প্রশাসন উদ্যোগহীন: আতঙ্ক কাটছে না পাহাড়িদের

রাঙামাটির নানিয়ারচরে বাঙালিদের হামলা ও বাড়ি-ঘরে আগুন দেওয়ার পর এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও নিরাপত্তাহীনতা কাটেনি পাহাড়িদের।

সালাউদ্দিন ওয়াহেদ প্রীতম, নানিয়ারচর থেকে ফিরেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Dec 2014, 07:20 AM
Updated : 29 Dec 2014, 07:07 AM

গত ১৬ ডিসেম্বর নানিয়ারচরের সুরিদাশপাড়া, নবীন কার্বারী পাড়া ও বগাছড়িতে বসবাসরত পাহাড়িদের তিনটি গ্রামে হামলা চালায় ওই এলাকায় বসতি স্থাপনকারী একদল বাঙালি।

হামলায় ৫০টি ঘর এবং সাতটি দোকান পুড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি ভাংচুর-লুটপাট হয় একটি বৌদ্ধ মন্দিরও (কেয়াং)।

হামলার এক সপ্তাহ পর সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়িদের পোড়া ঘরবাড়ি এখনও মেরামত হয়নি। নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে তারা আশ্রয় নিয়েছেন আশপাশের গ্রামে।

হামলা পরবর্তী প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাহাড়ি-বাঙালি সম্প্রীতি পুনঃস্থাপনের জন্য এখনও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

রাঙামাটির সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার এই হামলা এবং পরবর্তী পদক্ষেপ না নেওয়ার জন্য প্রশাসনের সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করেছেন।

তবে জেলা প্রশাসক শামসুল আরেফিন বলেছেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সম্ভাব্য সব কিছুই করা হবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে।

সুরিদাশ পাড়ার মোড়ল রাম কার্বারী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ১৬ ডিসেম্বর সকাল ১০টার দিকে প্রায় ২০০ বাঙালি আকস্মিক হামলা হালালে তারা দ্রুত ঘর ছেড়ে আশপাশের জঙ্গলে আশ্রয় নেন। হামলাকারীরা ঘরে আগুন দিয়ে লুটপাট চালিয়ে চলে যায়।

হামলার সময় ক্ষিয়াংয়ের ভেতরেই ছিলেন এর পুরোহিত অবাসা ভিক্ষু (৭২)। তিনি বলেন, “প্রায় ৭-৮ জন বাঙালি ঢুকেই মন্দির ভাংচুর শুরু করে। আমি বাধা দিতে গেলে আমাকে চড় দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়।”

হামলাকারীরা যাওয়ার সময় মন্দিরের সাতটি পিতলের বুদ্ধমূর্তি এবং দানবাক্স ভেঙে অর্থকড়ি নিয়ে যায় বলে জানান তিনি।

গত ১৫ ডিসেম্বর রাতে বগাছড়ি এলাকায় বসবাসরত বাঙালি আফসার আলীর আনারস বাগান ধ্বংসের অভিযোগ তুলে এই হামলা চালানো হয় বলে পাহাড়িরা জানান।

নিজের পোড়া ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে সুরিদাশপাড়ার দীপ্তিময়ী চাকমা (৪৫) বলেন, “আমাদের ভয় হয়, আবার হামলা হতে পারে।”

“আমরা এখনও প্রশাসনের কাছ থেকে নিরাপত্তার কোনো আশ্বাস পাইনি। আমাদের ঘর, ফসল পুড়ে গেছে সত্য কিন্তু সবার আগে আমাদের প্রয়োজন নিরাপত্তা,” বলেন তোষণপ্রিয় চাকমা (২৬)।

স্থানীয় মাসিক পত্রিকা ‘মাওরুম’ এর সম্পাদক দীপায়ন খীসা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নানিয়ারচরে পাহাড়ি-বাঙালিদের মধ্যে ছোটখাট বিরোধ মোটামুটি নিয়মিত ঘটনা হলেও একসঙ্গে তিনটি গ্রামে হামলার মতো ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে ঘটেনি।

তিনি জানান, এর আগে ১৯৯৩ সালের ১৭ নভেম্বর নানিয়ারচর বাজারে বড় ধরনের হত্যাকাণ্ড হয়েছিল। তখন ২০ জন পাহাড়ির লাশ পাওয়া গিয়েছিল, নিখোঁজ ছিল ৫০ জনেরও অধিক।

হামলাকারীদের কাউকে গ্রেপ্তারের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। কোনো মামলা হয়নি বলেও জানান রাঙামাটির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবুল কালাম আজাদ।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ইতোমধ্যে ১১ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। আমরা আশা করছি, এই কমিটির রিপোর্ট দিলেই প্রকৃত দুষ্কৃতকারীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা যাবে।”

এই প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, তা হয়নি।

সাম্প্রতিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পাহাড়িদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে সম্প্রীতি সমাবেশের কোনো উদ্যোগ প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখনও না নেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায় জেলা প্রশাসকের কথায়।

শামসুল আরেফিন বলেন, “আমি জেলা প্রশাসক হিসেবে জয়েন করেছি ২৪ তারিখ দুপুর ২টায়। সম্প্রীতি সমাবেশ করা হবে কি না, এ বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। প্রয়োজন হলে অবশ্যই করা হবে।”

সংসদ সদস্য ও জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটি সহসভাপতি ঊষাতন তালুকদার বলেন, “রাঙামাটির প্রশাসনে চরম মাত্রায় সমন্বয়হীনতা রয়েছে। আমি নিজেই বুঝি না এখানে প্রশাসনের মূল দায়িত্বে কারা- প্রশাসন, পুলিশ, না কি সেনাবাহিনী।

“এই পরিস্থিতিতে আস্থা ফিরিয়ে আনতে কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, তা নিয়ে এখন পর্যন্ত প্রশাসনের কোনো পর্যায় থেকে আমার সঙ্গে কোনো আলাপ আলোচনা হয়নি।”

এই ধরনের পরিস্থিতিতে প্রশাসন সক্রিয় না হলে ‘ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের’  সুযোগ অন্য কেউ নিতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরকারী জনসংহতি সমিতির নেতা উষাতন।