে কয়েকটি শর্ত তুলে ধরে খালেদার আইনজীবী ও উপদেষ্টা খন্দকার মাহবুব হোসেন মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা এবং গুলশানের কার্যালয়ে পুনরায় ঢোকার নিশ্চয়তা পেলেই আদালতে যাবেন বিএনপি চেয়ারপারসন।

 

আত্মসমর্পণ না করলে খালেদা গ্রেপ্তার হবেন কিনা- এ নিয়ে আলোচনার মধ্যেই বুধবার সকালে খালেদা জিয়ার গুলশানের কার্যালয়ে জড়ো হন সংবাদকর্মীরা। 

খালেদার প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সে সময় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বেগম খালেদা জিয়া আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আইনজীবীরা বিষয়টি দেখছেন, তাদের পরামর্শ অনুযায়ী বেগম জিয়া কী করবেন তা ঠিক হবে।”

শেষ পর্যন্ত তার অনুপস্থিতিতেই বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বকশীবাজার এলাকার আলিয়া মাদ্রাসা ও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার সংলগ্ন মাঠে নির্মিত অস্থায়ী এজলাসে দুর্নীতির দুই মামলার কার্যক্রম শুরু হয়।

শুরুতেই গ্রেপ্তারি পেরোয়ানা প্রত্যাহারে খালেদার আবেদনের ওপর শুনানি শুরু হয়। এর পাশাপাশি আদেশ সংশোধন, জামিন বহাল রেখে তার পক্ষে আইনজীবীকে প্রতিনিধিত্ব করতে দেওয়া এবং সাক্ষ্য পেছানোর আবেদন করেন তার আইনজীবীরা।

খালেদার পক্ষে শুনানি করেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এজে মোহাম্মদ আলী। সানাহউল্লাহ মিয়া, মাসুদ আহমেদ তালুকদারসহ বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা তাকে সহায়তা করেন।

খালেদার অনুপস্থিতির কারণ হিসাবে তার মোহাম্মদ আলী আদালতকে বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন ‘নিরাপত্তাজনিত কারণে’ আদালতে আসতে পারছেন না। এ আদালতের বিচারকের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে উচ্চ আদালতে আবেদন করার বিষয়টিও তুলে ধরেন তিনি।

“মিডিয়া ট্রায়াল করা হচ্ছে , যা বিচারকের আদেশে রিফ্লেক্ট হচ্ছে। আমরা গত তারিখে এই বিচারকের প্রতি অনাস্থা জানিয়েছিলাম এবং উচ্চ আদালতে গিয়েছি। আগামীকাল তা শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।”

গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পরেও খালেদার আদালতে না যাওয়ার কথা তুলে ধরে বিচারক এ সময় দুদকের আইনজীবীদের উদ্দেশে বলেন, “উনি আদালতে আসেননি। উনার আইজীবীদের এসব পিটিশন করার এখতিয়ার আছে?”

জবাবে দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, “খালেদা জিয়া আদালতে না আসায় তাদের এসব আবেদন করার কোনো এখতিয়ার নেই।”

এ সময় উভয়পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে উত্তেজনার পর আবার শুনানি শুরু হয়। দুই পক্ষের বক্তব্য শুনে খালেদার আবেদন নথিভুক্ত করে বিচারক এজলাস ছাড়েন।

ছবি: নয়ন কুমার/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

 

আদেশের পর মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, “আইনগত কোনো ভিত্তি না থাকায় আদালত খালেদা জিয়ার সব আবেদন নথিভুক্ত করেছেন।”

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দুদকের এই আইনজীবী বলেন, “পরোয়ানা বহাল থাকায় এখন যে কোনো সময় খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে। আবার যে কোনো সময় তিনি আদালতে আত্মসমর্পণ করতে পারেন।”

তিনি জানান, খালেদার আইনজীবীরা নিরাপত্তার কথা বলে অন্য কাউকে তার পক্ষে আদালতে প্রতিনিধিত্ব করতে দেওয়ার আবেদন জানালেও ‘ফৌজদারি কার্যবিধিতে এমন কোনো সুযোগ না থাকায়’ দুদকের আইনজীবীরা এর বিরোধিতা করেছেন।

বিচারকের প্রতি খালেদার অনাস্থার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে কাজল বলেন, “বিচারক বলেছেন, তিনি এমন কোনো কাজ করেননি যা এ মামলার বিচারের বিপক্ষে যেতে পারে। আর আসামিপক্ষের আইনজীবীরা উচ্চ আদালতে গেলেও অনাস্থার পক্ষে বা বিপক্ষে কোনো আদেশ আনতে পারেননি  এ অবস্থায় মামলার কাজ চালিয়ে যাওয়া ছাড়া বিকল্প নেই।”

এসব বিষয় ফয়সালা করে আসার জন্যই আদালত প্রায় এক মাসের জন্য সাক্ষ্যগ্রহণ মুলতবি করেছে বলে দুদকের আইনজীবী জানান।

আর তারেক রহমানের বিষয়ে আদেশ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “তারেকের আইনজীবীরা জানিয়েছেন তিনি এখনো এ অসুস্থ। এ কারণে তিনি আসতে পারেননি। আমরা বলেছি তাহলে তাকে আরো কিছুদিন সুযোগ দেওয়া হোক। তিনি প্রতিনিধির মাধ্যমে হাজিরা দিতে পারেন।”

 

দুই মামলা

২০১১ সালের ৮ অগাস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াসহ চার জনের বিরুদ্ধে জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা দায়ের করেন দুর্নীতি দমন কমিশনের সহকারী পরিচালক হারুনুর রশিদ।

তেজগাঁও থানার এ মামলায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে ৩ কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ আনা হয় আসামিদের বিরুদ্ধে।

২০১২ সালের ১৬ জানুয়ারি খালেদা জিয়াসহ চারজনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত  কর্মকর্তা।

এ মামলার অপর আসামিরা হলেন- খালেদার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, হারিছের তখনকার সহকারী একান্ত সচিব ও বিআইডব্লিউটিএর নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জিয়াউল ইসলাম মুন্না এবং ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খান।

এদের মধ্যে হারিছ চৌধুরী মামলার শুরু হতেই পলাতক। তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও রয়েছে।

জিয়া এতিমখানা ট্রাস্টে অনিয়মের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় অন্য মামলাটি দায়ের করে।

এতিমদের সহায়তার জন্য একটি বিদেশি ব্যাংক থেকে আসা ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয় এ মামলায়।

দুর্নীতি দমন কমিশনের সহকারী পরিচালক হারুনুর রশিদ ২০১০ সালের ৫ অগাস্ট বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে এ মামলায় অভিযোগপত্র দেন।

মামলার অপর আসামিরা হলেন- মাগুরার সাবেক সাংসদ কাজী সালিমুল হক কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী এবং প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান।

গতবছর ১৯ মার্চ অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে আদালত এ দুই মামলায় আসামিদের বিচার শুরু করে।