জিহাদের মৃত্যু: তোপের মুখে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী

শিশু জিহাদের উদ্ধার তৎপরতার মধ্যে পাইপে তার অবস্থান নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে সমালোচনার মুখে পড়েছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। অভিযোগ ওঠেছে, ওই মন্তব্যের পরই উদ্ধার তৎপরতা শিথিল হয়ে পড়েছিল।

গোলাম মুজতবা ধ্রুববিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Dec 2014, 10:08 AM
Updated : 28 Dec 2014, 07:50 PM

কেউ কেউ আক্ষেপ করেছেন, মন্ত্রী ‘দায়িত্বহীন’ বক্তব্য না দিলে হয়তো সব ঠিকঠাক থাকতো, জীবিত জিহাদকে পেত স্বজনরা।

ঘটনাস্থল ছাড়াও ফেইসবুক ওই বক্তব্যের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন অসংখ্য মানুষ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগের পাশাপাশি ব্যর্থতার জন্য সংশ্লিষ্টদের বিচারও চেয়েছেন তারা।

শুক্রবার বিকালে শাহজাহানপুর রেল কলোনির পরিত্যক্ত একটি গভীর নলকূপের পাইপে চারবছর বয়সী শিশু জিহাদ পড়ে যাওয়ার পর প্রায় ২৩ ঘণ্টা ধরে চলে রুদ্ধশ্বাস অভিযান। পাইপের ভেতরে চটের বস্তা, দড়ি, ক্যামেরা নামিয়ে চলে জিহাদকে উদ্ধারের চেষ্টা।

ক্যামেরায় পাইপের ভেতরে মানবদেহের অস্তিত্ব না পাওয়ার কথা ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে জানানোর পর শনিবার ভোররাতে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল পাইপে জিহাদের অবস্থান নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন।   

তিনি বলেন, “আমার মনে হল, এখানে কেউ নাই। তারপরও সেখানে যে আবর্জনা আছে, তা তুলে দেখা হবে। ফায়ার সার্ভিসের ডিজি আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাবেন। তবে আমি নিশ্চিত, এখানে কোনো মানুষ নেই।”

তারও ১১ ঘণ্টা পর শনিবার দুপুরের পর পাইপে জিহাদ নেই বলে ফায়ার সার্ভিস অভিযান সমাপ্ত ঘোষণার কয়েক মিনিটের মধ্যে কয়েক তরুণের প্রচেষ্টায় জিহাদকে পাইপের ভেতর থেকে তুলে আনা হয়। পরে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয় হাসপাতালে।

বের করে আনা হচ্ছে জিহাদকে। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি /বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

চ্যানেল আইয়ের বার্তা সম্পাদক জাহিদ নেওয়াজ খান তার ফেইসবুক পাতায় লেখেছেন- “আমরা কি ওই পাইপের মুখ উন্মুক্ত থাকার জন্য যারা দায়ী তাদের ফায়ারিং স্কোয়াডে নিয়ে যাওয়ার দাবি জানাতে পারি না? আমরা কি বিচার চাইতে পারি না সেইসব পুলিশ সদস্যদের যারা জীবনের চরম দুর্যাগময় সময়ে শিশু জিহাদের বাবাকে ১২ ঘণ্টা আটকে রেখেছিল? আমরা কি দায়িত্বহীন বক্তব্যের জন্য স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর পদত্যাগ চাইতে পারি না?”

উদ্ধার তৎপরতা শেষ হওয়ার আগে অভিযান বন্ধ ঘোষণার জন্য ফায়ার সার্ভিসের সংশ্লিষ্টদের দায়ী করেছেন এই গণমাধ্যমকর্মী।

ইমন মির্জান নামে একজন ফেইসবুক পাতায় লেখেন, জিহাদের মৃত্যুর জন্য দায়ী স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, ফায়ার সার্ভিস আর প্রশাসন। উদ্ধারে ২৩ ঘণ্টা সময় কেন লাগবে? তাহলে কি ডিজিটাল বাংলাদেশের এই অবস্থা! জিহাদকে হত্যার জন্য স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও ফায়ার সার্ভিসের সংশ্লিষ্টদের বিচার চাই।

“ফায়ার সার্ভিস ও প্রশাসনের ব্যার্থতার কারণেই এত বিলম্ব। শিশুটির মৃত্যুর জন্য তারাই দায়ী। তাই ফায়ার সার্ভিস, বুয়েটের বিশেষজ্ঞ দলের সাথে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বিচার চাই,” নিজের ফেইসবুক পাতায় লিখেছেন মো. আকরামুল ইসলাম নামে একজন।

ব্যক্তিগত কাজে ঢাকায় আসা যুক্তরাজ্যের মিডলসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক ড. সাহেদুর রহমান কৌতুহলবশেই গিয়েছিলেন ঘটনাস্থলে।

ইমেজ প্রসেসিংয়ে পড়াশোনা থাকা এই শিক্ষক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ঘটনাস্থলে আসার পর ফায়ার সার্ভিসের লোকেরা তাকে একটি মনিটরে কি যেন দেখালেন। এরপর স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী পাইপে শিশুটির অবস্থান নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন। এরপরই ফায়ার সার্ভিস উদ্ধারকাজ শিথিল করে ফেলে। উপস্থিত অনেক সাংবাদিক ঘটনাস্থল থেকে চলে যান।

“ফায়ার সার্ভিস বলেছে তারা পাইপে অক্সিজেন সরবরাহ করেছে। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সংশয় প্রকাশের পর কিছু সময়ের জন্যও যদি অক্সিজেন বন্ধ রাখা হয় তবে শিশুটির বাঁচার কথা না। একজন জনপ্রতিনিধির এ ধরনের ভূমিকা কাম্য নয়। তার সংশয় প্রকাশের পরই গোলমালটা বাঁধে। যদি এমনটি না ঘটত, তাহলে হয়ত রাতেই জিহাদকে জীবন্ত উদ্ধার করা সম্ভব হত।”

উদ্ধারকাজে ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, “ফায়ার সার্ভিস ইনফ্রারেড ক্যামেরা ব্যবহার করলে অবশ্যই শিশুটির অবস্থান শনাক্ত করা যেত। এটি কোনো রকেট সায়েন্স না, আমাদের দেশে নিশ্চয়ই এমন ক্যামেরা আছে। তাহলে কেন তার ব্যবহার হলো না?

“ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা সেখানে একটি স্পেশাল স্কোয়াড বসাতে পারত, কীভাবে কাজ করে শিশুটিকে জীবন্ত উদ্ধার করা সম্ভব সেটি নিয়ে বিভিন্ন দেশের উদ্ধারকর্মীদের সঙ্গে ডিভিও কনফারেন্স করতে পারত, কারো সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলে পরামর্শ নিতে পারত। তাদের সেই রকম কোনো ধরনের উদ্যোগ চোখে পড়েনি।”

প্রশিক্ষিত একটি বাহিনীর দড়ি নিয়ে সনাতন পদ্ধতিতে কাজ করায় বিস্ময় প্রকাশ করেন সাহেদুর রহমান।

অবশ্য পাইপে শিশুটির অবস্থান নিয়ে সংশয় প্রকাশের কথা স্বীকার করলেও উদ্ধার অভিযান বন্ধ করতে বলেননি বলে দাবি করেছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “শনিবার ভোররাতে ঘটনাস্থলে যাওয়ার পর ফায়ার সার্ভিস আমাকে ডেকে নিয়ে ক্যামেরা দেখালো, মনিটর দেখালো। জীবন্ত কিছু তখন ক্যামেরায় দেখা যাচ্ছিল না।

“আমি চলে যাওয়ার পরও ফায়ার সার্ভিস ঘন্টাখানেক কাজ করেছিল। তারা তখন বলেছিল ২৭০ ফুট পর্যন্ত তারা শিশুর অস্তিত্ব দেখতে পাচ্ছে না। পাইপটি ছিল প্রায় ৪০০ ফুট। সেখানে কিছু সলিড সাবসটেন্স থাকায় একেবারে পাইপের নিচে কি আছে তা দেখা সম্ভব হচ্ছিল না। সলিড সাবসটেন্স সরাতে কিছু অ্যাটাচমেন্ট দরকার ছিল। রোববার সকালে সেসব সরানোর ব্যবস্থা করার কথা বলে আমি চলে গিয়েছিলাম। তারপরও তো ফায়ার সার্ভিস কাজ করেছে।

“তাছাড়া আমি কিন্তু তাদের উদ্ধার অভিযান বন্ধ করতে বলি নাই, অভিযান চালিয়ে যেতে বলেছিলাম। তারা কাজে শিথিলতা দেখিয়েছে এমনটা হয়তো সত্য না, তারপরও আমরা বিষয়টা খতিয়ে দেখবো।”

জিহাদকে উদ্ধারে ফায়ার সার্ভিস কোনো ধরনের শিথিলতা দেখায়নি বলে দাবি করেছেন বাহিনীর মহাপরিচালক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ খানও, যিনি ঘটনা নিয়ে হৈচৈ শুরুর আনুমানিক আট ঘণ্টা পর সেখানে গিয়েছিলেন।

তিনি দাবি করেন, শিশু জিহাদকে উদ্ধারে তার বাহিনীর আন্তরিকতার কোনো অভাব ছিল না। উদ্ধার অভিযানে কোনো শিথিলতাও ছিল না। নিজেদের যা আছে তা নিয়ে উদ্ধার তৎপরতা চালানোর চেষ্টা হয়েছে।

“আমাদের নিজেদের উন্নত ক্যামেরা নেই। ওয়াসার সাধারণ ক্যামেরার ওপর ভরসা করতে হয়েছে। সেটিও সার্চ ভিশন ক্যামেরা না, সাধারণ কামেরা। তাছাড়া, জিহাদকে উদ্ধারে আগে পাইপের ভেতর নামানো কিছু জিনিস সেখানে রয়ে গিয়েছিল, ফলে ক্যামেরায় পুরো ভিউ পাওয়া যায়নি।”

নিজেদের ব্যর্থতা স্বীকার না করলেও শিশুটিকে উদ্ধার করা তরুণদের সাধুবাদ জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক।