২৬ বছর আগের সিদ্ধান্তে ‘অচল’ চট্টগ্রামের আদালত

হরতাল নিয়ে ছাব্বিশ বছর আগে আইনজীবীদের এক সিদ্ধান্তের কারণে চলতি মাসে চট্টগ্রামের আদালতে কোনো মামলার শুনানি না হওয়ায় বিচারবঞ্চিত হচ্ছেন হাজারো বিচারপ্রার্থী।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরী চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Feb 2015, 07:47 AM
Updated : 26 Feb 2015, 08:10 AM

গত শতকের আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ১৯৮৯ সালে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি হরতালের দিনে শুনানিতে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, যা তারা আজও অনুসরণ করছেন।

কোনো পক্ষের আইনজীবীরা না আসায় বিচারকরাও এজলাসে বসছেন না। বিএনপি জোটের হরতাল-অবরোধে নাশকতাসহ অন্যান্য ঘটনায় যারা গ্রেপ্তার হচ্ছেন তাদের রিমান্ড বা কারাগারে পাঠানোর সিদ্ধান্ত বিচারকের খাস কামরা থেকেই হচ্ছে।   

কিন্তু যারা থানায় মামলা করতে না পেরে আদালতে আসেন, তাদের খালি হাতেই ফিরতে হচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে নারী নির্যাতন মামলার আলামত।

কেবল বিচারপ্রার্থীরা নন, আয়-উপার্জন বন্ধ থাকায় সাধারণ আইনজীবী, তাদের সহকারী ও কার্যালয়ের কয়েক হাজার কর্মচারী চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন। 

এভাবে বিচার ব্যাহত হওয়ায় দুই যুগের বেশি সময় আগের সেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছে আইনজীবী সমিতি।

সমিতির নেতৃবৃন্দ ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা এখন বলছেন, ওই সিদ্ধান্ত ছিল ‘মৌখিক’। এর কোনো লিখিত অনুলিপির সন্ধান তারা পাচ্ছেন ‍না।

এছাড়া দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের মামলায় সর্বোচ্চ ১৩৫ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করার আইনি বাধ্যবাধকতা থাকায় হরতালের দিনগুলো ‘কার্যদিবস’ হিসেবে গণ্য না করতে আইন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন চট্টগ্রামের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আইয়ুব খান।

কুকুর লেলিয়ে ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে হিমাদ্রী মজুমদার হিমু নামে এক যুবককে হত্যার আলোচিত মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে আসার পর গত পাঁচ মাসে ১১ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে।

কিন্তু বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট ফেব্রুয়ারির শুরু থেকে সাপ্তাহিক ছুটি বাদে প্রতিদিনই হরতাল করায় এবং চট্টগ্রামের আইনজীবীরা হরতালে শুনানিতে না যাওয়ায় এ মাসে হিমু হত্যা মামলার শুনানি হয়নি একদিনও।       

এ মামলায় একজন মাত্র সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ বাকি আছে। তারপরই যুক্তিতর্ক শেষে মামলাটি রায়ের পর্যায়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের নিয়ম অনুযায়ী সে জন্য সময় হাতে আছে মাত্র ১৫ কার্যদিবস।

হিমুর বাবা প্রবীর মজুমদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে মামলা আসার পর আশায় ছিলাম ছেলে হত্যার বিচার পাব। কিন্তু এখন এমন এক জটিলতায় পড়লাম কোনো পথ দেখছি না।”

পিপি আইয়ুব খান জানান, বর্তমানে চট্টগ্রামের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে ৩০টি মামলা বিচারাধীন।

“গত সোমবার একটি মামলার নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ায় সেটি আগের আদালতে ফেরত গেছে। অথচ ওই মামলায় মাত্র একজনের সাক্ষ্যগ্রহণ বাকি ছিল।”

মন্ত্রণালয়ে চিঠি লেখার বিষয়টি জানিয়ে তিনি বলেন, “হিমুর মামলাটি অল্প কয়েক দিনের মধ্যে রায়ের পর্যায়ে পৌঁছাবে। কিন্তু হরতালের কারণে কার্যক্রম এগোচ্ছে না। মানুষের প্রত্যাশা পূরণের জন্যই আইনমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখেছি হরতালের দিনগুলো কার্যদিবসের বাইরে রাখতে।”

দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের মতো একই চিত্র চট্টগ্রামের সব আদালতে। হরতালের কারণে ফেব্রুয়ারি মাসে কোনো মামলারই সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি।

ঢাকায় সমাবেশ করতে না পেরে গত ৫ জানুয়ারি সারা দেশে লাগাতার অবরোধ ডাকেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। সেই অবরোধের মধ্যেই জানুয়ারি মাসে ছয়দিন এবং চলতি ফেব্রুয়ারি মাসে ১৯ দিন হরতাল করে ২০ দলীয় জোট।

অর্থাৎ, ৫ জানুয়ারি থেকে ৩৮ কার্যদিবসের মধ্যে হরতাল হয়েছে ২৫ দিন। শুধু জানুয়ারি মাসে ১৩ দিন আদালতের কার্যক্রম চলে। আর ফেব্রুয়ারিতে শুনানি না হওয়ায় মামলার নির্ধারিত তারিখে বিচারক খাস কামরা থেকে পরবর্তী তারিখ দিয়ে দিচ্ছেন বিচারক। 

এই পরিস্থিতিতে হিমু হত্যা মামলার মতোই আটকে আছে বাঁশখালীর ১১ হত্যা মামলা, যা চট্টগ্রামের তৃতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন। 

২০০৩ সালের ১৮ নভেম্বর বাঁশখালী উপজেলার সাধনপুর গ্রামের শীল পাড়ায় এক বাড়িতে আগুন দিয়ে শিশুসহ ১১ জনকে হত্যা করা হয়।

মামলার বাদী বিমল শীল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “৪ ফেব্রুয়ারি ও বুধবার সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ছিল। হরতালের কারণে হয়নি। এক যুগ ধরে মামলা চালাতে গিয়ে আমি প্রায় নিঃস্ব।”

চট্টগ্রাম নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনাল-১ এ বিচারাধীন মামলার সংখ্যা চার হাজার ৯৯টি। জানুয়ারি মাসে ৭৪টি মামলার নিষ্পত্তি করা গেলেও ফেব্রুয়ারিতে কোনোটিই এগোয়নি বলে জানান এ ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী জেসমিন আক্তার।

“৭২টি মামলা রায়ের জন্য অপেক্ষমান। বিচারপ্রার্থী নারীদের জন্য এ অবস্থা অত্যন্ত কষ্টকর। বিশেষ করে থানায় মামলা করতে না পেরে যারা আদালতে আসেন তাদের মামলা না করেই ফিরতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নির্যাতনের আলামতও নষ্ট হচ্ছে।”

দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী জানান, দুর্নীতির প্রায় চারশ মামলার মধ্যে দেড়শটিতে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ আছে। বাকি মামলাগুলো চলছে।

“প্রতি মাসে গড়ে তিন থেকে পাঁচটি মামলার নিস্পত্তি হয়। কিন্তু এখন সব কার্যক্রম বন্ধ। শুধু পরবর্তী তারিখ ধার্য করেই নির্ধারিত দিনের কাজ শেষ হচ্ছে।”

সংশ্লিষ্টদের তথ্য অনুযায়ী, ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম আদালতে ২২ হাজার ৫৬৩টি ও মুখ্য মহানগর ‍হাকিম আদালতে ১৩ হাজার ৭৯২টি মামলা বিচারাধীন ছিল। জেলা ও দায়রা জজ আদালতে প্রায় নয় হাজার এবং মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে ২১ হাজার মামলা ছিল বিচারের অপেক্ষায়।

চট্টগ্রাম আদালতের এক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী বলেন, সমিতির তিন হাজার চারশ সদস্যসহ প্রায় চার হাজার আইনজীবী কর্মরত। তাদের সহকারী ও কার্যালয়ের কর্মচারীরাও আইনজীবীদের আয়ের ওপর নির্ভরশীল।

“পুরনো সিদ্ধান্তের কারণে অনেক সাধারণ আইনজীবীর জীবনধারণ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। বিচার প্রার্থীরাও বঞ্চিত হচ্ছেন।”

এই পরিস্থিতিতে গত ২২ ফেব্রুয়ারি আইনজীবী সমিতির সাবেক ১২ সভাপতি ও ১৭ সাধারণ সম্পাদক ২৬ বছর আগের সেই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার বিষয়ে বৈঠক করলেও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

বৃহস্পতিবার আবারও তাদের বসার কথা রয়েছে, যাতে সমিতির সাবেক নেতাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সমর্থিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী সম্মিলিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদ, বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ও ইসলামী ভাবধারায় বিশ্বাসী আইনজীবী ঐক্য পরিষদ সাধারণ এবং মুক্তিযুদ্ধ ও আইনজীবীদের স্বার্থে দুর্নীতিমুক্ত ঐক্য প্রত্যয়ী সমমনা আইনজীবী সংসদের প্রতিনিধিদের উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে।

সমিতির সভাপতি সমন্বয় পরিষদ নেতা মজিবুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সেই সময় ও আজকের প্রেক্ষিত সম্পূর্ণ ভিন্ন। নাটোর, রাজশাহী ও ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় এ ধরণের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হয়েছে। কয়েকজনের কট্টর বিরোধীতার কারণে এখানে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে সমস্যা হচ্ছে। মানবিক দিক বিবেচনায় এ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা দরকার।”

সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও ঐক্য পরিষদ নেতা এনামুল হক বলেন, “সিদ্ধান্ত লিখিতই ছিল। তবে অনুলিপিটা পাচ্ছি না। বিচার প্রার্থী ও আইনজীবী সবার অনুভূতির বিষয়েই আমরা সচেতন। তবে আমার একার চিন্তায় কিছু হবে না। সভায় সিদ্ধান্ত হলে তখন বলতে পারব।”