ক্যাম্পাসেই ‘জঙ্গি আখড়া’, সন্দেহ পুলিশ কমিশনারের

লেখক অভিজিৎ রায় হত্যার ঘটনায় জঙ্গিদের জড়িত থাকার সন্দেহ প্রকাশ করে ঢাকার পুলিশ কমিশনার বলেছেন, হত্যাকারীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে থেকে আসেনি বলেই তিনি মনে করছেন।

লিটন হায়দারও কামাল তালুকদারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Feb 2015, 02:28 PM
Updated : 27 Feb 2015, 06:44 PM

এ ঘটনায় অভিজিতের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক অজয় রায় অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেছেন। কিন্তু হত্যাকাণ্ডের পর এক দিন পার হলেও পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেননি।

বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে একুশে বইমেলা থেকে ফেরার পথে বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলন চত্বরের উল্টো পাশে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সংলগ্ন ফুটপাতে হামলার শিকার হন মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ ও তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় অভিজিতের।

অথচ ঘটনাস্থল থেকে টিএসসি মোড় আর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রবেশ পথের দূরত্ব মাত্র ২৫ গজ, যেখানে বইমেলার জন্য পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। আর দুইশ গজ দূরেই শাহবাগ থানা; পাশাপাশি ক্যাম্পাসের প্রতিটি প্রবেশমুখেই সার্বক্ষণিক পুলিশি পাহারা রয়েছে।

২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি কাছাকাছি এলাকাতেই লেখক হুমায়ুন আজাদকে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়।

লেখক হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলা, ব্লগার রাজিব ও অভিজিৎ হত্যার ঘটনা ‘একই সূত্রে গাঁথা’ মন্তব্য করে পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যারা চাকু ছুরি নিয়ে হত্যা করতে এসেছিল তারা কেউ বাইরে থেকে আসেনি। এটা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক।”

তবে তিনি ঠিক কি সন্দেহ করছেন, বা এ বিষয়ে আর কোনো তথ্য পুলিশের কাছে আছে কি-না তা স্পষ্ট করেননি এই পুলিশ কর্মকর্তা।

তিনি জানান, গোয়েন্দা পুলিশ এ ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে। শাহবাগ থানা পুলিশও বিষয়টি দেখছে।

হত্যাকাণ্ডের পর শুক্রবার সকাল থেকে শাহবাগ, বইমেলা এবং  আশেপাশের এলাকার নিরাপত্তা আরও জোরদার করা হয়েছে।

ক্যাম্পাসের মিলন চত্বর, শিববাড়ি মোড়, বঙ্গবাজার, ভিসির বাংলো, শাহবাগ মোড় এবং ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটের সামনে বাড়তি পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন শাহবাগ থানার উপপরিদর্শক সোহেল রানা।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন “পুরো এলাকায় কাউকে সন্দেহ হলে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।”

পুলিশের রমনা সার্কেল উপ কমিশনার আব্দুল বাতেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন “সেখানে এখন নির্ধারিত সংখ্যার চেয়ে বেশি পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।”

কিন্তু এক দিনের তদন্তে কোনো সাফল্যের খবর পুলিশ কর্মকর্তারা জানাতে পারেননি।  

যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী প্রকৌশলী অভিজিত সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী ও বিজ্ঞানমনস্ক ব্লগ মুক্তমনার প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ও তার স্ত্রী ধর্ম ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত লেখালেখি করে আসছিলেন। এ কারণে তাদের হুমকিও দেওয়া হয়েছে।

গত ১৬ ফেব্রুয়ারি দেশে আসার পর প্রতিদিনই মেলায় যাতায়ত করছিলেন অভিজিৎ। হামলার হুমকি থাকার পরও তার পক্ষ থেকে কখনো নিরাপত্তা চাওয়া হয়নি বলে শাহবাগের ওসি সিরাজুল ইসলাম জানান।

তিনি বলেন, “আমরা তদন্ত করছি। প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে, জঙ্গিরাই এ ঘটনা ঘটিয়েছে।”

অভিজিতের ওপর হামলার পর  ‘আনসার বাংলা সেভেন’ নামে একটি টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে টুইট করে এ হত্যাকাণ্ডকে ‘বিজয়’ হিসেবে দাবি করা হয়।

রাত ১২টার দিকে ওই টুইটে বলা হয়, “আল্লাহু আকবর.. বাংলাদেশে আজ একটি বিশাল সাফল্য এসেছে। টার্গেট ইজ ডাউন..”

তাদের আরেক টুইটে অভিজিৎ ও তার স্ত্রীর একটি ছবি শেয়ার করে বলা হয়েছে, “ইসলামের বিরুদ্ধে ‘অপরাধের’ জন্য ইসলামবিরোধী ব্লগার আমেরিকান বাঙালি অভিজিৎ রায়কে রাজধানী ঢাকায় হত্যা করা হয়েছে।”

হামলার পর মাটিতে লুটিয়ে থাকা অভিজিতের পাশে তার স্ত্রীর রক্তাক্ত একটি ছবি শেয়ার করে ‘এক্সক্লুসিভ!’ শিরোনামের এক টুইটে বলা হয়েছে, “এটা স্বামীর মাথা ধরে থাকা অভিজিৎ রায়ের রক্তাক্ত স্ত্রী। শিরোশ্ছেদ করা হয়েছে। গত তিন থেকে চার বছর ধরে সে শীর্ষ টার্গেটে ছিল।”

এ হত্যাকাণ্ডের পর ফারাবী শফিউর রহমানের নামও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আলোচনায় এসেছে, যিনি অনলাইনে বাংলা বই বিক্রির ওয়েবসাইট ‘রকমারি ডটকম’ এর বিক্রির তালিকা থেকে অভিজিৎ রায়ের বই সরিয়ে নিতে হামলার হুমকি দিয়েছিলেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র ফারাবী গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারের জানাজা পড়ানোয় ইমামকেও হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন। হত্যায় উসকানির অভিযোগে তিনি গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন। 

শুক্রবার সকালে শাহবাগ থানায় মামলা করার পর অভিজিতের বাবা অধ্যাপক অজয় সাংবাদিকদের বলেন, “আমার ছেলেকে হত্যার জন্য উগ্র জঙ্গিবাদীরাই দায়ী। এদের মদদ দিয়েছে জামায়াত।”

একই সন্দেহের কথা এসেছে ঢাকার পুলিশ কামিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার মুখ থেকেও।

তিনি বলেন, “জঙ্গিরা কতোটা ডেসপারেট হতে পারে তার প্রমাণ দিয়েছে গতকাল। পাশেই থানা, বইমেলার প্রবেশমুখে পুলিশ, সবগুলো প্রবেশপথে পুলিশ... এরপরও এখানে একটা ঘটনা ঘটিয়ে গেছে তারা।”

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সেলিম নামে এক ফুল বিক্রেতার বরাত দিয়ে শাহবাগের ওসি বলেন, হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে দুজন। এর মধ্যে একজনের গায়ে ছিল সাদা শার্ট, অন্যজন কোট পরে ছিল। তাদের বয়স ৩০ থেকে ৩৫ বছরের মতো। মুখে দাড়ি ছিল কি না সেলিম তা জানাতে পারেননি।

“তারা এক থেকে দুই মিনিট সময় নিয়েছে। অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সাথে। কাছেই দাঁড়ানো সেলিম চিৎকার করে উঠলে হামলাকারীরা তাড়া করে। প্রাণভয়ে সেলিম সেখান থেকে দৌড়ে সরে যায়।”

হামলায় দুজনের অংশ নেওয়ার তথ্য পাওয়া গেলেও সেখানে আশেপাশে তাদের আরও লোক ছিল বলে ওসি সিরাজুল ইসলামের ধারণা।

‘আনসার বাংলা সেভেন’ এর নামে টুইটের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে পুলিশ কামিশনার আছাদুজ্জামান বলেন, “আমাদের তদন্ত ভিন্ন খাতে নেওয়ার জন্য এটা তাদের কৌশল হতে পারে। কারা জড়িত তা আমরা খতিয়ে দেখছি।”

এদিকে অভিজিতের বাবার মামলার নথি আদালতে যাওয়ার পর ঢাকার মহানগর হাকিম মাসুদ জামান আগামী ৫ এপ্রিল পুলিশকে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলেছেন।

নিয়ম অনুযায়ী, হত্যা মামলার এজাহার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে পাঠাতে হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শাহবাগ থানার উপ-পদির্শক সুব্রত গোলদার প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সময় চাইলে বিচারক তারিখ ঠিক করে দেন বলে আদালত পুলিশের সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক মাহমুদুর রহমান জানান।

[প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন প্রকাশ বিশ্বাস, শামীমা বিনতে রহমান, গোলাম মুজতবা ধ্রুব ও ফয়সাল আতিক।]