যুদ্ধাপরাধী কায়সারের সর্বোচ্চ সাজা

মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হবিগঞ্জে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণের মতো যুদ্ধাপরাধের দায়ে সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারকে আদালত মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে, যিনি দল বদলের কৌশলে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিমন্ত্রী বনে গিয়েছিলেন।

ফয়সাল আতিককাজী শাহরিন হক ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Dec 2014, 06:17 AM
Updated : 23 Dec 2014, 06:17 AM

১৯৭১ সালে দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় ‘কায়সার বাহিনী’ গঠন করে ওই দুই জেলায় যুদ্ধাপরাধে নেতৃত্ব দেন এই মুসলিম লীগ নেতা। জিয়াউর রহমানের আমলে তিনি হয়ে যান বিএনপির লোক, হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সময় জাতীয় পার্টির।

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ মঙ্গলবার ৭৪ বছর বয়সী এই যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ সাজার রায় ঘোষণা করে।

ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য বিচারপতি মুজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি শাহিনুর ইসলামও এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

৪৮৪ পৃষ্ঠার রায়ের সংক্ষিপ্তসার পড়ে বিচারক বলেন, সৈয়দ কায়সারের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা ১৬টি অভিযোগের মধ্যে ১৪টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।

তাকে প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়েছে ৩, ৫, ৬, ৮, ১০, ১২ ও ১৬ নম্বর অভিযোগে, যার মধ্যে দুই নারীকে ধর্ষণের ঘটনা রয়েছে। এই দুই বীরাঙ্গনার মধ্যে একজন এবং তার গর্ভে জন্ম নেওয়া এক যুদ্ধশিশু এ মামলায় সাক্ষ্যও দিয়েছেন।

ট্রাইব্যুনাল এই প্রথমবারের মতো অন্য অপরাধের পাশাপাশি ধর্ষণের দায়ে কোনো যুদ্ধাপরাধীকে ফাঁসির দণ্ডাদেশ দিল বলে প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত জানিয়েছেন।

রায়ের পর্যবেক্ষণে ট্রাইব্যুনাল বলেছে, কায়সার একাত্তরে ছিলেন পাকিস্তানি বাহিনীর একজন শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত সহযোগী। ‘কায়সার বাহিনী’ নামে দল গড়ে তিনি যেসব যুদ্ধাপরাধ ঘটিয়েছেন, সেজন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হবিগঞ্জের মানুষ তাকে একজন কুখ্যাত ব্যক্তি হিসাবেই চেনে।

“কায়সার এতোটাই নগ্নভাবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পক্ষ নিয়েছিলেন যে নিজের গ্রামের নারীদের ভোগের জন্য পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দিতেও কুণ্ঠিত হননি।”

১৬ নম্বর অভিযোগে ব্রাহ্মণবড়িয়ার বিভিন্ন গ্রামে ১০৮ জন নিরস্ত্র মানুষকে হত্যার ঘটনায় কায়সারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগও প্রমাণিত হয়েছে। এ অভিযোগেও তাকে দেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ সাজা।

১, ৯, ১৩ ও ১৪ নম্বর অভিযোগে অপহরণ, আটকে রেখে নির্যাতন ও হত্যায় সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হওয়ায় কায়সারকে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। ২ নম্বর অভিযোগে তাকে ১০ বছর, ৭ নম্বর অভিযোগে ৭ বছর এবং ১১ নম্বর অভিযোগে ৫ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

তবে প্রসিকিউশন ৪ ও ১৫ নম্বর অভিযোগে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ করতে না পারায় কায়সারকে খালাস দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।

মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালিকে ‘দমনের অস্ত্র হিসাবে’ ধর্ষণের ব্যবহার এবং সেই পাশবিকতার শিকার নারীদের দুর্দশার কথা বার বার এসেছে এই রায়ে।

আড়াই লাখ বীরাঙ্গনা ও তাদের গর্ভে জন্ম নেওয়া যুদ্ধশিশুদের ‘জাতীয় বীর’ অভিহিত করে আদালত বলেছে, “যুদ্ধের সময় ধর্ষণের শিকার নারীরা অবশ্যই এ মাটির মহীয়সী মা ও বোন। তারা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তারা আমাদের গর্ব। নিজেদের সর্বোচ্চ সম্মান বিসর্জন দিয়ে সাহসের সঙ্গে তারাও আমাদের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছেন। জাতি তাদের এবং তাদের এ ত্যাগকে স্যালুট জানায়।”

বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুদের প্রাপ্য সম্মান দেখাতে তাদের দুর্দশা কমানোর জন্য সরকার দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে বলেও রায়ে আশা প্রকাশ করেছে ট্রাইব্যুনাল।

প্রসিকিউশন এ রায়কে উৎসর্গ করেছে বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধ শিশুদের প্রতি। আসামিপক্ষ আপিল করার কথা জানিয়েছে।

দীর্ঘ ৪৩ বছর পর সৈয়দ কায়সারের মৃত্যুদণ্ডের রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে দণ্ড দ্রুত কার্যকরের দাবি জানিয়েছেন এ মামলার সাক্ষী ও হবিগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ জেলা ইউনিট কমান্ডার মোহাম্মদ আলী পাঠান।

 

প্রতিক্রিয়া

রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত বলেন, “এই মামলায় ব্যতিক্রমী অনেকগুলো বিষয় আছে। এই প্রথম কোনো যুদ্ধাপরাধ মামলায় আসামির যোগসাজশে ধর্ষণের শিকার কোনো নারী এসে আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। একজন যুদ্ধশিশু আদালতে দাঁড়িয়ে আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন।

“এছাড়া একাত্তরে কায়সার বাহিনীর অন্যতম একজন সদস্য (তাজুল ইসলাম) তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছে। ওই সাক্ষী বলেছেন, কায়সারের সঙ্গে যুক্ত থেকে একাত্তরের কর্মকাণ্ডের জন্য তিনি অনুতপ্ত। সেই অনুতাপ থেকেই সে সাক্ষ্য দিতে এসেছে।”

অন্যদিকে কায়সারের আইনজীবী এসএম শাহজাহান বলেন, “যেহেতু রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ রয়েছে, আমরা আপিল করব। আশা করি মহামান্য সুপ্রিম কোর্টে ন্যায় বিচার পাব।”

রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও। তিনি বলেছেন যুদ্ধাপরাধের বিচার সঠিকভাবেই চলছে।

সেক্টরস কমান্ডারস ফোরামের সভাপতি কে এম সফিউল্লাহ বলেন, “আমার সেক্টরে কায়সারের নেতৃত্বে নারকীয় হত্যাকাণ্ড আমি দেখেছি। তার ফাঁসির আদেশে আমরা সন্তুষ্ট। এখন দ্রুত রায় কার্যকরের প্রত্যাশায় আছি।”

ফাঁসির রায় পেয়ে শাহবাগে আনন্দ মিছিল করেছে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে আন্দোলনে থাকা গণজাগরণ মঞ্চ। তবে আগের রায়গুলো এখনো কার্যকর না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার।

আনন্দ মিছিল হয়েছে কায়সারের নিজের এলাকা হবিগঞ্জেও, যেখানে তিনি তিন বার সাংসদ ছিলেন। 

মুক্তিযোদ্ধা সংসদ মাধবপুর উপজেলা ইউনিটের ডেপুটি কমান্ডার আব্দুল মালেক মধু বলেন, “মাধবপুরবাসী এই রায় শুনে আনন্দিত। কায়সারের নেতৃত্বে কায়সার বাহিনীর হত্যা, লুটতরাজ ও ধর্ষণের প্রকৃত বিচার তারা পেয়েছেন।”

কম্পমান কায়সার

গতবছর গ্রেপ্তারের পর কায়সারকে যখন ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়, সেদিন পুলিশের কাঁধে ভর দিয়ে হাঁটছিলেন তিনি।

তবে মঙ্গলবার সকালে রায়ের জন্য ট্রাইব্যুনালে নিয়ে আসার পর লাঠিতে ভর করে নিজেই কাঠগড়ায় রাখা চেয়ারে গিয়ে বসেন সাবেক এই প্রতিমন্ত্রী। সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবির উপরে স্যুয়েটার, তার উপর ধূসর রঙের ব্লেজার পরা সত্তরোর্ধ্ব কায়সারের হাত এ সময় কাঁপতে দেখা যায়।

রায় ঘোষণার আগে ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান যখন যুদ্ধাপরাধের বিচার ও আলোচ্য মামলার প্রেক্ষাপট নিয়ে কথা বলছিলেন, কায়সার তখন বিহ্বল মুখে বড় বড় চোখে তাকিয়ে ছিলেন।

তবে সময় গড়াতেই তার চেহারায় দেখা দিতে থাকে আতঙ্কের ছাপ। তার করা অপরাধের বর্ণনা দিয়ে বিচারক যখন তাকে একের পর এক অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করছিলেন, ধীরে ধীরে বিচারকদের মঞ্চ থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে বাঁ দিকে মুখ করে থাকেন কায়সার।

রায় ঘোষণা শেষে বিচারকরা চলে যাওয়ার পর নিজের পায়ে একাই দাঁড়িয়ে যান সৈয়দ মো. কায়সার। এ সময় দুই ভাই এসএবিএম হুমায়ুন ও এসএকেএম সেলিম এবং ছেলে সৈয়দ গালিব আহমেদের সঙ্গে তাকে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখা যায়।

পরে দুইজন পুলিশ দুই পাশ থেকে ধরে তাকে সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে নিয়ে যায়। একটি মাইক্রোবাসে করে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে।

বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশু

একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের হাতে নির্যাতিত আড়াই লাখ বীরাঙ্গনা ও তাদের গর্ভে জন্ম নেওয়া যুদ্ধশিশুদের ‘জাতীয় বীর’ অভিহিত করে রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেছে, “মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন- তারা আমাদেরই মা, আমাদেরই বোন। আমরা আর চোখ বন্ধ করে রাখতে পারি না।”

বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুদের প্রাপ্য সম্মান দেখাতে তাদের দুর্দশা কমানোর জন্য সরকার দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে বলেও রায়ে আশা প্রকাশ করা হয়েছে।

ক্ষতিপূরণ স্কিম চালুর পাশাপাশি বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুদের তালিকা করে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে তাদের পুর্নবাসনের ব্যবস্থা করা এবং যারা ইতোমধ্যে মারা গেছেন, তাদের মরণোত্তর সম্মান জানিয়ে স্বজনদের শোক ও দুর্দশা লাঘবের ব্যবস্থা নিতে রাষ্ট্রকে উদ্যোগী হতে বলেছে আদালত।

রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, “সমাজ ও জাতিকে আরো মনে রাখতে হবে যে, বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুরা যুদ্ধে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত, মুক্তিযোদ্ধারা পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। সমাজ ও জাতির কোনো স্বীকৃতি ছাড়াই এখনো সেই আত্মত্যাগের জন্য মানসিক ক্ষত বয়ে চলেছেন বেঁচে থাকা বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুরা। ধর্ষণের শিকার এসব নারীদেরও মুক্তিযোদ্ধার সম্মান দেওয়া উচিৎ, তাদের অব্যক্ত বেদনাকে আর অবহেলা করা যায় না।”

রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেছে, সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন বেসরকারি ও সামাজিক সংগঠন বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুদের সম্মান দেখাতে তাদের দুর্দশা কমানোর জন্য দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে বলে আদালত আশা করে।

 “শুধু ধর্ষণের শিকার নারীদের ক্ষত দূর করার জন্য নয়, বরং আমাদের সমাজ ও জাতির ক্ষত সারিয়ে তোলার জন্যও এটি করা প্রয়োজন। তাই, তাদের মানসিক-সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের জন্য বিস্তৃত ও সুশৃঙ্খল মনোযোগ ও ব্যবস্থার ওপর জোর দিচ্ছি আমরা।”

ফাইল ছবি

ডিগবাজ যুদ্ধাপরাধী

হবিগঞ্জের মাধবপুরের ইটাখোলা গ্রামের সৈয়দ সঈদউদ্দিন ও বেগম হামিদা বানুর ছেলে সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সার ওরফে মো. কায়সার ওরফে সৈয়দ কায়সার ওরফে এসএম কায়সারের জন্ম ১৯৪০ সালের ১৯ জুন।

নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সময় তিনি যে তথ্য নির্বাচন কমিশনকে দিয়েছেন, তাতে ঢাকার আরমানিটোলা নিউ গভার্নমেন্ট হাই স্কুল থেকে তার মেট্রিক ও জগন্নাথ কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করার কথা বলা হয়েছে। তবে ওই স্কুলে তার পড়ার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে ট্রাইব্যুনালকে জানানো হয়।

নির্বাচন কমিশনের নথিতে তার শিক্ষাগত যোগ্যতা বলা হয়েছে, তিনি বিএ পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। কয়েকটি শিল্প কারখানাতেও তার মালিকানা রয়েছে।

সৈয়দ কায়সারের বাবা সৈয়দ সঈদউদ্দিন ১৯৬২ সালে সিলেট-৭ আসন থেকে কনভেনশন মুসলিম লীগের এমএলএ নির্বাচিত হন। ওই বছরই মুসলিম লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন তার ছেলে কায়সার।

১৯৬৬ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত কায়সার মুসলিম লীগ সিলেট জেলা কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৭০ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনি পরাজিত হন।

১৯৭১ সালে দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় ৫০০ থেকে ৭০০ ‘স্বাধীনতাবিরোধীকে’ নিয়ে ‘কায়সার বাহিনী’ গঠন করেন এই মুসলিম লীগ নেতা। তিনি নিজে ছিলেন ওই বাহিনীর প্রধান।

তিনি যে সে সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পথ দেখিয়ে বিভিন্ন গ্রামে নিয়ে স্বাধীনতার পক্ষের লোক এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর দমন অভিযান চালিয়েছিলেন- সে বিষয়টি মামলার রায়েও উঠে এসেছে।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করার ঠিক আগে কায়সার পালিয়ে লন্ডনে চলে যান। দেশে ফেরেন ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর।

জিয়াউর রহমানের সময় ১৯৭৮ সালে আবারো রাজনীতিতে সক্রিয় হন কায়সার। ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-১৭ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটে দাঁড়িয়ে সাংসদ নির্বাচিত হন।

পরে তিনি বিএনপিতে যোগ দেন এবং হবিগঞ্জ বিএনপির সভাপতি হন। ১৯৮২ সালে তিনি বিএনপির শাহ আজিজুর রহমান অংশের যুগ্ম মহাসচিবও হন।

সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সময়ে কায়সার জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন এবং হবিগঞ্জ শাখার সভাপতির দায়িত্ব পান। ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে হবিগঞ্জ-৪ আসন থেকে লাঙ্গল প্রতীকে নির্বাচন করে আবারও দুই দফা তিনি সংসদ সদস্য হন। ওই সময় তাকে কৃষি প্রতিমন্ত্রীরও দায়িত্ব দেন এরশাদ।

এরপর ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচন করে পরাজিত হন কায়সার। এক পর্যায়ে এরশাদের দল ছেড়ে তিনি যোগ দেন পিডিপিতে।

কায়সার বর্তমান সরকারের একজন ঘনিষ্ট মন্ত্রীর বেয়াই, যিনি নিজেও এক সময় জাতীয় পার্টির মন্ত্রী ছিলেন।

এই যুদ্ধাপরাধীর ছেলে সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। তানভীর ও তার ভাই সৈয়দ মোহাম্মদ গালিব দুজনেই বিতর্কিত গ্লোবাল অ্যাগ্রো ট্রেড কোম্পানির (গ্যাটকো) পরিচালক।

দুর্নীতির মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরের কন্টেইনার ডিপো পরিচালনার দায়িত্ব ওই কোম্পানিকে দেওয়ার এক মামলায় তাদের দুজনকেই বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় কারাগারে যেতে হয়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও ওই মামলার আসামি।

 

মামলার পূর্বাপর

গতবছর ১৫ মে কায়সারের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে ট্রাইব্যুনাল। ওই রাতেই গ্রেপ্তার করা হয় মুসলিম লীগের এই সাবেক নেতাকে। এরপর তাকে রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

২১ মে পুলিশ কায়সারকে হাসপাতাল থেকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করলে বিচারক তাকে কারাগারে পাঠান। আসামিপক্ষের আবেদনে গতবছর ৪ অগাস্ট সৈয়দ কায়সারকে শর্তসাপেক্ষে জামিন দেয় ট্রাইব্যুনাল।

প্রসিকিউশনের তদন্ত কর্মকর্তা মনোয়ারা বেগম ২০১২ সালের ২৮ মার্চ থেকে গত বছর ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কায়সারের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত করেন।

 

এরপর ১০ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালে কায়সারের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন, যাতে যুদ্ধাপরাধের ১৮টি অভিযোগ আনা হয়।

এর মধ্যে ১৬টি ঘটনায় অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে চলতি বছর ২ ফেব্রুয়ারি সৈয়দ কায়সারের বিচার শুরু করে ট্রাইব্যুনাল, যার মধ্যে গণহত্যার একটি; হত্যা, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ১৩টি এবং ধর্ষণের দুটি অভিযোগ রয়েছে।

গত ৪ মার্চ প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্তর সূচনা বক্তব্যের মধ্য দিয়ে এ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। কায়সারের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ প্রসিকিউশনের মোট ৩২ জন সাক্ষী।

আসামিপক্ষের আইনজীবী তাদের সবাইকে জেরাও সম্পন্ন করেন।  তবে কায়সারের পক্ষে কোনো সাক্ষী হাজির করতে পারেনি আসামিপক্ষ।

এরপর ২৩ জুলাই থেকে প্রসিকিউশনের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর তুরীন আফরোজ, রানা দাশগুপ্ত ও তাপস কান্তি বল। কায়সারের পক্ষে ৭ আগস্ট থেকে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন এস এম শাহজাহান ও আব্দুস সোবহান তরফদার।

দুই পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে গত ২০ অগাস্ট মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখে ট্রাইব্যুনাল

চতুর্দশ রায়

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বহু প্রতীক্ষিত বিচার শুরু হয়। ২০১৩ সালের ২১ জানুয়ারি প্রথম রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক রুকন আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির আদেশ আসে। পলাতক থাকায় তিনি আপিলের সুযোগ পাননি।

৫ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়, যা প্রত্যাখ্যান করে রাজধানীর শাহবাগে অবস্থান নেয় হাজার হাজার মানুষ।

যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে সেই আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে জনতার দাবির মুখে সরকার ট্রাইব্যুনাল আইনে সংশোধন আনে। এর মধ্যে দিয়ে রায়ের বিরুদ্ধে দুই পক্ষেরই আপিলের সমান সুযোগ তৈরি হয়। গত ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ এ মামলার চূড়ান্ত রায়ে কাদের মোল্লাকে প্রাণদণ্ড দেয়, যা কার্যকর করা হয় ১২ ডিসেম্বর।

ট্রাইব্যুনালের তৃতীয় রায়ে গতবছর ২৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির আদেশ হলে দলটির ঘাঁটি বলে পরিচিত এলাকাগুলোতে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। সরকারি হিসেবেই পুলিশসহ নিহত হয় ৭০ জনেরও বেশি মানুষ।

ওই রায়ের বিরুদ্ধে সাঈদী আপিল করলে চলতি বছর ১৭ সেপ্টেম্বর ‘দেইল্যা রাজাকার’ নামে খ্যাত এই জামায়াত নেতার সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডের আদেশ দেয় সর্বোচ্চ আদালত।

গতবছর ৯ মে ট্রাইব্যুনালের চতুর্থ রায়ে জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকেও মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। আপিলের রায়েও গত ৩ নভেম্বর তার সর্বোচ্চ সাজা বহাল থাকে।

মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা ও উসকানির দায়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন জামায়াত আমীর গোলাম আযমকে গতবছর ১৫ জুন ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। এটি ছিল ট্রাইব্যুনালের পঞ্চম রায়।

রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের শুনানি চলার মধ্যেই গত ২৩ অক্টোবর রাতে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ৯২ বছর বয়সী জামায়াতগুরু।

গতবছর ১৭ জুলাই ষষ্ঠ রায়ে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

এরপর ১ অক্টোবর  সপ্তম রায়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও চট্টগ্রামের সাংসদ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির রায় আসে। তারা দুজনই রায়ের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করেছেন।

গতবছর ৯ অক্টোবর বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয় আদালত। যুদ্ধাপরাধের দণ্ড ভোগের মধ্যে ৮৩ বছর বয়সে গত ৩০ অগাস্ট মারা যান আলীম। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর ১১ মাস কারাবন্দি অবস্থায় হাসপাতালের প্রিজন সেলে ছিলেন তিনি।

বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে একাত্তরের দুই বদর নেতা আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীনকে গতবছর ৩ নভেম্বর মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। তারা দুজনেই পলাতক।

দশম রায়ে গত ২৯ অক্টোবর জামায়াত আমির একাত্তরের বদর প্রধান মতিউর রহমান নিজামীকেও দেওয়া হয় সর্বোচ্চ সাজা, যিনি বাঙালি জাতিকে সমূলে ধ্বংস করতে ‘স্বেচ্ছায় ও সচেতনভাবে’ ইসলামের অপব্যবহার করেন বলে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়।  তিনিও এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন।

একাদশ রায়ে গত ২ নভেম্বর চট্টগ্রামের আলবদর কমান্ডার মীর কাসেম আলীকে আদালত মৃত্যুদণ্ড দেয়। জামায়াতে ইসলামীর এই শুরা সদস্যকে দলটির প্রধান অর্থ যোগানদাতা বলা হয়ে থাকে।

গত ১৩ নভেম্বর ফরিদপুরের রাজাকার কমান্ডার জাহিদ হোসেন খোকন ওরফে খোকন রাজাকারের ফাঁসির আদেশ আসে।

আর সর্বশেষ ২৪ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রাজাকার কমান্ডার ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেতা মোবারক হোসেনকেও আদালত মৃত্যুদণ্ড দেয়।

[এই প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন কামাল তালুকদার, গোলাম মুজতবা ধ্রুব, মইনুল হক চৌধুরী ও আবদুল হালিম সুমন]