সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী এই লেখকের কফিনে বন্ধু, স্বজন, শুভানুধ্যায়ীদের দেওয়া ফুলে মিশে থাকল ভালবাসা; আর তাদের কণ্ঠে মিলল ক্ষোভের আঁচ, সরকারের জন্য সতর্কবার্তা।
অভিজিতের বাবা অধ্যাপক অজয় রায় বললেন, “পুত্রহারা পিতা হিসেবে বলছি, হত্যাকারীদের চিহ্নিত করা ও হত্যার কারণ উদঘাটনে সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখুন। এই হত্যাকাণ্ডকে জনগণ সরকারের দুর্বলতা হিসাবে দেখছে।”
মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করছিলেন প্রকৌশলী হিসাবে। সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্ম ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে তিনি যুক্তিনির্ভর লেখালেখি করে আসছিলেন নিয়মিত। তিনি ছিলেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের একজন নিয়মিত কলামনিস্ট।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে সঙ্গে নিয়ে বইমেলা থেকে ফেরার পথে বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলন চত্বরের উল্টো পাশে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সংলগ্ন ফুটপাতে কুপিয়ে হত্যা করা হয় অভিজিৎকে। হামলায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বন্যার একটি আঙুল।
পদার্থবিদ্যার শিক্ষক অজয় রায়ের বড় ছেলে অভিজিতের ছেলেবেলার অনেকটা সময় এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতেই কেটেছে। সেই ক্যাম্পাসেই শাহবাগ থানা থেকে মাত্র দুইশ গজ দূরে, বইমেলাফেরত মানুষের ভিড় আর চারপাশে পুলিশি পাহারার মধ্যে খুন হতে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী এই প্রকৌশলীকে।
সবার শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রোববার সকালে অভিজিতের কফিন যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে নিয়ে আসা হয়, তার আগেই সেখানে ফুল হাতে অপেক্ষায় ছিলেন বন্ধু, স্বজন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন সংগঠনের কর্মীরা।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে এ শ্রদ্ধা নিবেদন অনুষ্ঠান শুরুর পর অধ্যাপক অজয় রায়ের দীর্ঘ দিনের সঙ্গী লেখক ও সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির বলেন, “আমরা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করছি। অভিজিতের ওপর আগে থেকেই হুমকি ছিল, তারপরও দেশে ফেরার পর কেন তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়নি- সরকারের কাছে আমরা জানতে চাই।”
এ ঘটনার জন্য জঙ্গিবাদীদের দায়ী করে শাহরিয়ার কবির বলেন, “তাদের তালিকায় এক নম্বরে শেখ হাসিনা। তারপরে মুক্তমনা ব্লগার এবং আমিও আছি। তাদের যদি চিহ্নিত করা না হয়, তাহলে একদিন শেখ হাসিনাকেও হত্যা করা হবে।”
অভিজিতের লেখা ডজনখানেক বই এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে, যার বেশিরভাগই বিজ্ঞান, দর্শন, বস্তুবাদ নিয়ে। তিনি নিয়মিত ব্লগেও লিখতেন; লেখালেখির কারণে ধর্মীয়উগ্রবাদীদের হুমকিও পেতে হয়েছিল তাকে।
অভিজিতের অধিকাংশ বইয়ের প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুল বলেন, “অভিজিৎ যে লেখাগুলো রেখে গেছেন তা ভবিষ্যত প্রজন্মকে অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ার পথ দেখাবে। যতো হুমকি আসুক, আমরা সে পথ দেখানোর কাজটি করে যাব।”
অভিজিৎ খুন হওয়ার দুদিনের মাথায় প্রকাশনা সংস্থা শুদ্ধস্বরের স্বত্বাধিকারী টুটুলকেও হত্যার হুমকি দেওয়া হয়।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান বলেন, “লেখক হুমায়ুন আজাদ ও অভিজিতের হত্যা একই সূত্রে গাঁথা। এই খুনীদের দুয়েকজনকে ধরে ফাঁসি দিলেই সমস্যার সমাধান হবে না। আমাদের সামাজিকভাবে এ সমস্যার মোকাবেলা করতে হবে।”
এ হত্যাকাণ্ডে নিন্দা জানিয়ে ঘাতকদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। এ ঘটনাকে ‘কাপুরুষোচিত’অ্যাখ্যায়িত করে তদন্তে সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাবেক সভাপতি নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, “ঘটনার পর জড়িতদের চিহ্নিত করতে আন্তর্জাতিক সহায়তার আশ্বাসের কথা জানতে পেরেছি। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, রাশা যারাই সহযোগিতা করতে চায়- তা গ্রহণ করা উচিৎ।”
যারাই এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে থাকুক, জামায়াতে ইসলামী তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় রয়েছে বলে বাচ্চুর ধারণা।
নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার বলেন, অভিজিতের হত্যাকাণ্ড কেবল মুক্তচিন্তার ওপর আঘাত নয়, সমগ্র বাংলাদেশের ওপরে এই আঘাত।
“পুলিশ বলেছিল তারা তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু এর মাঝেও কীভাবে এ ঘটনাটি ঘটল? মানুষগুলো সেখানে কীভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এ বিষয়টি দেখল- তা আমার বোধগম্য নয়।”
জঙ্গি তৎপরতার বিরুদ্ধে সরকার ও জনগণ এগিয়ে না এলে মুক্তমনের মানুষদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে বলে হুঁশিয়ার করেন রামেন্দু মজুমদার।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষগুলোকে চিহ্নিত করে হত্যা করা হচ্ছে। বাংলাদেশে যা হচ্ছে তাকে বর্বরতা বললেও কম হয়ে যায়। জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের দমন করতে না পারলে দেশে স্বাধীনতা বিপন্ন হবে।”
গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন প্রশ্ন করেন, বই বের করার জন্য কেন এই স্বাধীন দেশে জীবন দিতে হচ্ছে?
“অভিজিতের হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনায় আমাদের স্বাধীনতা বিপন্ন হয়ে যায়। এ ধরনের ঘটনা ঘটার পর আমরা তদন্ত-শাস্তির দাবি তুলে থাকি বার বার। কিন্তু এক যুগ আগে একই কায়দায় লেখক হুমায়ুন আজাদের খুন হওয়ার কি সুরাহা করা হয়েছে?”
ড. কামাল বলেন, “একজন লোককে অসংখ্য মানুষ আর পুলিশের উপস্থিতিতে কুপিয়ে হত্যা করা হল। কেউ এগিয়ে এল না। পুলিশের ওয়াকিটকি কাজ করল না। পাশেই হাসপাতাল থাকার পরও পুলিশ একটি অ্যাম্বুলেন্স পর্যন্ত আনার ব্যবস্থা করতে পারল না।”
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক হারুনুর রশিদ বলেন- জঙ্গিবাদী তৎপরতা প্রতিরোধে প্রচলিত বাহিনী ও প্রশাসন যে সফল হচ্ছে না, অভিজিতের মৃত্যুই তার প্রমাণ।
এজন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ‘একটি বিশেষ বাহিনী’ গঠন করতে সরকারকে পরামর্শ দেন তিনি।
অন্যদের মধ্যে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, কবি মোহাম্মদ সামাদ, সিপিবির উপদেষ্টা মনজুরুল আহসান খান, বাসদের সাধারণ সম্পাদক কমরেড খালেকুজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, ছাত্রলীগ, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, গণজাগরণ মঞ্চ, ঋষিজ শিল্পগোষ্ঠী, খেলাঘর, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনসহ বিভিন্ন সংগঠন অভিজিতের কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়।
এই খুনের প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়ার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানান পুত্রহারা অজয় রায়।
তিনি বলেন, “অভিজিৎ ও আমার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করা হবে বলে জঙ্গিরা অনেকদিন ধরে হুমকি দিয়ে আসছিল। আমরা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিষয়টি জানিয়েছিলাম। পুলিশ বলেছিল- এ এলাকায় হুমায়ুন আজাদ হত্যাচেষ্টার মতো কোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না।”
তারপরও সেই ফেব্রুয়ারি মাসেই ছেলেকে হারিয়ে অধ্যাপক অজয় বলেন, “জঙ্গিদের বিপরীতে আমাদের দেশের পুলিশ কত অদক্ষ- এ হত্যাকাণ্ড তা প্রমাণ করল।”
জঙ্গি নেতাদের অবিলম্বে গ্রেপ্তারের পাশাপাশি জামায়াতসহ এ ধরনের মতাদর্শের অন্য সংগঠনগুলো নিষিদ্ধের দাবি জানান তিনি।
অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে অভিজিতের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় টিএসসির মিলন চত্বরের উল্টো পাশে, যেখানে ঘাতকের চাপাতিতে তিনি নিহত হন। ঘটনাস্থলে লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স আসার পর সেখানে উপস্থিত হাজারও জনতা স্লোগান দিয়ে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করে।
সেখানেও ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় ছাত্র-শিক্ষক, লেখকসহ সর্বস্তরের মানুষ। পরে সেখান থেকে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় অধ্যাপক অজয় রায়ের সিদ্ধেশ্বরীর বাসায়। পরে অভিজিতের ইচ্ছা অনুযায়ী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার লাশ হস্তান্তর করেন তার বাবা।
মেডিকেল কলেজের অ্যানাটমি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক শামীম আরার কাছে ছেলের মরদেহ তুলে দিয়ে অজয় রায় বলেন, “ছেলের ইচ্ছা অনুযায়ী লাশ আপনাদের কাছে দিয়ে গেলাম। আশা করি তা চিকিৎসাবিদ্যার কাজে ব্যবহৃত হবে।”