ভাড়াটে খুনিরা তৎপর: পুলিশ

সাম্প্রতিক কয়েকটি হত্যাকাণ্ডে ভাড়াটে খুনিদের ব্যবহার করা হয়েছে-এমন তথ্য জানিয়ে রাজধানীতে এই ধরনের অপরাধীদের তৎপর হয়ে ওঠার খবর দিয়েছে পুলিশ।

গোলাম মুজতবা ধ্রুববিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Dec 2014, 03:59 PM
Updated : 20 Dec 2014, 04:29 PM

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, ব্যবসায়িক বিরোধ, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, জমি সংক্রান্ত বিরোধ ও পূর্ব শত্রুতার জেরসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভাড়াটে খুনিদের ব্যবহার করা হচ্ছে।

প্রধানত ব্যক্তিগত বিরোধ নিষ্পত্তিতে প্রভাবশালীরাই ভাড়াটে খুনিদের ব্যবহার করছেন। আর পলাতক ও কারাগারে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ‘ঘনিষ্ঠজন’ হিসেবে পরিচিতরাই ভাড়াটে হিসেবে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন তারা।

পলাতক ও কারাবন্দী শীর্ষ সন্ত্রাসীরা অনেক ক্ষেত্রে এসব হত্যাকাণ্ডের নকশা সাজিয়ে সে অনুযায়ী নির্দেশনা দিচ্ছেন বলেও জানিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা।

রাজধানীতে ভাড়াটে হিসেবে হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের সংখ্যা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য না থাকলেও তাদের সংখ্যা ১৫ থেকে ১৬ জন হতে পারে বলে ধারণা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেনের।

তিনি বলেন, “এইসব খুনিরা অনেকটাই লোকচক্ষুর আড়ালে থাকেন। ‘একটু ভিন্ন ধরনের’ কাজ করতে পারায় নিজেদের গ্রুপে তাদের বাড়তি কদর রয়েছে।

“সাধারণ মানুষ চাইলেও তাদের কাছে পৌঁছাতে পারবে না। তাদের কাছে পৌঁছাতে হলে অপরাধীদের সংস্পর্শে আসা লাগে। খুনির সঙ্গে পরিচয়ের পর চেনা-জানা ভাল হলে খুনের চুক্তি হয়ে থাকে। এরা অপরিচিতদের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনায় যায় না।”

গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার জাহাঙ্গীর হোসেন মাতুব্বর বলেন, বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে ভাড়াটে খুনিদের ব্যবহার সম্পর্কে জানতে পেরেছেন গোয়েন্দারা।

“পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসীরা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের নির্দেশনা দিয়ে থাকে।”

পুলিশ কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর বলেন, “ভাড়ায় খুনের চুক্তির নির্দিষ্ট কোনো টাকার অঙ্ক নেই। একেক সময় একেক ধরনের চুক্তিতে তারা কাজ করে।

“কখনো ২০ হাজার, কখনো দুই লাখ, আবার কখনো দুই কোটি টাকায়ও চুক্তি হয়ে থাকে। কাকে কতো সময়ের মধ্যে খুন করা হবে তার ওপর নির্ভর করে টাকার পরিমাণ।”

গোয়েন্দা কর্মকর্তা ছানোয়ার হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অনেকে কারাগারে থাকায় এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারিতে এসব খুনিরা প্রকাশ্যে আসতে পারছেন না। তাই তারা শীর্ষ নেতার নাম ব্যবহার করেই খুনের চুক্তি করে থাকেন।”

নজরদারি বাড়িয়ে তাদের গ্রেপ্তারে পুলিশ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানান তিনি।

গোয়েন্দা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা শহরকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে কাজ করছেন সন্ত্রাসীরা।

শীর্ষ সন্ত্রাসীদের যার যে এলাকায় আধিপত্য বা ‘নাম’ আছে সেই এলাকায় হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ওই সব সন্ত্রাসীদের সম্পৃক্ততার তথ্য-প্রমাণ গোয়েন্দাদের হাতে এসেছে বলে পুলিশ কর্মকর্তা ছানোয়ার জানিয়েছেন।

গোয়েন্দারা জানান, পুরান ঢাকায় ডাকাত শহীদের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত কাউসার ও বাবু, মগবাজারে সুব্রত বাইনের ঘনিষ্ঠজন সিদ্ধেশ্বরীর শাকিল এসব চুক্তি করেন।

পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদৎ হোসেন মিরপুর এলাকায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করছেন।

কাশিমপুর কারাগারে বসে ধানমন্ডি এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেন সন্ত্রাসী ইমন, রামপুরা-খিলগাঁও ও বনশ্রী এলাকায় অপরাধের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের হাতে, আর মোহাম্মদপুর-আদাবর এলাকার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী নবী।

গত ১৯ জুন ‘ব্যবসায়িক বিরোধ’ থেকে আওয়ামী লীগ নেতা এ কে এম এনামুল হক শামীম ধানমন্ডিতে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন। মোটরসাইকেল আরোহীর ছোড়া গুলি গাড়িতে থাকা শামীমের বাঁ হাতে লাগে।

প্রায় এক মাস পর চারজনকে গ্রেপ্তার করে তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে  র‌্যাব জানায়, শামীমের ওপর হামলার পরিকল্পনায় আওয়ামী লীগেরই বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের নেতারা জড়িত ছিলেন।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য শামীম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির অন্যতম পরিচালক। এছাড়া বিভিন্ন ব্যবসা রয়েছে তার। 

র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান, শামীমকে গুলির ঘটনায় প্রথমে রাজবাড়ীর পাংশা থেকে মো. মনির হোসেন নামে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী মুন্সীগঞ্জ থেকে মো. হারুন, রাজধানীর তেজতুরী বাজার বস্তি থেকে মো. মেহেদী হাসান ও নজরুল ইসলাম জুয়েল নামে তিনজনকে ধরা হয়।

এদের মধ্যে মনির ও জুয়েল ওই হামলার পরিকল্পনা করেন এবং টাকার বিনিময়ে হারুন ও মেহেদী ধানমণ্ডিতে শামীমকে গুলিবর্ষণে জড়িত ছিলেন বলে র‌্যাব কর্মকর্তারা দাবি করেন।

মনির কারওয়ান বাজারের চিহ্নিত সন্ত্রাসী আশিকের সহযোগী। ফারুক নামে একজনকে হত্যা মামলার অন্যতম আসামি তিনি। আর মেহেদী ২০০৬ সালে তেজকুনিপাড়ার রফিক হত্যা মামলার অন্যতম আসামি।

এ ঘটনা নিয়ে র‌্যাবের এক ব্রিফিংয়ে শামীমকে হত্যাচেষ্টায় তার ব্যবসায়িক অংশীদার ‘জসিমের’ নাম বলা হয়।

সে সময় র‌্যাবের এক কর্মকর্তা বলেন, “শামীমকে হত্যার জন্য এক লাখ টাকা খরচ করার পরিকল্পনা করেন জসিম। খুনের পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে দায়িত্ব দেওয়া হয় মনিরকে। মনির ভাড়াটে অপরাধী ঠিক করা, কারা-কীভাবে-কোথায় শামীমকে গুলি করবে, তা ঠিক করার দায়িত্ব দেন জুয়েলকে।

“শামীমকে গুলি করতে তেজগাঁওয়ের অস্ত্র ব্যবসায়ী সাঈদের কাছ থেকে মোটরসাইকেল ও দুটি পিস্তল ভাড়া করা হয়। খুনের জন্য ঠিক করা হয় পেশাদার ‘কিলার’ হারুন ও মেহেদীকে।” 

জুয়েল ছাত্রলীগ এবং সাঈদ স্বেচ্ছাসেবক লীগের সঙ্গে জড়িত বলেও র‌্যাব কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন।

গত ১২ ডিসেম্বর রাজধানীর পূর্ব শেওড়াপাড়া থেকে মিরপুর-কাফরুল এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী মো. বিল্লাল ওরফে শুটার বিল্লালকে (৩৫) তিন সহযোগীসহ গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সে সময় তাদের কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল ও ১২ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়।

বিল্লালের বিরুদ্ধে মিরপুর, কাফরুল, পল্লবী ও শেরেবাংলা নগর থানায় খুন, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগে ১৮টি মামলা রয়েছে বলে কাফরুল থানার ওসি আবদুল কাইয়ুম জানিয়েছেন।

“বিল্লাল ভাড়াটে খুনি হিসেবে কাজ করত। তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছিল পুলিশ,” বলেন তিনি।

গত ১৪ ডিসেম্বর দুপুরে ঝিগাতলার তিন মাজার মসজিদ এলাকায় আফজাল হোসেন সাত্তার ওরফে গাল কাটা সাত্তার নামের এক চামড়া ব্যবসায়ীকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়।

এ ঘটনায় ছয় জনকে আসামি করে হাজারীবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করে নিহতের পরিবার।

হত্যাকাণ্ডে জড়িত অভিযোগে গত ১৮ ডিসেম্বর শেওড়াপাড়া থেকে মো. মাসুদ হাসান (৩৩) নামে একজনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।

জিজ্ঞাসাবাদে মাসুদের তার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে র‌্যাব ২ এর অধিনায়ক এস এম মাসুদ রানা বলেন, “চামড়া ব্যবসায়ী সাত্তারের তিন ভাই ১৯৯৬ সালে মাসুদের আপন বড় ভাইকে নবাবগঞ্জ সেকশন ঢালে কুপিয়ে হত্যা করেছিল।  

“ভাই হত্যার প্রতিশোধ নিতেই সাত্তারকে হত্যা করতে ধানমন্ডির সন্ত্রাসী ইমনের সহায়তা নিয়েছিল মাসুদ।”

ধানমন্ডি এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন কাশিমপুর কারাগারে বসেই মোবাইলে সাত্তারকে হত্যার পরিকল্পনার পাশাপাশি নির্দেশনাও দিয়েছিলেন বলে জানান তিনি।

র‌্যাব কর্মকর্তা মাসুদ বলেন, “সাত্তারের ওপর হামলার চার মাস আগে থেকেই ইমনের শিষ্য বুলু, লিংকন তার ওপর নজরদারি রাখতে শুরু করে। তারা আগে কয়েকবার সাত্তারকে গুলি করার পরিকল্পনা করে ব্যর্থ হয়।”

ইমনের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত গনির নিজের তিনটি অবৈধ অস্ত্র দিয়ে সাত্তারের ওপর হামলা হয় বলে জানান তিনি।

র‌্যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বলেন, “র‌্যাব খুনের ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে দেখেছে, আধিপত্য বিস্তার, মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, ব্যবসায়িক বিরোধ বা মতাদর্শিক ভিন্নতার কারণে অধিকাংশ খুনের ঘটনা ঘটছে।”

উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, “কয়েক মাস আগে মগবাজারের ট্রিপল মার্ডার হয়েছিল রেলের জমি নিয়ে বিরোধের জেরে। নরসিংদীর মেয়র লোকমান হোসেনকে রাজনৈতিক বিরোধের জেরে হত্যা করা হয়েছিল। আবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে হত্যার নেপথ্যেও ঘটনা রয়েছে।”

এসব ঘটনায় সন্ত্রাসী হিসেবে এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের পাশাপাশি টাকার লেনদেন হয়েছিল বলে জানান তিনি।