মান্না ১০ দিনের রিমান্ডে

সেনা বিদ্রোহে উসকানি দেওয়ার মামলায় নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের পুলিশ হেফাজতে পাঠিয়েছে আদালত।

আদালত প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Feb 2015, 10:07 AM
Updated : 25 Feb 2015, 03:04 PM

বুধবার তাকে ঢাকার মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে গুলশান থানার সহকারী পরিদর্শক আব্দুল বারিক ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করলে মহানগর হাকিম মাহবুবুর রহমান তা মঞ্জুর করেন।

এ সময় মান্নার পক্ষে জামিন আবেদন করা হলেও বিচারক তা নাকচ করে দেন। 

আদালতে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে মান্না বলেন, “পেট্রোল বোমার বিপক্ষে আমি কথা বলেছি। আমি বলেছি, গণতান্ত্রিক আন্দোলন হওয়া উচিত, নাশকতা হওয়া উচিত না।”

সেনাবাহিনীর কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে তার কথা হয়নি জানিয়ে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মান্না বলেন, “আমি যে কনভারসেশন করেছি তা লাইন টু লাইন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সামরিক বাহিনীর কারো সঙ্গে আমার কোনো কথা হয়নি।”

ফাঁস হওয়া টেলিফোন কথোপকথনে বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকার সঙ্গে আলাপচারিতায় সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরদারে বিশ্ববিদ্যালয়ে লাশ ফেলা নিয়ে মান্নাকে কথা বলতে শোনা গেছে।

এ বিষয়ে আদালতে মান্না বলেন, “কনভারসেশনে আমি বলেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতান্ত্রিক ছাত্র আন্দোলনের কথা। লাশ ফেলার কথা বলিনি।”

আদালতে মান্নার রিমান্ড আবেদন বাতিল ও তার জামিন আবেদনের পক্ষে বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের নেতা সানাউল্লাহ মিয়া, মহসিন মিয়া এবং অ্যাডভোকেট আব্দুল মান্নান শুনানিতে অংশ নেন। সেনানিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে গ্রেপ্তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের পক্ষে আইনি লড়াই চালিয়ে আলোচিত হয়েছিলেন মান্নান।

আদালতে মান্নার আইনজীবী আব্দুল মান্নান খান রিমান্ড আবেদন বাতিল করে জামিনের আবেদন করেন।

শুনানিতে তিনি বলেন, “আসামি মান্নার যদি এক্সট্রা জুডিশিয়াল কনফেশন থাকেই ওই ভাইবার কথোপকথনে, তবে তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার দরকার কী?

“রিমান্ড আবেদনে বলা হয়েছে, টেলিফোনের কথপোকথনে অপর প্রান্তে অজ্ঞাতনামা আর কোন প্রবাসী ছিলেন, তা জানার জন্য মান্নাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ প্রয়োজন। গোয়েন্দারা সব উদ্ধার করতে পারলেন, অথচ অজ্ঞাতনামার পরিচয় উদ্ধার করতে পারলেন না!”

কথোপকথনে মান্না রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীকে উসকে দিয়েছেন বলে প্রমাণিত হয় না বলেও দাবি করেন তার আইনজীবী।

“মান্না কাকে, কী প্রপোজ করলেন, আর পেপারের কথাই যদি সব সত্য হয়, তাহলে তাকে আবার জিজ্ঞাসাবাদ কেন? সব তথ্য তো উদ্ধার হয়েই গেছে।”

ছবি: তানভীর আহমেদ/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

৬২ বছর বয়সী মান্নাকে রিমান্ডে নিলে তার স্বাস্থ্যহানি ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে অ্যাডভোকেট মান্নান বলেন, “তিনি হার্টের রোগী। ডায়াবেটিস, কিডনি, লিভারের বিভিন্ন অসুখে আক্রান্ত।

“রিমান্ড বাতিল করে বিচারক যদি তারিখ সময় নির্ধারণ করে দেন তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করতে, তবে তিনি আদালতের সে আদেশ পালন করবেন।”

আরেক আইনজীবী আনোয়ার জাহিদ ভুইয়া নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ককে আটকের পর রাখ-ঢাক নিয়ে বলেন, “তাকে গোয়েন্দারা আটক করে নিয়ে তা আবার অস্বীকার করল । পত্রিকায়ও সেটা প্রকাশিত হল। পত্রিকায় প্রকাশিত টেলিফোনিক কথাবার্তা বিশ্বাস করলে পত্রিকার এ কথাও বিশ্বাস করতে হবে।”

ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে প্রার্থিতার ঘোষণা দেওয়ায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মান্নার বিরুদ্ধে এই মামলা হয়েছে বলে দাবি করেন জাহিদ ভুইয়া।   

“রিমান্ডে নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে মেরে ফেলতে পারে। আর যদি নাও মেরে ফেলে তবে তিনি ভবিষ্যতে যেন নির্বাচনে দাঁড়াতে না পারে সে ব্যবস্থা করা হবে।”

মান্নার বিচারকের সঙ্গে কথা বলতে চান বলে তার এক আইনজীবী তার অনুমতি চাইলে দুই পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে হট্টগোল সৃষ্টি হয়।

আদালতের অনুমতি নিয়ে কাঠগড়ায় মান্না তার বক্তব্যের এক পর্যায়ে গত সংসদ নির্বাচনকে ‘বিতর্কিত’ বললে তা নিয়েও দুই পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে হট্টগোল সৃষ্টি হয়।

রিমান্ড আবেদনের বিরোধিতা করে বিএনপি সমর্থক আইনজীবী নেতা সানাউল্লাহ মিয়া এবং ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মহসীন মিয়া বক্তব্য রাখেন।

তারা বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী ও শামসুজ্জামান দুদুর এক নাগাড়ে অযৌক্তিক কারণে রিমান্ডে নেওয়া হয় বলে অভিযোগ তুলে মান্নার রিমান্ডের আবেদনকে ‘অযৌক্তিক’ দাবি করেন।

আদালতে রিমান্ডের পক্ষে শুনানি করেন ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পিপি আবদুল্লাহ আবু এবং অতিরিক্ত পিপি শাহ আলম তালুকদার।

চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে জাতীয় সংলাপের অন্যতম উদ্যোক্তা মান্নার সঙ্গে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা এবং অজ্ঞাত পরিচয়ের এক ব্যক্তির টেলিফোনে কথা বলার দুটি অডিও ক্লিপ রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের হাতে আসে।

ওই অডিও টেপের ভিত্তিতে সংবাদ প্রকাশের পর সারা দেশে শুরু হয় তুমুল আলোচনা। বিশ্ববিদ্যালয়ে লাশ চাওয়ায় মান্নাকে গ্রেপ্তারের দাবি তোলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

এরইমধ্যে মঙ্গলবার ভোররাতে বনানীতে তার ভাইয়ের বাসা থেকে গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয়ে মান্নাকে তুলে নেওয়া হয় বলে তার পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়।

তখন পুলিশের পক্ষ থেকে বিষয়টি অস্বীকার করা হলেও আটকের ২১ ঘণ্টা পর এই রাজনীতিবিদকে গুলশান থানায় হস্তান্তর করে র‌্যাব। সেখান থেকে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে।

র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক জিয়াউল আহসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ফৌজদারি দণ্ডবিধির ১৩১ ধারায় মান্নার বিরুদ্ধে গুলশান থানায় একটি মামলা হয়েছে, যাতে সশস্ত্র বাহিনীকে বিদ্রোহের উসকানি দেওয়া অভিযোগ আনা হয়েছে।

সশস্ত্র বাহিনীতে বিদ্রোহ সংঘটনে কেউ উসকানি দিলে বা এ ধরনের কোনো কর্মকর্তা, নাবিক বা এয়ারম্যানকে তার আনুগত্য বা দায়িত্ব থেকে প্ররোচিত করার চেষ্টা করলে তার শাস্তির জন্য সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কিত অপরাধ বিষয়ক দণ্ডবিধির সপ্তম অনুচ্ছেদের ১৩১ ধারা প্রযোজ্য হয়।

এই ধারায় সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে।

ছবি: তানভীর আহমেদ/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

মঙ্গলবার গুলশান থানার এসআই সোহেল রানার দায়ের করা এ মামলায় মান্নার সঙ্গে টেলিফোন আলাপে থাকা অজ্ঞাতপরিচয় সেই ব্যক্তিকেও আসামি করা হয়েছে।

অডিও টেপে ওই ব্যক্তির সঙ্গে টেলিফোন সংলাপে সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ দুই কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠকের পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলতে শোনা যায় মান্নাকে।

ওই ব্যক্তি কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলিয়ে দেওয়ার আগ্রহ দেখালে মান্নাকে বলতে শোনা যায়, “জুনিয়র সিনিয়রতো একটা ব্যাপার আছে। তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে যে ইফেক্টিভ যারা। অ্যান্ড হু আন্ডারস্ট্যান্ড, হু নো, এ রকম হলে ভালো।

“মানে যার সাথে শেয়ার করা যাবে, যিনি আমাকে এনলাইটেন করতে পারবেন এবং মে বি আমিও তাকে বুঝতে পারব, বোঝাতে পারব।”

বামপন্থি ছাত্র সংগঠনের নেতা হিসেবে ডাকসুর দুই বারের নির্বাচিত ভিপি মান্না আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে সাংগঠনিক সম্পাদক হলেও ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর ‘সংস্কারপন্থি’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে কর্মীদের রোষের মুখে পড়েছিলেন।

মান্নাকে আটকের খবরে বুধবার বিএনপির প্যাডে পাঠানো এক বিবৃতিতে দলটির যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমেদ ক্ষোভ জানিয়ে অবিলম্বে তাকে পরিবারের কাছে ফেরত দিতে সরকারকে আহ্বান জানান।

অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতাদের অভিযোগ, মান্না বিএনপির সঙ্গে যোগসাজশ করে অসাংবিধানিক শক্তিকে ক্ষমতায় আনার ষড়যন্ত্র করছিলেন।