যুদ্ধাপরাধের যত রায়

প্রায় পৌনে দুই বছর আগে আবুল কালাম আযাদকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল একাত্তরের যুদ্ধপরাধের রায় দেওয়া,  তারপর এই পর্যন্ত ১৩টি মামলার রায় হয়েছে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Dec 2014, 07:12 PM
Updated : 22 Dec 2014, 07:18 PM

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেওয়া এসব রায়ের পর এখন পর্যন্ত আপিলের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি শেষে একমাত্র আবদুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে এবং তা হয়েছে এক বছর আগে।

মঙ্গলবার সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের দণ্ডাদেশ ঘোষণার মধ্য দিয়ে চতুর্দশ মামলার রায় দিতে যাচ্ছে ট্রাইব্যুনাল। আগের ১৩টির মধ্যে প্রথম ট্রাইব্যুনাল থেকে রায় এসেছে ছয়টির, দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল থেকে সাতটির।

২০১৩ সালের জানুয়ারিতে শুরু হওয়ার পর ওই বছর রায় হয় নয়টির, ২০১৪ সালে এখন পর্যন্ত হয়েছে চারটির রায়। এর মধ্যে দণ্ডিতদের আপিলের শুনানি চলছে।

এই ১৩টি মামলার একটি দুজন আসামি থাকায় মোট দণ্ডিত ১৪ জন। এর মধ্যে পলাতক অবস্থায়ই বিচার হয় চারজনের। দণ্ড ভোগের মধ্যে মারা যান দুজন।

ট্রাইব্যুনালের এই রায়ের পর তা আপিল বিভাগে যায়, চূড়ান্ত রায়ের পর তা পুনর্বিবেচনার সুযোগ থাকে। এরপরই হয় দণ্ড কার্যকর।

প্রথম রায়ে আযাদের ফাঁসি

প্রথম রায়টি আসে ২০১৩ সালের ২১ জানুয়ারি বিচারপতি ওবায়দুল হাসান নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ থেকে। রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক রুকন আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির আদেশ হয়। পলাতক থাকায় তার রায় এখনও কার্যকর করা যায়নি।

দ্বিতীয় রায় বহুল আলোচিত

২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় রায়টিও দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হলে শাহবাগ আন্দোলনের সৃষ্টি হয়। আর তারই পরিপ্রেক্ষিতে আইন সংশোধন করে আপিলের ক্ষেত্রে আসামি ও প্রসিকিউশনের সমান সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। 

স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতে ২৬ মার্চ মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনে হযরত আলী লস্করের স্ত্রী, দুই মেয়ে এবং দুই বছরের এক ছেলেকে হত্যা এবং এক মেয়েকে ধর্ষণের দায়ে কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিল ট্রাইব্যুনাল। পরে ২০১৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের রায়ে বিচারিক আদালতের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশের সাজা বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় কাদের মোল্লাকে। ওই বছরের ১৩ ডিসেম্বর এ রায় কার্যকর করা হয়।

তৃতীয় রায়: সহিংসতা

২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সাবেক চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর প্রথম রায়টি আসে। হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, নির্যাতন ও ধর্মান্তরে বাধ্য করার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নির্দেশ দেওয়া হয় এ রায়ে।

এই রায়ের প্রতিক্রিয়ায় দেশজুড়ে তাণ্ডব শুরু করে জামায়াতে ইসলামীর কর্মীরা। তাতে প্রায় একশ’ মানুষের মৃত্যুর পাশাপাশি অসংখ্য গাড়ি ভাংচুর ও আগুন দেওয়া হয়, পুড়িয়ে দেওয়া হয় বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রও।

তবে আপিলের রায়ে মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই পান জামায়াতের এই নেতা। ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে আপিল বিভাগের দেওয়া রায়ে তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

চতুর্থ রায়ে মৃত্যুদণ্ড

চতুর্থ রায়টি আসে আবার দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল থেকে। ২০১৩ সালের ৫ মে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল।

এ রায়ের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষের আপিলে ২০১৪ সালের ৩ নভেম্বর মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে আপিল বিভাগ। এখন পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ পেলে কামারুজ্জামান রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করতে পারবেন।   

পঞ্চম রায় গোলাম আযমের

২০১৩ সালের ১৫ জুলাই মুক্তিযুদ্ধকালীন জামায়াতের আমির গোলাম আযমের মামলার রায়ে ৯১ বছর বয়সী এ আসামিকে মোট ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল-১।

৫ অগাস্ট বেকসুর খালাস চেয়ে ট্রাইব্যুনালের দেয়া ৯০ বছর দণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল করেন গোলাম আযম। এ আপিলের নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই কারাদণ্ড ভোগ করার মধ্যেই গত ২৩ অক্টোবর মারা যান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে সংঘটিত সব যুদ্ধাপরাধের মূল হোতা গোলাম আযম।

ষষ্ঠ রায়ে মুজাহিদের ফাঁসি

ট্রাইব্যুনাল-১ গোলাম আযমের রায় ঘোষণার দুই দিনের মাথায় যুদ্ধাপরাধের মামলায় ষষ্ঠ এবং নিজেদের চতুর্থ রায়টি ঘোষণা দেয় ট্রাইব্যুনাল-২। ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল এবং একাত্তরের কুখ্যাত আলবদর বাহিনী প্রধান আলীআহসান মুহাম্মদ মুজাহিদকে ফাঁসিতে ঝোলানোর আদেশ দেওয়া হয়।

পরে ১১ অগাস্ট এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন  মুজাহিদ। বর্তমানে আপিল বিভাগে এর শুনানি চলছে।

সপ্তম রায়ে সাকার ফাঁসি

ট্রাইব্যুনালের সপ্তম রায়টি আসে বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে।

মুক্তিযুদ্ধের সময়ে চট্টগ্রামে হিন্দু ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী-সমর্থক নিধন এবং নির্যাতন কেন্দ্র চালানোর দায়ে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল-১।

২০১৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি তার আপিলের সার সংক্ষেপ জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয় আপিল বিভাগ।

অষ্টম রায়ে আলিমের মৃত্যুদণ্ড

অষ্টম রায়টি দেওয়া হয় সাবেক মুসলিম লীগ নেতা এবং জিয়াউর রহমানের আমলে মন্ত্রিত্ব পাওয়া বিএনপি নেতা আব্দুল আলীমের বিরুদ্ধে। ২০১৩ সালের ৯ অক্টোবর স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগের নেতা হিসাবে একাত্তরে জয়পুরহাটে রাজাকার বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে ব্যাপক নিধনযজ্ঞ চালানোর দায়ে আবদুল আলীমকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল-২। এ সাজা ভোগের মধ্যেই ২০১৪ সালের ৩০ অগাস্ট মারা যান আলীম।

নবমে এক রায়ে দুজনের ফাঁসি

নবম রায়টি দেওয়া হয় বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের ঘটনার দুই মূল হোতা চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে। পলাতক এই দুই আসামিকে ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর ফাঁসির আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল-২। পলাতক থাকায় তাদের সাজা কার্যকর হয়নি। এদের মধ্যে মুঈনুদ্দীন রয়েছেন যুক্তরাজ্যে, আশরাফ যুক্তরাষ্ট্রে।

এক বছর পর দশম রায়

দীর্ঘ বিরতির পর ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর ঘোষণা করা হয় যুদ্ধাপরাধের মামলার দশম রায়। 

ট্রাইব্যুনাল-১ এর সাবেক চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর অবসরে যাওয়ায় দীর্ঘদিনের জটে পড়ে থাকার পর জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় ঘোষণা করে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।

এটি আপিলের অপেক্ষায় রয়েছে।

৩ দিন পরই একাদশ রায়

একাদশতম রায়টি আসে ২ নভেম্বর, তার তিন দিন আগেই দশম রায়টি হয়েছিল। জামায়াতে ইসলামীর অর্থ যোগানদাতা হিসেবে পরিচিত নেতা মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় দেয় ট্রাইব্যুনাল-২।

দ্বাদশ রায়ে ফাঁসি

দ্বাদশতম রায়টি ঘোষণা করা হয় গত ১৩ নভেম্বর। ফরিদপুরের নগরকান্দা পৌরসভার নির্বাচিত মেয়র ও বিএনপি নেতা পলাতক জাহিদ হোসেন খোকন ওরফে খোকন রাজাকারের বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় ঘোষণা করে ট্রাইব্যুনাল-১।

ত্রয়োদশ রায়েও ফাঁসি

যুদ্ধাপরাধের চতুর্দশ রায়টি আসে গত ২৪ নভেম্বর ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রাজাকার কমান্ডার ও আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেতা মোবারক হোসেনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় রায়ে। রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের আবেদন জানিয়েছেন তিনি।