একাত্তরে পাক সেনাদের ‘ঘনিষ্ঠ’ ছিলেন মুসা

বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের অভিযোগের মুখে থাকা মুসা বিন শমসেরের সঙ্গে একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর ঘনিষ্ঠতার কথা জানিয়েছেন ফরিদপুরের মুক্তিযোদ্ধারা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Dec 2014, 05:57 PM
Updated : 16 August 2015, 06:49 PM

জাঁকজমকপূর্ণ চালচলনের জন্য বিদেশি সংবাদ মাধ্যমে ‘বাংলাদেশের প্রিন্স’ হিসেবে পরিচিত মুসার একাত্তরের ভূমিকার কথা বিভিন্ন বই ও বাংলাদেশের গণমাধ্যমেও এসেছে।

এই বিষয়ে মুসার সঙ্গে কথা বলা না গেলেও তার ছেলে ববি হাজ্জাজ সব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, ‘মানি’ লোকের মান হরণের জন্য এই ‘অপপ্রচার’।   

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদের বিশেষ উপদেষ্টা ববির বোনকে বিয়ে করেছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিমের ছেলে।

অর্থাৎ মুসা বিন শমসের ক্ষমতাসীন দলের নেতা শেখ সেলিমের বেয়াই, যার সম্পদ অনুসন্ধানে বৃহস্পতিবার তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুর্নীতি দমন কমিশন।

দেহরক্ষীদের বড় বহর নিয়ে দুদকে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের পর বের হয়ে মুসা সাংবাদিকদের বলেন, তার আয়ই এসেছে বিদেশ থেকে। পাচারের প্রশ্নই ওঠে না। 

দেহরক্ষী পরিবেষ্টিত হয়ে দুদক থেকে বেরিয়ে আসছেন মুসা বিন শমসের

মুসা বিন শমসের নামে এখন পরিচিত হলেও তার নাম এ ডি এম (আবু দাউদ মোহাম্মদ) মুসা। গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার কাজিকান্দা গ্রামে।

মুসার বাবা শমসের মোল্লা পাকিস্তান আমলে চাকরি করতেন পাট বিভাগের মাঠকর্মী হিসেবে পিএলএ পদে। ফরিদপুর শহরের গোয়ালচামটের ট্রাকস্ট্যান্ড সংলগ্ন এলাকায় বাড়ি করেন তার বাবা। সেখানেই বেড়ে ওঠেন মুসা।

মুসা পড়াশোনা করেছেন ফরিদপুর ঈশান স্কুলে। ১৯৬৮ সালে ওই স্কুল থেকে দ্বিতীয় বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হন সরকারি রাজেন্দ্র কলেজে। তবে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা তার দেওয়া হয়নি বলে স্থানীয়রা জানায়।

জিয়াউর রহমানের আমলে জনশক্তি রপ্তানির ব্যবসা শুরু করে মুসা। প্রথমে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল শাহবাজ ইন্টারন্যাশনাল, পরে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম হয় ড্যাটকো।

তবে মুসার পরিচয় তুলে ধরতে গিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম অস্ত্র ব্যবসার কথাই আগে বলে।

ফরিদপুরের মুক্তিযোদ্ধারা বলেন, মুসা বিন শমসেরের সঙ্গে একাত্তরে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা মেজর আকরাম কোরাইশীর বেশ ঘনিষ্ঠতা ছিল। সেনাক্যাম্পে নারী সরবরাহের অভিযোগ তার বিরুদ্ধে ছিল।

২০১০ সালের ‘মুক্তিযুদ্ধে ফরিদপুর’ বইয়ে লেখক আবু সাঈদ খানও একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুসা বিন শমসেরের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের কথা উল্লেখ করেছেন। 

ফরিদপুর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার আবুল ফয়েজ শাহ নেওয়াজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুসা বিন শমসেরের ভূমিকা পাকিস্তানিদের পক্ষে ছিল।

“৭১ সালের পাক সেনারা ফরিদপুর স্টেডিয়ামের ভেতরে টর্চার সেল তৈরি করেছিল। সেখানে মুসার বেশ যাতায়াত ছিল। সে সময় ফরিদপুরে প্রচার ছিল, মুসা পাক সেনাদের নারীসহ বিভিন্ন কিছু সরবরাহের কাজ করতেন।”

মুক্তিযোদ্ধা একেএম আবু ইউসুফ সিদ্দিকী পাখী বলেন, একাত্তরের ২১ এপ্রিল যখন পাকিস্তানি সৈন্যরা আসি আসি করছে, তখন পুরনো পেট্রোল পাম্পের কাছে মুসা বিন শমসেরকে কিছু বাঙালি যুবককে নিয়ে বিরাট এক পাকিস্তানি পতাকা হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলেন তিনি।

একটি চাইনিজ রাইফেল নিয়ে ফরিদপুর শহরের আলীমুজ্জামান ব্রিজের ওপর দিয়ে বাসস্ট্যান্ডের দিকে তখন যাচ্ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা ইউসুফ।

“আমি রাইফেল উঠিয়ে তাক করে বলি, শালার দালাল, শেষ করে দেব। ওরা দৌড় দেয়। কিন্তু পরিস্থিতির কথা ভেবে গুলি না করে দ্রুত স্থান ত্যাগ করি।”

পরে মুক্তিযুদ্ধের একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়ে সার্কিট হাউসে মুসাকেও দেখেন বলে জানান ইউসুফ।

“আমাকে সার্কিট হাউজে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন দেখলাম, মেজর কোরায়েশীর সঙ্গে মুসা বিন শমসের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে। তখন আমি বুঝতে পারি আমার গ্রেপ্তারের পেছনে কাদের হাত রয়েছে।”

মুসার বেয়াই শেখ সেলিমের দল আওয়ামী লীগের ফরিদপুর জেলার ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মাসুদ হোসেন বলেন, তিনি নিজের চোখে না দেখলেও ফরিদপুরের সবার জানা ছিল যে একাত্তরে মুসা বিন শমসেরের ভূমিকা ভালো ছিল না।

“সবাই জানে, তিনি (মুসা) পাকিস্তানি সেনাদের সাথে চলাফেরা করতেন। বিভিন্ন সময়ে পাক সেনারা পথ চেনার জন্য তাকে সঙ্গে নিয়ে যেত।”

পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে জিপে করে তাকে ঘুরে বেড়াতে দেখেছেন বলে ফরিদপুর লালন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সালামত হোসেন খান জানান।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মুসা বিভিন্ন জায়গায় খান সেনাদের এলান (ঘোষণা) মাইকিং করত। গোয়ালচামট এলাকায় স্বর্ণকুটিরে (দোতলা ভবন) তৎকালীন ম্যালেরিয়া অফিসের একটি গুদামে রাতে খান সেনারা জলসা করত। সেখানে মুসা নারী সরবরাহ করত।”

দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘সেই রাজাকার’ কলামে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুসা বিন শমসেরের বিতর্কিত ভূমিকার বিবরণ তুলে ধরেছিলেন সাংবাদিক প্রবীর সিকদার।

ওই ঘটনার কিছুদিন পর এক হামলায় প্রবীর সিকদার একটি পা হারিয়ে পঙ্গু হয়ে যান। ওই হামলার মামলায় মুসাকে আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার আবেদন জানিয়েছিলেন প্রবীর সিকদার, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি।

ববি হাজ্জাজ, এরশাদের সঙ্গে

বাবার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগের বিষয়ে ববি হাজ্জাজ বলেন, “এটা ডাঁহা মিথ্যা কথা। বাংলাদেশে একটি রীতি দাঁড়িয়ে গেছে যে মানি লোকের সম্পর্কে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া। এ ধরনের কোনো ঘটনা (পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে আঁতাত) ঘটেনি।”

তবে নিশ্চিত হওয়ার জন্য অনুসন্ধান চালানোর পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “আপনারা যদি চান তাহলে ইনভেস্টিগেট করে দেখতে পারেন।”

[প্রতিবেদনটি তৈরি করতে সহযোগিতা করেছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ফরিদপুর প্রতিনিধি শেখ মফিজুর রহমান শিপন।]