উত্তর নেই ‘স্তম্ভিত’ পুলিশের কাছে

চারপাশে কড়া পুলিশি নিরাপত্তার পরও বাঙালির সংস্কৃতি ও মননের প্রতীক একুশে বইমেলা থেকে মাত্র কয়েকশ গজ দূরে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের মতো একইরকম ‘জঙ্গি কায়দায়’ লেখক অভিজিৎ রায়ের ওপর হামলার ঘটনায় পুলিশও স্তম্ভিত।

গোলাম মুজতবা ধ্রুবশামীমা বিনতে রহমান ওবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Feb 2015, 12:47 PM
Updated : 2 April 2015, 03:28 PM

বৃহস্পতিবার রাতে বইমেলা থেকে ফেরার পথে যে স্থানটিতে অভিজিতের ওপর হামলা হয়, সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই ছোটবেলা কেটেছে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী এই লেখকের। তার বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক অজয় রায় এ হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী করেছেন ‘উগ্র জঙ্গিবাদীদের’।         

পুলিশও জঙ্গিবাদীদের দিকে আঙুল তুলেছে, কিন্তু শাহবাগ থানা থেকে মাত্র আড়াইশ গজ দূরত্বে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়িয়ে কীভাবে তারা একই কায়দায় বার বার হামলা করছে তার কোনে সদুত্তর পুলিশ কর্তাদের কথায় মেলেনি। 

অভিজিৎ রায় খুন হওয়ার পর একদিন পেরিয়ে গেলেও কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। তদন্তের দায়িত্ব পাওয়া গোয়েন্দা পুলিশ কোনো অগ্রগতির খবরও দিতে পারেনি।  

ঢাকার পুলিশ কামিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জঙ্গিরা কতোটা ডেসপারেট হতে পারে তার প্রমাণ দিয়েছে গতকাল। পাশেই থানা, বইমেলার প্রবেশমুখে পুলিশ, সবগুলো প্রবেশপথে পুলিশ... এরপরও এখানে একটা ঘটনা ঘটিয়ে গেছে তারা।”

বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলন চত্বরের উল্টো পাশে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সংলগ্ন ফুটপাতে কুপিয়ে আহত করা হয় মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎও তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে।

আহত রাফিদা আহমেদ বন্যা

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় অভিজিতের। বন্যার চিকিৎসা চলছে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে।

গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা আসার পর প্রতিদিনই বইমেলায় যাওয়া আসা করছিলেন অভিজিত। বৃহস্পতিবার রাতে যে জায়গায় তার ওপর হামলা হয়, ওই পথ দিয়েই প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ বইমেলায় যায়, চলাফেরা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, সাংস্কৃতিক কর্মীরা। 

ঘটনাস্থল থেকে টিএসসি মোড় আর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রবেশ পথের দূরত্ব ২৫ গজ। টিএসসি মোড়ে মেলার জন্য ব্যারিকেড দিয়ে পুরো ফেব্রুয়ারি মাসই পাহারায় রয়েছে পুলিশ।  

এছাড়া দুইশ গজ দূরে শাহবাগ থানা। শাহবাগ মোড়, বইমেলা পেরিয়ে দোয়েল চত্বর, ফুলার রোডের মোড়, নীলক্ষেতসহ ক্যাম্পাসের প্রতিটি প্রবেশমুখে রয়েছে সার্বক্ষণিক পুলিশি নিরাপত্তা।

তারপরও কীভাবে এরকম একটি হত্যাকাণ্ড ঘটল, হামলাকারীরা কীভাবে কাজ শেষে নির্বিঘ্নে পালিয়ে গেল, হত্যাকাণ্ডের পর একদিন পার হলেও পুলিশ কেন কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারল না- এসব প্রশ্নের জবাব নেই শাহবাগ থানার ওসি সিরাজুল ইসলামের কাছে।

তিনি বলেন, “আনসার বাংলা সেভেন নামের একটি গ্রুপ টুইটারে এ হত্যাকাণ্ডকে নিজেদের বিজয় বলেছে। আমরা তদন্ত করছি। প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে, জঙ্গিরাই এ ঘটনা ঘটিয়েছে।”

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সেলিম নামে এক ফুল বিক্রেতার বরাত দিয়ে ওসি বলেন, হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে দুজন। এর মধ্যে একজনের গায়ে ছিল সাদা শার্ট, অন্যজন কোট পরে ছিল। তাদের বয়স ৩০ থেকে ৩৫ বছরের মতো। মুখে দাড়ি ছিল কি না সেলিম তা জানাতে পারেননি।

“তারা এক থেকে দুই মিনিট সময় নিয়েছে। অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সাথে। কাছেই দাঁড়ানো সেলিম চিৎকার করে উঠলে হামলাকারীরা তাড়া করে। প্রাণভয়ে সেলিম সেখান থেকে দৌড়ে সরে যায়।” 

অভিজিৎ রায় ও রাফিদা আহমেদ বন্যা (ফেইসবুক থেকে নেওয়া ছবি)

অভিজিতের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকও বলেছেন, অভিজিতের মাথায় ‘অত্যন্ত দক্ষ হাতে হিংস্রভাবে’ ধারালো অস্ত্রের তিনটি কোপ দেওয়া হয়েছিল, যাতে বোঝা যায় কোথায় আঘাত করলে মৃত্যু হবে সে সম্পর্কে পুরো ধারণা খুনির ছিল। 

শাহবাগ মোড় থেকে জাতীয় জাদুঘর, পাবলিক লাইব্রেরি, চারুকলা অনুষদ, ছবির হাট, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন, টিএসসি, এরপর বাংলা একাডেমী এবং বইমেলা চত্বর- এই পুরো এলাকা ঢাকা শহর ও বাংলাদেশের মানুষের কাছে বাঙালি সংস্কৃতি মননের কেন্দ্রবিন্দু। এখানেই প্রতি ফেব্রুয়ারিতে অমর একুশে বইমেলা ঘিরে লেখক, পাঠক, সংস্কৃতিকর্মী ও মুক্তমনাদের মিলন মেলা বসে।

২০০৪ সালের এইদিনে অর্থাৎ ২৭ ফেব্রুয়ারি লেখক হুমায়ুন আজাদকেও কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয় এই টিএসসি এলাকায়।

টিএসসি থেকে মাত্র শ’ খানেক গজ দূরে ফুটপাতের ওপর ফেলে কোপানো হয় তাকে, যে ঘটনায় জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ। 

বইমেলার মাসে সেই তারিখের একদিন আগে ২৬ ফেব্রুয়ারি খুন হলেন অভিজিৎ, যিনি সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্ম ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে যুক্তিনির্ভর লেখালেখি করে আসছিলেন নিয়মিত। এ জন্য তাকে হুমকিও পেতে হয়েছে।

একই স্থানে আবারও একজন লেখক হামলার শিকার হওয়ায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। উদ্বেগ তৈরি হয়েছে বইমেলার প্রকাশক, লেখক, পাঠক ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের মধ্যেও। 

অভিজিতের বাবা অধ্যাপক অজয় রায়ের দীর্ঘ দিনের সঙ্গী লেখক ও সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, “দেশের কোনো জায়গায় এখন কোনো সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তা আছে? এই বইমেলা প্রাঙ্গণে হুমায়ুন আজাদকে হত্যার জন্য যেভাবে আহত করা হয়েছিল, তারপর থেকে আমরা লেখক-শিল্পী সমাজ তো আর নিরাপত্তা বোধ নিয়ে চলতে পারছি না। মৃত্যু মাথায় নিয়ে এরকম জায়গায় কত দিন বাস করব আমরা?”

তিনি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন, “কেন আমি বই মেলায় যেতে পারি না? কেন মামুন (মুনতাসির মামুন) বইমেলায় গেলে এক দঙ্গল ছাত্রকে নিরাপত্তা বলয় হিসাবে নিয়ে যায়? ২০১৩ সালে অভিজিতের বাবা অজয় রায়কে মৌলবাদীরা নাস্তিক-মুরতাদ ঘোষণা দিয়েছিল। আর অভিজিতের ওপর তো বেশ কয়েকবার থ্রেট করেছে।”

মোবাইল ও অনলাইনে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে জঙ্গিদের তৎপরতার ওপর নজর রাখলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সহজেই তাদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করতে পারে বলে মনে করেন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির।

অভিজিৎ রায় (ফেইসবুক থেকে নেওয়া ছবি)

দশ বছর পেরিয়ে গেলেও হুমায়ুন আজাদ হত্যা চেষ্টার বিচার হয়নি বলেই অভিজিৎ রায় আজ খুন হলেন বলে মন্তব্য করেন শ্রাবণ প্রকাশনীর প্রকাশক রবীন আহসান।

কিন্তু পুলিশ জনগণকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে এ অভিযোগ মানতে রাজি নন শাহবাগের ওসি।

তিনি বলেন, “পুলিশ নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে বিষয়টি এমন নয়। পুলিশ সবসময়ই সাধ্যমত চেষ্টা করে থাকে। তারা সবসময়ই চায়, যেন কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে।”

পুলিশের নিরাপত্তায় দুর্বলতার কথা মানতে চাননি পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়াও। তবে পুলিশের নাকের ডগায় আবারও একই ধরনের হামলায় তারাও যে স্তম্ভিত, তা তার কথাতেও স্পষ্ট। 

তিনি বলেন, হুমায়ুন আজাদ, ব্লগার রাজিব আর অভিজিত হত্যার ঘটনা ‘একই সূত্রে গাঁথা’।

তবে গোয়েন্দা পুলিশের উপ কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে সাংবাদিকদের বলেন, অভিজিতের ওপর হামলা ঠেকাতে পুলিশের কোনো গাফিলতি ছিল কি-না, বা এ ঘটনা ঠেকানো যেত কি না তা অবশ্যই কর্তৃপক্ষ দেখবে।

[প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন লিটন হায়দার ও কামাল তালুকদার।]