শিশুসাহিত্যিক এখ্‌লাসউদ্দিন আহ্‌মদ আর নেই

অর্ধ শতকের বেশি সময় ধরে বাংলা ভাষার শিশু সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে চলে গেলেন শিশুসাহিত্যিক ও ছড়াকার এখ্‌লাসউদ্দিন আহ্‌মদ।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Dec 2014, 03:44 AM
Updated : 24 Dec 2014, 05:14 AM

বুধবার ভোর ৪টায় রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে ৭৪ বছর বয়সে মারা যান ঊনিশশ ষাটের দশকের জনপ্রিয় কিশোর পত্রিকা ‘টাপুর টুপুর’ এর এই সম্পাদক।

এখ্‌লাসউদ্দিনের ভাগ্নিজামাই লেখক আলী ইমাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণে গত প্রায় এক মাস ধরেই হাসপাতালে ছিলেন এখ্‌লাসউদ্দিন। অবস্থার অবনতি হওয়ায় গত পাঁচদিন ধরে তাকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখা হয়েছিল। বুধবার ভোরে সেখানেই তার মৃত্যু হয়।”

১৯৪০ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনায় জন্মগ্রহণ করেন এখ্‌লাসউদ্দিন আহ্‌মদ। শিশুসাহিত্যে অবদানের জন্য ২০০০ সালে সরকার তাকে ভূষিত করে একুশে পদকে।

সাংবাদিকতাকে পেশা হিসাবে নেওয়া এখ্‌লাসউদ্দিন দীর্ঘদিন কাজ করেছেন দৈনিক জনকণ্ঠে। তবে ছন্দের উঠোনে স্বচ্ছন্দ বিচরণ তাকে দিয়েছে ছড়াকারের খ্যাতি।

তার লেখা একদিকে শিশু কিশোরদের নির্মল আনন্দ দিয়েছে, অন্যদিকে তুলে ধরেছে দেশ ও সমাজের নানা অসঙ্গতি। কখনো আবার ছন্দে বাঁধা রাজনৈতিক প্রতিবাদও ধারণ করেছে তার ছড়া।

এখ্‌লাসউদ্দিনের সম্পাদনায় প্রকাশিত শিশু-কিশোরদের মাসিক পত্রিকা ‘টাপুর টুপুর’ ঊনিশশ ষাটের দশকে শিশু সাহিত্যের যাত্রাকে নতুন গতি দেয়। 

সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের লেখা প্রথম কিশোর উপন্যাস ‘সীমান্তের সিংহাসন’ ওই পত্রিকাতেই প্রথম প্রকাশিত হয়।

শুধু ছড়া নয়, শিশু-কিশোরদের জন্য গল্প, উপন্যাসও লিখেছেন এখ্‌লাসউদ্দিন। তার সৃষ্টি ‘তুনু’, ‘তপু’ ও ‘কেঁদো’ চরিত্রগুলো হয়ে উঠেছে শিশুদের বন্ধু। নানা দেশের গল্প, ছড়া ও কবিতার সংকলনের সম্পাদনা করেও তিনি বাংলা শিশু সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন।

সাহিত্য পত্রিকা ‘কালি ও কলম’এ প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের ছড়ায় গণচেতনা’ প্রবন্ধে বিশ্বজিৎ ঘোষ লিখেছেন, “পাকিস্তান আমলে যেমন, তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশেও স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে আমাদের ছড়াকাররা প্রতিবাদে মুখর, দ্রোহিতায় শাণিত। ঔপনিবেশিক শাসক আর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে এমন কিছু পংক্তি রচিত হয় এখ্‌লাসউদ্দিন আহ্‌মদের হাতে।”

সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে এখ্‌লাসউদ্দিন লিখেছেন, ‘হরতাল -/ আজ হরতাল/ পেটা ঢাক ঢোল/ ছোঁড় সড়কি/ আন বল্লম/ ধর গাঁইতি/ ধর বর্শা/ দাও হাতে হাত/ এই কাঁধে কাঁধ/ তোল ব্যারিকেড/ গড়ো প্রতিরোধ/ কালো দস্যির/ ভাঙো বিষ দাঁত/ ধরো হাতিয়ার/ করো গতিরোধ/... খোল করতাল/ আজ হরতাল’।

ষাটের দশকে বাংলার সাহিত্য আন্দোলনের পুরোভাগে যারা ছিলেন, এখ্‌লাসউদ্দিন ছিলেন তাদেরই একজন।

বাংলা একাডেমির দীর্ঘদিনের পরিচালক ফজলে রাব্বি এক স্মৃতিচারণমূলক প্রবন্ধে সেই সময়ের এখ্‌লাসউদ্দিনের কথা তুলে ধরেছেন।   

তিনি লিখেছেন, “বিগত তিন-চার বছরে প্রকাশনা ক্ষেত্রে আমরা (বাংলা একাডেমি) যে নতুনত্ব আনতে পেরেছিলাম, এখলাস বইঘরের সহায়তায় মাত্র দুটি বই (‘এক যে ছিল নেংটি’ ও দুই বাংলার ছড়ার সংকলন ‘ছড়ায় ছড়ায় ছন্দ’ ) প্রকাশ করে তার চেয়ে অনেক বেশি আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।... এরপর এখলাসের সম্পাদনায় মাসিক কিশোর পত্রিকা ‘টাপুর টুপুর’ প্রকাশিত হতে লাগল। সব মিলিয়ে এখলাস একাই বাংলাদেশে শিশুসাহিত্য প্রকাশনায় যেন বিপ্লব এনে ফেলল।”

কেবল একুশে পদক নয়, শিশুসাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৬২ সালে পশ্চিমবঙ্গ যুব উৎসব পুরস্কার, ১৯৭১ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ১৯৮৩ সালে আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮৬ সালে অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার, ১৯৯৯ সালে শিশু একাডেমি পুরস্কার, ২০০৪ সালে কবীর চৌধুরী শিশু সাহিত্য পুরস্কার এবং ২০০৭ সালে ইউরো শিশু সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন।

তার প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ‘এক যে ছিল নেংটি’; ‘হঠাৎ রাজার খামখেয়ালী’; ‘কাটুম কুটুম’; ‘ছোট্ট রঙিন পাখি’ এবং তনু ও তপু সিরিজের কয়েক ডজন বই।

সংকলনের মধ্যে রয়েছে- ‘বাছাই করা গল্প উপন্যাস’; ‘দুই বাংলার ছোটদের শ্রেষ্ঠ গল্প’; অশোককুমার মিত্রের সঙ্গে সম্পাদিত ‘দুই বাংলার নির্বাচিত কিশোর গল্প’; ‘সমগ্র ও সংকলন-১’ ইত্যাদি।