অবরোধ: বাসের সুপারভাইজার থেকে রিকশাচালক

বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের টানা অবরোধে বিপর্যয় নেমে এসেছে জয়পুরহাটের পরিবহন ব্যবসায়। নাশকতার আশঙ্কায় রাস্তায় গাড়ি না নামানোয় প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ লোকসান গুণতে হচ্ছে মালিকদের।

মোমেন মুনি জয়পুরহাট প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Jan 2015, 04:09 AM
Updated : 28 Jan 2015, 04:09 AM

তবে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন এই খাতের শ্রমিকরা, যাদের অনেকে পেশা বদলে করছেন সংসার চালানোর  চেষ্টা। পরিবারের মুখে খাবার তুলে দিতে রিকশা-ভ্যানও চালাচ্ছেন অনেক শ্রমিক। অনিশ্চিত পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হতে পারে- এই আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন তারা।

বিএনপি-জামায়াতের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত জয়পুরহাটে আগেও বিভিন্ন সময় হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচিতে জ্বালাও-পোড়াও, হত্যাসহ সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে।

এবারের অবরোধেও রেললাইন উপড়ে ফেলাসহ যাত্রীবাহী বাস ও পণ্যবোঝাই ট্রাকে আগুন দেওয়ার কয়েকটি ঘটনার পর জেলায় যানবাহন চলাচল কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে।

জয়পুরহাট শহরের কাশিয়াবাড়ি এলাকার মুনির হোসেন একটি বাস কোম্পানির সুপারভাইজার ছিলেন। এখন রিকশা চালান।

“চুরি-ডাকাতি তো করতে পারব না, তাই সংসার চালাতে রিকশা চালানো ছাড়া আমার আর কোনো পথ খোলা নাই,” কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন তিনি।

বাসের হেলপার সদরের বম্বু গ্রামের ফিরোজ মিয়া, পাঁচবিবি শহরের মধু মিয়া, সরওয়ার হোসেনসহ অনেক শ্রমিক রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ। তাদের আক্ষেপ, বড় দুই দল পালা করে ক্ষমতায় আসে আর বিরোধী দলে থেকে হরতাল-অবরোধ করে, মাঝখানে কষ্ট হয় তাদের মতো খেটে খাওয়া মানুষদের।

জয়পুরহাট মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা জানান, জেলার অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন রুটে দেড় শতাধিক যাত্রীবাহী বাস ছাড়াও ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ বিভিন্ন পথে প্রায় ৪০টি দূরপাল্লার কোচ চলাচল করে। অবরোধের মধ্যে এ জেলায় একটি দূরপাল্লার বাস, পাঁচটি ট্রাক ও একটি প্রাইভেটকারে আগুন দেওয়া হয়েছে।

“এ অবস্থায় সরকারের ক্ষতিপূরণের আশ্বাসেও মালিকরা তাদের যানবাহন চালাতে সাহস পাচ্ছেন না। ফলে বেকার হয়ে পড়েছে তিন হাজারের বেশি শ্রমিক,” বলেন তিনি।

 

সংগঠনের সহসাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন জানান, একজন শ্রমিকের দৈনিক গড় পারিশ্রমিক ৩০০ টাকা হিসাবে স্বাভাবিক সময়ে তিন হাজার শ্রমিকের প্রায় ১০ লাখ টাকা আয় হত, যা এখন বন্ধ হয়ে গেছে।

দূরপাল্লার বাসের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা বলে জানান রফিকুল ইসলাম রফিক নামে জয়পুরহাট শহরের এক বাসমালিক।

তিনি বলেন, “দূরপাল্লার একটি বাসের দৈনিক আয় ৫ হাজার টাকা হিসাবে ৪০টি বাস থেকে দুই লাখ টাকা আসার কথা। এছাড়া স্বল্প দূরত্বের জেলাগুলোয় চলাচলকারী দেড় শতাধিক বাস থেকে গড় আয় ৩ লাখ টাকার বেশি। অবরোধের কারণে এসব বাস না চলায় প্রতিদিন গড়ে ৫ লাখ টাকা আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন মালিকরা।”

যারা ঋণের টাকায় গাড়ি কিনেছেন তারা এখন ঋণ পরিশোধ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন বলে জানান এই বাসমালিক।

এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে দুই নেত্রীকে সমঝোতায় আসার আহ্বান জানিয়েছেন পরিবহন ব্যবসায়ীরা।

এদিকে দূরপাল্লার বাস বন্ধ থাকায় যাত্রীদের বাড়তি চাপ বেড়ে গেছে ট্রেনের ওপর। অবরোধের মধ্যে প্রতিদিনই জেলার ছয়টি রেলস্টেশনে দেখা গেছে যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড়। কিন্তু ট্রেনের সময়সূচি এলোমেলো হয়ে যাওয়ায় সেখানেও ভোগান্তি। ট্রেনে বাড়তি চাপের কথা স্বীকার করেছেন জয়পুরহাট রেলস্টেশনের মাস্টার নূরল ইসলাম।

নির্দলীয় সরকারের অধীনে মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনরত বিএনপি-জামায়াত জোট গত ৬ জানুয়ারি থেকে সারা দেশে লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি পালন করছে।

অবরোধে রাজধানীসহ দেশের প্রধান প্রধান শহরগুলোতে যানবাহন চলাচল অনেকটা স্বাভাবিক সময়ের মতো থাকলেও গাড়িতে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ ও অগ্নিসংযোগে হতাহতের ঘটনা ঘটছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাহারায় মহাসড়কে দূরপাল্লার বাস ও পণ্যবোঝাই ট্রাক চলাচল করছে। তবে এই পাহারার মধ্যেই বিভিন্ন জায়গায় গাড়িবহরে হামলার ঘটনা ঘটেছে।

নাশকতার এসব ঘটনায় অন্তত ৩৬ জনের মৃত্যু হয়েছে, যাদের বেশিরভাগই অগ্নিদগ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন কয়েকশ মানুষ।