‘মেলাই আমার প্রতিবাদের ভাষা’

লেখক অভিজিৎ রায়ের খুনের ঘটনায় বাঙালির প্রাণের বইমেলায় শঙ্কা আর উদ্বেগ ছাপিয়ে লেখক, পাঠক প্রকাশকদের কণ্ঠে উঠে এসেছে ভয় না পাওয়ার, রুখে দাঁড়ানোর প্রত্যয়।

ফয়সাল আতিকশামীমা বিনতে রহমান ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Feb 2015, 03:57 PM
Updated : 27 Feb 2015, 04:32 PM

মাসব্যাপী একুশে বইমেলায় ঘুরে ঘুরে বই দেখা আর কেনার এই উৎসব হত্যাকাণ্ডের পর শুক্রবার সকালে খানিকটা থমকে গেছে বলে মনে হলেও বিকেলের মেলা পরিণত হয় জনসমুদ্রে।

“খুন হওয়ার ভয়ে আমি তো আমার বইমেলার মুক্ত প্রাঙ্গণ ছেড়ে দেব না। ওরা একজন মুক্ত চিন্তার মানুষকে মেরেছে। এরকম কয়জনকে মারতে পারবে? ওই নৃশংস খুনের ভয়ে আমি তো ঘরে বসে থাকব না। আরো বেশি বেশি করে মেলায় আসব। বই কিনব। এটাই আমার প্রতিবাদের ভাষা”, বলছিলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী নাজনীন শিফা।

বৃহস্পতিবার রাতে বইমেলা থেকে ফেরার পথেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলন চত্বরের উল্টো পাশে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সংলগ্ন ফুটপাতে হামলা হয় মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিত ও তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যার ওপর।

চাপাতির কোপে গুরুতর আহত অভিজিত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর মারা যান। স্বামীকে বাঁচাতে গিয়ে ধারাল অস্ত্রের কোপে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে বন্যার একটি আঙুল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই এলাকাতেই ২০০৪ সালের বইমেলার সময় একই কায়দায় জঙ্গি হামলার শিকার হয়েছিলেন লেখক লেখক হুমায়ুন আজাদ। সেই ঘটনার বিচার না হওয়ায় এবার অভিজিৎকে খুন হতে হল বলে মন্তব্য করেছেন অনেকেই।

সকালে টিএসসির রাজু ভাস্কর্য থেকে বইমেলা চত্বর পর্যন্ত এলাকায় জড়ো হয়ে এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানান লেখক-প্রকাশক-শিল্পীরা।

অ্যাকাডেমিক অ্যাণ্ড ক্রিয়েটিভ পাবলিশার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এবং আগামী প্রকাশনীর সভাপতি ওসমান গণি বলেন, “২০০৪ সালে এই বই মেলা চলাকালে একজন লেখককে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা করা হলো। আজ পর্যন্ত কি তাদের খুঁজে বের করে শাস্তি দেওয়া গেছে বলেন? ১১ বছর পরও বিচার হয়নি। এটা শুধু দুঃখজনকই না, গণতান্ত্রিক দেশে এরকম বিচারহীনতা, লেখকের ওপর এরকম জঙ্গি কায়দায় হামলা ও খুন বিচারহীনভাবে যাবে, এটা মেনে নিতে পারি না।”

সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী ও বিজ্ঞানমনস্ক লেখক অভিজিৎ রায় যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করছিলেন প্রকৌশল পেশায়। এবারের মেলায় তার দুটি বেরিয়েছে; কলামনিস্ট হিসাবে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমেও তিনি নিয়মিত লিখতেন। 

অভিজিৎ রায়ের লেখা ডজনখানেক বইয়ের বেশিরভাগই প্রকাশ করেছে শুদ্ধস্বর। এ প্রতিষ্ঠানের প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুল জানান, অভিজিৎ খুন হওয়ার পর পাঠকরা এর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে তার বই কিনে।

“তার লেখা ‘সমকামীতা’, ‘ভালোবাসা কারে কয়’, ‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’ বইগুলোর সব কপি দুপুরের মধ্যেই বিক্রি হয়ে গেছে। আর ‘অবিশ্বাসীর দর্শন; শেষ হয়েছে আগেই।”

বৃহস্পতিবার অভিজিৎ ও তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যার সাথেই বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছিলেন টুটুল। হামলার খবর পেয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি ঘটনাস্থলে পৌঁছান।

“আমি যখন বন্যাকে দেখলাম ওর ঘাড়ে, মাথায় রক্ত। এত স্ট্রং ছিল তখনো...  বললো, ‘তাড়াতাড়ি হাসপাতালের ব্যবস্থা করেন প্লিজ।’ অথচ তখন ওর আঙুল পড়েছিল রাস্তায়।”

আক্ষেপের সুরে এই প্রকাশক বলেন, “অভিজিতের লেখা তো যুক্তির কথা। পদার্থবিদ্যা, দর্শন, বস্তুবাদ নিয়ে এ রকম লেখাতো খুব বেশি লিখছেন না এখানে। আর তাকেই খুন করা হলো।”

ছুটির দিনের নিয়ম অনুযায়ী সকাল ১১টায় বইমেলা শুরু হওয়ার পর থেকে সব আলোচনায় বার বার ফিরে এসেছে অভিজিৎ প্রসঙ্গ। সে সময় অনেকের কথাতেই মেলার নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা আর উদ্বেগ প্রকাশ পেয়েছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাহমুদ সুমন বলেন, “এরপর কে? আমি, নয়তো আপনি। আমরা তো কেউ আর নিরাপদ না। চাপমুক্ত থেকে বইমেলায় ঘুরব, সেই স্বস্তি তো নেই। ”

কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা একাডেমি চত্বর ও সোহরাওয়ার্দী মিলিয়ে মেলা প্রাঙ্গণে দর্শনার্থীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। মেলায় ঢুকেই একজন দর্শনার্থীকে বলতে শোনা যায়, “একুশে ফেব্রুয়ারির মতোই তো ভিড়! কেউ তো ভয় পায় নাই।”

প্রকাশকদের একটি অংশ বিকালে মেলা চত্বরে প্রতিবাদী কর্মসূচি করতে চাইলেও পরে তা মেলার শেষ দিন শনিবারে নেওয়া হয়।

পুস্তক প্রকাশক, বিক্রেতা ও বিপণন সমিতির আহ্বায়ক ও শ্রাবণ প্রকাশনীর প্রকাশক রবীন আহসান জানান, শনিবার বিকাল ৪টা থেকে ১০ মিনিট মেলা বন্ধ থাকবে। অভিজিৎ হত্যার প্রতিবাদে প্রকাশকদের এই প্রতীকী কর্মসূচি।

৪৩ বছর ধরে বাঙালির সংস্কৃতি ও মননের কেন্দ্রে পরিণত হওয়া এই মেলার নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষক দিদারুল ইসলাম।

মেলা প্রাঙ্গণে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, টিএসসি ও বাংলা একাডেমি ঘিরে যে মুক্ত চিন্তার বলয়, তা নিরাপদ রাখতে যথাযথ দায়িত্ব পালন করা উচিৎ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর। কিন্তু তা তো হলোই না, বরং সবাই অনিরাপদ হয়ে গেলাম।”

মেলা ঘিরে দৃশ্যত কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা দেখা গেলেও তার মধ্যেই এই হত্যাকাণ্ডে পুলিশের দিকে আঙুল উঠেছে বারবার।

বই কিনতে আসা কৌশিক আহমেদ প্রশ্ন করেন, “শাহবাগে নেমে টিএসসির দিকে আসতেই তো থানা-পুলিশ ভ্যান দেখা যায়। তাহলে অভিজিৎ কীভাবে খুন হলো? হত্যাকারীরা কি তাহলে বেশি শক্তিশালী? নাকি নিরাপত্তা বাহিনীর দায়িত্বশীলরা গা এলিয়ে ঘুমাচ্ছিলেন?

তবে সার্বিক পরিস্থিতির বিবেচনায় পুলিশের পক্ষে সব মানুষকে নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব কি-না সে প্রশ্নও রেখেছেন নন্দিতা প্রকাশের মালিক বিভি রঞ্জন।

এবারের অমর একুশে বইমেলা শেষ হচ্ছে শনিবার; সকাল ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত মেলার পুরোটা সময় বই, পাঠক আর লেখকদের সঙ্গে অভিজিতও থাকবেন, সন্দেহ নেই।

[প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন মইনুল হক চৌধুরী ও তপন কান্তি রায়।]