সিএজি কার্যালয়ে নিয়ন্ত্রণহীন দুর্নীতি: টিআইবি

বাংলাদেশ সরকারের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ে ‘নিয়ন্ত্রণহীন দুর্নীতির চিত্র’ তুলে ধরেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ। 

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Jan 2015, 10:18 AM
Updated : 29 Jan 2015, 11:39 AM

এক ‘গবেষণা প্রতিবেদনে’ সংস্থাটি বলেছে, এ কার্যালয়ে নিয়োগ থেকে শুরু করে আপত্তি নিষ্পত্তি পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে চার-পাঁচ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে। একজন কর্মচারী নিয়োগেও মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সাংসদ, সংসদীয় কমিটির সভাপতির তদবির চলে সেখানে।

বৃহস্পতিবার টিআইবির ধানমণ্ডি কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে ‘সিএজি: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এই প্রতিবেদন তুলে ধরেন প্রোগ্রাম ম্যানেজার দিপু রায়।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, রাজনৈতিক প্রভাবে মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। দুর্নীতি সনাক্ত ও নিয়ন্ত্রণে সিএজি নিজেই নিয়ন্ত্রণহীন হড়ে পড়েছে।

“মহা হিসাব-নিরীক্ষকের কার্যালয়ে নিয়োগ, পদোন্নতি, পদায়ন ও প্রশিক্ষণে বিশেষ সুযোগ প্রাপ্তিতে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব, নিরীক্ষক, অধস্তন নিরীক্ষক ও গাড়িচালক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ গ্রহণে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে।”

সিএজি কার্যালয়ের নিরীক্ষা দলের বিরুদ্ধে অডিট ইউনিট থেকে ১০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ আদায়ের অভিযোগও তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে। টিআইবি বলছে, এই ঘুষের পরিমাণ নির্ভর করে ‘অডিট ইউনিটের বাজেটের’ ওপর।

এছাড়া পছন্দমত নিরীক্ষা, পূর্ত অধিদপ্তরের নিরীক্ষা, সিভিল অডিট, বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্প অডিট, বাণিজ্যিক অডিট, প্রতিরক্ষা অডিট, অডিট আপত্তি নিষ্পত্তি, ডাক-তার অডিট ও দীর্ঘদিনের পুরনো আপত্তি নিষ্পত্তিতে সিএজি কার্যাতলয়ে সর্বনিম্ন ৪-৫ হাজার টাকা থেকে দেড় লাখ টাকা ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ তুলে ধরেছে টিআইবি।

এ সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জমান বলেন, ক্ষেত্র বিশেষে সিএজি নিয়োগে `দলীয় রাজনৈতিক বিবেচনাকে' প্রাধান্য দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে।

“সিএজি-তে একজন কর্মচারী নিয়োগে ৬ জন মন্ত্রী, দুজন প্রতিমন্ত্রী, সংসদীয় কমিটির এক সভাপতি, সংসদ সদস্য, পিএসসির সদস্যসহ সরকারি দলের রাজনৈতিক নেতার তদবির-চাপ প্রয়োগ হয়েছে। বলা যায়- যারা দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করার কথা তারাই নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে।”

ইফতেখারুজ্জমান বলেন, “সিএজি কার্যালয়ে দুর্নীতির যে চিত্র- তা অগ্রহণযোগ্য। যে প্রতিষ্ঠানটি দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরবে তাতেই ব্যাপকভাবে দুর্নীতি চলছে। এটি প্রতিকার করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।

টিআইবি চেয়ারপারমন সুলতানা কামাল বলেন, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও সবার স্বাধীনভাকে কাজ করার কথা বলা হলেও শেষ পর্যন্ত ঘুরে ফিরে ‘একই জায়গা থেকে’ নির্দেশ আসে, যা গণতন্ত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলা যায় না।

“নিরীক্ষার জন্যে যে এখতিয়ারভুক্ত প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেখানে নানাভাবে তাদের সাংবিধানিক ক্ষমতা খর্ব করার জন্যে নির্বাহীর কাছে দায়-দায়িত্বটা দেওয়া রয়েছে। ঘুরেফিরে সেই নির্বাহী অধীনেই থাকল প্রতিষ্ঠানটি। স্বাধীনভাবে সাংবিধানিক দায়িত্বগুলো পালন করতে পারছে না সংস্থাটি।”

তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর অফিসেও যখন অডিট করা হবে, সেটা করতে গিয়ে তাকে যখন প্রধানমন্ত্রীর কাছে কোনো না কোনোভাবে দায়বদ্ধ থাকতে হয়, তখন তার স্বাধীনতা কীভাবে বজায় থাকবে? দেশে সবাই এমন একটা সংস্কৃতির মধ্যে বাস করছে যেখানে যে যার ওপরে রয়েছে সে তার ক্ষমতাটা প্রয়োগ করে।”

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ২০১৩ সালের মার্চ থেকে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে ৪০টি সরকারি কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে এ গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।

এর আগে ২০০২ ও ২০১২ সালেও সিএজি কার্যালয় নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল টিআইবি।

চ্যালেঞ্জ ও সুপারিশ

দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ও দক্ষ জনবল এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সুযোগ সুবিধার ঘাটতি; নিরীক্ষা প্রতিবেদনের দীর্ঘসূত্রতা, সিএজির কাজের জবাবদিহিতা কৌশল না থাকা এবং তথ্য প্রকাশ প্রক্রিয়া সচল না থাকাকে এ প্রতিষ্ঠানের ‘অভন্তরীণ চ্যালেঞ্জ’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, গত বছর নভেম্বরে প্রথমবারের মতো সিএজি প্রতিবেদনের প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছিল, যা যথেষ্ট নয়। এই ধারা অব্যাহত রাখতে হবে।

পরিস্থিতির উত্তরণে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদী ২০ দফা সুপারিশ করেছে টিআইবি।

এর মধ্যে অংশীজনের মাধ্যমে আলোচনা করে আইন-বিধি-অর্গানোগ্রাম অনুমোদন, সিএজি কার্যালয়কে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখা, সিএজিকে উচ্চ আদালতের বিচারপতির সমান মর্যাদা দেওয়া, বাজেট-নিয়োগে সাংবিধানিক স্বাধীন ক্ষমতা দেওয়া, জনবল বাড়িয়ে নিয়মানুবর্তী নিরীক্ষা চালুর সুপারিশও রয়েছে।