বিচারহীনতার কারণে অভিজিৎ হত্যা: সিপিজে

বাংলাদেশে লেখক-সাংবাদিক আক্রান্ত হলেও সময়মতো সেসব ঘটনার বিচার না হওয়াই অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ডের পথ করে দিয়েছে বলে মনে করছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংগঠন কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস-সিপিজে।

নিউ ইয়র্ক প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Feb 2015, 12:06 PM
Updated : 28 Feb 2015, 03:59 PM

মুক্ত সাংবাদিকতার পক্ষে আন্দোলন চালিয়ে আসা সংগঠনটির পক্ষ থেকে দ্রুত অভিজিতের হত্যাকারীদের ধরে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানানো হয়েছে।

“এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত এবং বিচারের আওতায় আনতে সরকারের জোরদার তদন্ত করা উচিত,” শুক্রবার সংগঠনের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে।

অভিজিৎ হত্যায় উদ্বেগ জানিয়ে সিপিজের এশিয়া বিষয়ক প্রোগ্রাম সমন্বয়ক বব ডায়েটজ বলেন, “বাংলাদেশে হামলাকারীদের বিচার না হওয়ার যে নজির রয়েছে তারই ফলশ্রুতিতে অভিজিতের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে।

“এর আগে গণমাধ্যম কর্মীদের ওপর বর্বরোচিত আক্রমণের ঘটনায় কারোর বিচার না হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে গণমাধ্যম কর্মীদের হত্যার ঘটনা অব্যাহত রয়েছে।”

সিপিজের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ধর্মীয় বিষয় নিয়ে যারা ব্লগে বা অন্য কোনো মাধ্যমে লিখেছেন তারা হুমকির মুখে রয়েছেন।

২০১৩ সালে শাহবাগ আন্দোলনের সময় ব্লগার বিরুদ্ধে বিভিন্ন উস্কানিমূলক বক্তব্যের প্রসঙ্গ টেনে এতে বলা হয়, “সে বছরের ফেব্রুয়ারিতে ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে হত্যা করে ধর্মের নামে সন্ত্রাসকারীরা। ওই হত্যাকাণ্ডের জন্য এখনও কেউ শাস্তি পায়নি।

“কয়েক মাস আগে ব্লগার আসিফ মহীউদ্দিনকেও হত্যার উদ্দেশ্যে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। আসিফ মহীউদ্দিন ইসলামের অপব্যাখ্যাকারীদের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন।”

বাংলাদেশে লেখক-সাংবাদিকদের ওপর হামলার সময়মতো বিচার না হওয়ার যে পর্যবেক্ষণ সিপিজে তুলে ধরেছে, সেই বক্তব্য এসেছে এদেশের মানুষের কাছ থেকেও।

অভিজিৎকে হত্যার পর শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যে যে প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে সেখানেও এ অভিযোগ করেছেন অনেকে।

অভিজিতের হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়ে পাঠানো ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “১১ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও অধ্যাপক হুমায়ূন আজাদ হত্যার বিচার হয়নি। ১৯৯৯ সালে কবি শামসুর রাহমানের ওপর হত্যার উদ্দেশ্যে হামলার ঘটনা থেকে আরম্ভ করে এ পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের সহযোগী জঙ্গী মৌলবাদীরা যাদের হত্যা করেছে শতকরা দশ ভাগেরও বিচার হয়নি।

“বিচার না হওয়া এবং বিএনপির মতো বড় দলের ছত্রছায়ায় থেকে জামায়াত ও জঙ্গি মৌলবাদীদের দেশ ও জাতিবিরোধী এবং মুক্তচিন্তা, মানবাধিকার ও সভ্যতাবিরোধী নৃশংস কর্মকাণ্ড সহ্যের সকল সীমা অতিক্রম করেছে।”

গত বৃহস্পতিবার রাতে বইমেলা থেকে ফেরার পথে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী লেখক অভিজিৎ ও তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যার ওপর যেভাবে হামলা হয়, সেভাবেই ১১ বছর আগে হামলা হয়েছিল লেখক হুমায়ুন আজাদের ওপর।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতে বইমেলা থেকে ফেরার পথে বাংলা একাডেমি ও টিএসসির মাঝামাঝি এলাকায় হামলার শিকার হন হুমায়ুন আজাদ, মৌলবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন তিনি।

ওই হত্যাকাণ্ডের পর ১১ বছর পার হলেও এখনো বিচার শেষ হয়নি।

হুমায়ুন আজাদ নিজের মুখে তাকে হামলার পিছনে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ইন্ধন বা সংশ্লিষ্টতা থাকার কথা বললেও অভিযুক্তদের তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন তিনি।

বিচারে দীর্ঘসূত্রতা এবং আসামিদের তালিকা থেকে সাঈদী বাদ পড়ায় হতাশা রয়েছে হুমায়ুন আজাদের স্বজনদের মধ্যে।

ওই হামলার ঘটনায় মামলা দায়ের করেছিলেন হুমায়ুনের ছোট ভাই মঞ্জুর কবির।

তিনি শনিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হুমায়ুন আজাদ হত্যা মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি না হওয়ার কারণেই দ্বিতীয় হুমায়ুন আজাদ হত্যার ঘটনা ঘটেছে। যারা সাহসের সঙ্গে সত্য কথা বলবে তাদের কপালে একই পরিণতি অপেক্ষা করছে। এ রকম হতেই থাকবে। যতোদিন রাষ্ট্রীয় কর্তাব্যক্তিরা শুদ্ধ না হবে, তদন্তে ত্রুটি থাকবে ততোদিন বিচারে ত্রুটি থাকবে।

“যাদের নির্দেশে হুমায়ুন আজাদকে খুন করা হয় তাদের তো অভিযোগপত্রে আসামির তালিকায় রাখা হয়নি, রাখা হয়েছে তাদের কামলাদের। অথচ হুকুমের আসামি করা উচিৎ ছিল সাঈদী ও নিজামীকে। হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলার পর সাংবাদিকদের কাছে তাদের নামই বলা হয়েছিল। তাই বিচারে কী হবে সে ব্যাপারে আমার আর কোনো আগ্রহ নেই।”

ধর্মীয় মৌলবাদ ঠেকাতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান

লেখক-ব্লগার অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে বাংলাদেশে ধর্মীয় মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে প্রগতিশীল ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তির একত্রে আপসহীন মনোভাব নিয়ে কাজ করে যাওয়ার ওপর জোর দিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম স্ট্র্যাটেজি ফোরাম (আইসিএসএফ)।

যুদ্ধাপরাধসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার নিশ্চিত করতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা ছাত্র, শিক্ষক, সাংস্কৃতিক ও মানবাধিকার কর্মীসহ নানা পেশার বাংলাদেশিদের নিয়ে একটি স্বাধীন সংস্থা হিসেবে কাজ করে যাওয়া আইসিএসএফ শুক্রবার এক বিবৃতিতে এ আহ্বান জানায়।

অভিজিৎ রায় (ফেইসবুক থেকে নেওয়া ছবি)

বিবৃতিতে তারা বলেছে, অভিজিতের হত্যাকাণ্ড ‘বিছিন্ন ঘটনা’ নয়। এ হত্যাকাণ্ড একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তচিন্তা স্তব্ধ করার চেষ্টায় বুদ্ধিজীবী হত্যার ধারাবাহিকতা।

অভিজিৎ নিজেও আইসিএসএফের একজন সদস্য ছিলেন এবং তার ব্লগ সাইট ‘মুক্তমনা’ এই বৈশ্বিক ফোরামের সহযোগী হিসেবে কাজ করত।

১০ বছর আগে লেখক অধ্যাপক হুমায়ূন আজাদের ওপর বর্বরোচিত হামলার পর বাংলাদেশে নিয়মিত এ ধরনের ঘটনা চলতে থাকায় উদ্বেগ প্রকাশ করে ঘটনাগুলোকে প্রগতিশীল ও মুক্ত চিন্তার ওপর ‘পরিকল্পিত আক্রমণ’ বলে অভিহিত করে আইসিএসএফ।

এ ধরনের হামলার ঘটনা ও হত্যাকাণ্ডের বিচার এখনও না হওয়াকে ‘হতাশাজনক’ উল্লেখ করে আইসিএসএফের বিবৃতিতে বলা হয়, “যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে দায়ীদের শাস্তি দেওয়া হলে এ ধরনের বর্বরোচিত আক্রমণ প্রতিরোধ করা যেত বলে আমরা বিশ্বাস করি।

“আমাদের মূল্যবোধের ওপর এ ধরনের আক্রমণের বিরুদ্ধে সমাজের সব ধর্মনিরপেক্ষ, উদার, প্রগতিশীল ও মুক্তচিন্তা সম্পন্ন সদস্যদের এক হয়ে প্রতিরোধের আহ্বান জানাই।”

“সমাজের সব অংশ থেকে এগিয়ে এসে আমাদের জাগতে হবে। এ কাজে অজুহাত বা হাল ছেড়ে দেওয়া কেবল তাদেরই সাহসী করে তুলতে পারে যারা আমাদের ভয় দেখাতে চায়।”