ভাঙল বইপ্রেমীদের মিলনমেলা

রাজনৈতিক সহিংসতা আর আতঙ্কের মধ্যেও ফেব্রুয়ারির শেষ বিকেলে বইপ্রেমীদের ঢল নামিয়ে এ বছরের মতো বিদায় নিল মাসব্যাপী অমর একুশে গ্রন্থমেলা।

ফয়সাল আতিকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Feb 2015, 08:19 PM
Updated : 1 March 2015, 10:19 AM

শনিবার মেলার শেষ দিনে সরকারি ছুটি থাকায় সকাল ১১টায় খুলে দেওয়া হয় মূল দ্বার, তাই বইপ্রেমীরাও যেন শেষ সুযোগ নিতে দুপুর গড়ানোর আগেই হাজির।

রাত নয়টায় বাঙালির এই প্রাণের উৎসবের সমাপ্তি হওয়ার কথা থাকলেও এর ঘণ্টাকাল পরেও বই বেচাকেনায় ব্যস্ত ছিলেন স্টলকর্মী-দর্শনার্থীরা।

এমনিতেই বিএনপি জোটের অবরোধ আর হরতালে বিঘ্নিত হয়েছে মেলার স্বাভাবিক গতি। তার উপর ২৬তম দিনে টিএসসি এলাকায় দুর্বৃত্তের হামলায় যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী লেখক অভিজিৎ রায়ের মৃত্যুর ঘটনায় উৎসবের আমেজে শোকের আবহ সৃষ্টি করে।

এছাড়া রোদেলা প্রকাশনীর স্টল বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনায় কেউ কেউ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন।

বইমেলার সার্বিক আয়োজন নিয়ে মিশ্র মতামত শোনা গেলেও শেষ বিচারে মেলা সফল ও স্বার্থক হয়েছে বলে মনে করছে বাংলা একাডেমি। শেষ দিনে আগত দর্শনার্থীরাও একই কণ্ঠেই যেন বললেন।

শেখ বোরহান উদ্দিন কলেজের শিক্ষার্থী শফিকুল ইসলাম বলেন, এবছর মেলায় বাড়তি স্পেসের জন্য ভালো লেগছে।

নিজেকে একজন কবি পরিচয় দেওয়া আরেক দর্শনার্থী লিন্ডা আমিন বলেন, এবারের মেলা অনেকটা সফল বলতে পারি। অনেকে বলতে পারেন, উপস্থিতি-বিক্রি কম হয়েছে। কিন্তু আমরা সেটা রকম মনে হয়নি। রাজনৈতিক অস্থিরতা স্বত্ত্বেও এবারের মেলায় প্রচুর মানুষ এসেছে। বেচাকেনাও প্রচুর হয়েছে।

শেষ দিনেও ১২৫টি নতুন বই মেলায় এসেছে। মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছে ১৫টি নতুন বইয়ের। এবছর মেলায় বিভিন্ন বিষয়ে ৩৭০০টি নতুন বই এনেছেন প্রকাশকরা।

এ বছর মেলায় মোট ২১ কোটি ৯৫ লাখ টাকার বই বিক্রি হয়েছে বলে ধারণা করছে আয়োজক কর্তৃপক্ষ।

মেলার পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব জালাল আহমেদ জানান, বাংলা একাডেমির স্টলগুলোর বিক্রি এবং ২৭ ফেব্রুয়ারি স্টলমালিকদের দেওয়া তথ্যের সঙ্গে শেষ দিনের বিক্রির সম্ভাব্য হিসাব ২১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা বেচাকেনার হিসাব দাঁড়ায়।

“২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত একাডেমির পাঁচটি স্টলে এক কোটি ৫০ লাখ টাকার বই বিক্রি হয়েছে। শেষ দিনের বিক্রি নিয়ে মোট বিক্রি এক কোটি ৬০ লাখ টাকা হবে বলে আশা করছি,” বলেন তিনি।

বাংলা একাডেমির স্টলে ২০১৩ সালে ৭১ লাখ ২৬ হাজার ৫৮১ টাকা ৫০ পয়সা, পরের বছর এক কোটি ১৮ লাখ নয় হাজার ১৭৬ টাকা ২০ পয়সা।

নতুন বইয়ের রেকর্ড

তথ্যকেন্দ্র থেকে জানানো হয়, এ বছর অমর একুশে গ্রন্থমেলায় ৩৭০০ নতুন বই এসেছে। ২৮ দিনে ৫৬০টি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছে। সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, বিশিষ্ট কবি-লেখক-বুদ্ধিজীবী ও নাগরিক সমাজের বিশিষ্ট প্রতিনিধিরা এসব মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

প্রতিবারের মতো এবারও সর্বোচ্চ সংখ্যক ৮৭৭টি কবিতার বই এসেছে। এছাড়া ৫৭৪টি গল্প, ৬২৯টি উপন্যাস, ২০২টি প্রবন্ধ, ১১৯টি গবেষণা, ১৩৭টি ছড়া, ৯৪টি শিশুতোষ, ৯০টি জীবনী, ৭টি রচনাবলী, ৫৩টি মুক্তিযুদ্ধ, ২৯টি নাটক, ৭১টি বিজ্ঞান, ৭৪টি ভ্রমণ, ৫৪টি ইতিহাস, ১৬টি রাজনীতি, ২২টি চি:/স্বাস্থ্য, ৪টি কম্পিউটার, ১৮টি রম্য/ধাঁধা, ৩০টি ধর্মীয়, ১২টি অনুবাদ, ৭টি অভিধান, ৩৩টি সায়েন্স ফিকশন/গোয়েন্দা এবং অন্যান্য কেটাগরিতে ৫৪৩টি বই প্রকাশিত হয়েছে।

মেলার অন্যরকম

এ বারের বইমেলার কয়েকটি দিককে বিশেষ মানছে বাংলা একাডেমি। আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন এর একটি। একাডেমির ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চিন, ভারত, ফ্রান্স, জার্মানি, সুইডেন, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, মালয়েশিয়া, ইকুয়েডরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও ভাষার প্রায় পঞ্চাশজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কবি, কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার ও সাহিত্য-সমালোচকের অনুষ্ঠানে অংশ নেন। এর মধ্যে রয়েছেন জার্মানির প্রখ্যাত সাহিত্যিক হান্স হার্ডার, ফরাসি লেখক ফ্রাঁস ভট্টাচার্য, বেলজিয়ামের সাহিত্যিক ফাদার দ্যতিয়েন এবং ভারতের বিশিষ্ট ভাষাবিদ ড. পবিত্র সরকার।

স্টল ও প্যাভিলিয়নেও রেকর্ড

এবারের গ্রন্থমেলায় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৫৬৫টি ইউনিটে ৩৫৩টি প্রতিষ্ঠানকে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর মধ্যে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান একাধিক ইউনিট নিয়ে স্টল গড়ে।

এবারই প্রথমবারের মতো বাংলা একাডেমিসহ মোট ১১টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ দেওয়া হয়। বর্ধমান হাউজের দক্ষিণ পাশে লিটল ম্যাগাজিন কর্নারে ৭২টি স্টল নিয়ে বসেছিল দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সাহিত্য পত্রিকাগুলো।

সংযোগে ই-তথ্যকেন্দ্র

প্রথমবারের মতো বাংলা একাডেমির নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় স্থাপিত হয় ই-তথ্যকেন্দ্র। এছাড়া মেলায় আগত মানুষের বসার স্থানসহ নান্দনিক ফুলের বাগানও নির্মাণ করা হয়। সাংবাদিকদের অবাধ তথ্য আদান-প্রদানের সুবিধার্থে গ্রন্থমেলায় মিডিয়া সেন্টার ছিল তথ্যকেন্দ্রের উত্তর পার্শ্বে। ওয়াইফাই সুবিধা ছিল মেলার উভয় অংশে।

সমাপনী অনুষ্ঠান

এদিকে সন্ধ্যায় অমর একুশে গ্রন্থমেলার সমাপনী অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। মেলার প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সদস্য-সচিব জালাল আহমেদ।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। বাংলা একাডেমির সভাপতি এমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন।