দেহ পুড়েছে, স্বপ্ন হারায়নি তারা

ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিট, দ্বিতীয় তলায় উঠতেই বিছানায় দেখা যায় সালাউদ্দিন পলাশকে। চিকিৎসকদের নথি বলছে, দুই হাত ও মুখের ২৫ ভাগ পুড়েছে পলাশের, ভেঙেছে বাম পাও। 

গোলাম মুজতবা ধ্রুববিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Jan 2015, 03:30 PM
Updated : 27 Jan 2015, 05:34 PM

যন্ত্রণায় গোঙাচ্ছিলেন পলাশ, পাশে বসে একনাগাড়ে কেঁদে যাচ্ছিলেন স্ত্রী নাসরিন। ছোট্ট শিশু ইভা অগ্নিদগ্ধ বাবার দিকে চেয়ে থাকলেও কাছে ঘেঁষছিল না, কিছুটা ভয়ে।

কেমন লাগছে- জানতে চাইলে ক্ষীণ কণ্ঠেই পলাশ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সকালে ড্রেসিং দিছে। এখন আগের চেয়ে একটু ভালো লাগতাছে।”

তবে পরক্ষণে যে কথাটি বলেন, তাতে কণ্ঠস্বর একটু চড়ে আসে পলাশের- “আল্লাহ পরীক্ষা করতাছে, কষ্ট দিতাছে। তয় মন ভাঙমু না। জীবনটা তো বাঁচছে।”

ঢাকার বসুন্ধরা সিটির একটি জুতার দোকানে কাজ করেন নারায়ণগঞ্জের কাচপুরের পলাশ। বিএনপি জোটের অবরোধের মধ্যে গত শুক্রবার দোকানের কাজ শেষ করে বাসে চেপে ফিরছিলেন বাড়ি। যাত্রাবাড়ীতে বাসে ছোড়া পেট্রোল বোমা বার্ন ইউনিটে আনতে বাধ্য করেছে তাকে।

শনিবার বার্ন ইউনিটে গিয়ে পলাশকে যন্ত্রণায় কাতরাতে দেখা যাচ্ছিল। একদিন বাদে তার সঙ্গে কথা বলে মনে হল, দেহ পুড়লেও স্বপ্ন হারাননি তিনি।

পলাশের মতো আরও কয়েকজনের দেখা মিলল বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় হাসপাতালে অগ্নিদগ্ধদের ইউনিটে, যারা চলমান রাজনৈতিক সহিংসতায় আগুনের ক্ষত নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন চিকিৎসা নিতে।

তাদেরই একজন মো. খোকন, যার শরীরের ২০ ভাগ পুড়ে গেছে। পলাশের সঙ্গে কথা বলে তার বিছানায় গিয়ে দেখা যায়, খোকনকে তার বড় বোন সালমা চামচ দিয়ে খাবার খাইয়ে দিচ্ছেন।

সালমা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এক বছর আগে খোকনের একটা মেয়ে হয়েছে। তবে মেয়েটির পায়ে সমস্যা। তার চিকিৎসার জন্য অনেক কষ্ট করে টাকা জোগাড় করছিল খোকন।

এই সময় খোকন বলে ওঠেন, “আমি সুস্থ হইয়া আবার কামে ফিরতে চাই। সংসারে আমি ছাড়া কেউ কাম করে না। বাঁচনা থাকলে, সুস্থ হওনের লগে লগে কাম শুরু করুম।”

ভাইয়ের দগ্ধ শরীর দেখে তার পেছনে দাঁড়িয়ে তখন চোখের জল মোছার চেষ্টা করছিলেন সালমা।

বার্ন ইউনিটের এইচডিইউ ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছেন ঢাকার এলিফেন্ট রোডের সিটি সুপার মার্কেটের কর্মচারী মো. সালাউদ্দিন।

যাত্রাবাড়ীতে নাশকতার শিকার ওই বাসের যাত্রী ছিলেন নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার সালাউদ্দিনও। তার দেহের ২৮ ভাগ পুড়েছে।

সালাউদ্দিনের স্ত্রী উর্মি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সকাল থেইকা উনি উইঠা বসতে চাইছেন। বেডে সবাই ধইরা বসাইসি। নড়াচড়া করছেন। আমাগো লগে কথা কইছেন। বাচ্চাগো খবরও নিছেন। দুপুরে তরকারি দিয়া অল্প ভাতও খাওয়াইছি।”

স্বামীর জন্য ২৪ ঘণ্টা আগেও প্রচণ্ড দুশ্চিন্তা ছিল দুই সন্তানের মা উর্মির। কিন্তু এখন নিজেই স্বামীকে বলছিলেন, “আল্লাহ তোমারে ভালো কইরা দিব। সবাই দোয়া করতাছে। আমরা আবার বাড়ি যামু। পোলারা তোমার অপেক্ষায় আছে।”

যাত্রাবাড়ীর বাসযাত্রীদের মধ্যে ৩১ জন দগ্ধ হলেও তার মধ্যে ছয়জনের অবস্থা ছিল গুরুতর। তবে চিকিৎসায় তাদের অবস্থার উন্নতি হচ্ছে বলে জানালেন বার্ন ইউনিটের উপদেষ্টা ডা. সামন্ত লাল সেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দগ্ধদের মধ্যে ছয়জনের অবস্থা প্রথমদিন আশঙ্কাজনক ছিল। এখন অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।”

বার্ন ইউনিটের আবাসিক চিকিৎসক পার্থ শংকর পাল বলেন, “চিকিৎসকরা তাদের সুস্থ করতে সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।”

তিনি জানান, ৫ জানুয়ারির পর থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন গণপরিবহনে দুর্বৃত্তদের ছোড়া পেট্রোল বোমায় দগ্ধ ৭৮ জন চিকিৎসা নিতে এখানে আসেন। এর মধ্যে ২১ জনকে চিকিৎসার পর বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ৫২ জন এখনও ভর্তি রয়েছেন।

বিভিন্ন স্থান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনাদের মধ্যে পাঁচজন মারা গেছেন বলে বার্ন ইউনিটের এই চিকিৎসক জানান।

রাজনৈতিক সহিংসতার বলি এই সব মানুষের চিকিৎসার জন্য প্রধানমন্ত্রী সহায়তা দিচ্ছেন। উন্নত চিকিৎসার জন্য দুজনকে বিদেশে পাঠিয়েছেন তিনি, আরও দুজনকে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। 

প্রধানমন্ত্রীর উপ প্রেসসচিব আশরাফুল আলম খোকন জানান, পেট্রোল বোমার আগুনে পুড়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে বর্তমানে চিকিৎসা নিচ্ছেন ৭৪ জন। প্রত্যেককেই প্রধানমন্ত্রী হাতখরচ হিসেবে ১০ হাজার টাকা অনুদান দিচ্ছেন।

অবরোধের মধ্যে অগ্নিদগ্ধ হয়ে নতুন রোগী হাসপাতালে আসার মধ্যেই একই ঘটনার শিকার হয়ে আগে ভর্তি হওয়াদের উঠে দাঁড়াতে দেখা যাচ্ছে।  

ওদেরই একজন নাটোরের পাটুল গ্রামের নূর আলম। শনিবার তাকে অচেতনের মতো বিছানায় পড়ে থাকতে দেখা গেলেও একদিন বাদেই বিছানায় বসার চেষ্টা করতে দেখা যায়।

৪৬ ভাগ দগ্ধ আলমের স্ত্রীর বড় ভাই মিন্টু মিয়া বলেন, “ওরে দেইখা আইজ কিছুটা ভাল লাগতাছে। মনে হইতাছে আমার বোনটা আবারও সুখের সংসার করতে পারব।”