বুধবার বিকালে মংলা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা চিকিৎসক আব্দুল নাছের বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গ্রামবাসী যে তেল তোলার কাজ করছে তাতে তারা অভ্যস্ত নন। তেলে এক ধরনের তেজষ্ক্রিয়তা রয়েছে।
“আগে এই ধরনের কাজ না করার কারনে প্রথম প্রথম গ্রামবাসীর তেলের গন্ধে নাড়ি মুচড়িয়ে বমি বমি ভাব এসেছে। এতে কেউ হয়ত দুয়েকবার বমিও করে থাকতে পারেন।”
“জল থেকে তেল তোলার সময়ে এদের হাত ও পা-জ্বালাপোড়া করেছে। কিছু পরে তা স্বাভাবিক হয়ে আসে। গত ছয়দিন ধরে যারা ওই তেল সংগ্রহের কাজ যারা করছেন তাদের শরীরে কোন ফোস্কা পড়তে দেখা যায়নি। এমন কোন রোগী এখনো আমাদের কাছে আসেনি,” বলেন তিনি।
তিনি বলেন, “সুন্দরবনের বিভিন্ন নদীখালে তেল সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত স্থানীয় গ্রামবাসী ও জেলেদের স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখতে চিকিৎসক সুদীপ বালাকে প্রধান করে চার সদস্যের একটি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে।
“আরও কিছুদিন না গেলে বলা যাচ্ছেনা, যে এদের শরীরে চর্ম জাতীয় রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়বে কি না। এদের সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রাখতে ওই মেডিকেল দলকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।”
ট্যাংকার ডুবির ঘটনায় বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নুরুল করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নদীখালে ভেসে আসা তেল তোলার কাজ শুরুর পর আমি ও আমার কমিটির সদস্যরা পর্যবেক্ষণ করেছি। নদীতে ভেসে আসা (র্ফানেস অয়েল) তেল দেখতে অনেকটা গ্রাম্যভাষায় মাটে তেলের মতো।”
“ওই তেল মানুষের শরীরে লাগলে চর্মজাতীয় কোন রোগব্যাধি হতে পারে তা আমার মনে হয়নি। তবে ওই তেল তোলার কাজে নিয়োজিত গ্রামবাসী ও জেলেদের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে সরকার একটি মেডিকেল দল গঠন করে দিয়েছে। ওই দল এদের স্বাস্থ্যগত সমস্যা হচ্ছে কি না তা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করছে।”
সুন্দরবন সংলগ্ন মংলা উপজেলার চিলা ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য লুৎফর রহমান বলেন, “আমার ওয়ার্ডের অন্তত এক থেকে দেড়শ গ্রামবাসী গত শুক্রবার থেকে নদীতে তেল তোলার কাজ করছে।
“তারা বলেছে তেল তোলার শুরুতে তাদের হাত ও পায়ে তেল লাগলে একটু জ্বলে যায়। পরে আবার স্বাভাবিক হয়ে আসে। তাদের হাতে পায়ে কোন ফোসকা পড়তে এখনো দেখিনি। এখনো তাদের শারীরিক কোন সমস্যা দেখা দেয়নি। তবে সামনে কোন সমস্যা হবে কিনা তা তো এখন বলা যাচ্ছেনা।”
ছয়দিন ধরে তেল সংগ্রহের কাজ করা সুন্দরবন সংলগ্ন মংলা উপজেলার চিলা ইউনিয়নের জয়মনিঘোল গ্রামের রুস্তম হাওলাদার ও জামাল সিকদারও জানালেন একই কথা। তারা বললেন, তেল তোলার পর গরম পানি, সাবান ও নারকেলের তেল দিয়ে ভাল করে গা-হাত-পা ধুয়ে ফেললেই আগের মত হয়ে যাচ্ছে।
একই গ্রামের লালু বেগম বলেন, “আমরা ২০-২৫ জন মহিলা বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া শেলা নদীতে ভেসে আসা তেল তুলেছি। কিন্তু আমাদের এখনো কোন শারীরিক সমস্যা হয়নি।
“তবে কিছু মানুষ টাকার রোজগারের নেশায় সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত না খেয়ে তেল তোলার কারণে তেলের গ্যাসে বমি করেছে বলে শুনেছি।”
৯ নভেম্বর কাণ্ডারি-১ নামের তেল বহনকারী ট্যাংকারটি ডুবে যাওয়ার একদিন পর থেকে শেলা নদী ও তার সঙ্গে যুক্ত খালে বিলে তেল ছড়িয়ে পড়ায় স্থানীয় জেলে ও গ্রামবাসীরা তেল সংগ্রহের কাজে নামে।
টানা ষষ্ঠ দিনেও স্থানীয় গ্রামবাসী ও জেলেরা পানিতে ভাসমান তেল সংগ্রহ করলেও এর পরিমাণ অনেকটা কমে এসেছে বলে জানিয়েছেন তারা।
বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ৬০ হাজার লিটার তেল নদী ও খাল-বিল থেকে সংগ্রহ করে পদ্মা অয়েলের নিয়োগ করা ঠিকাদার মেসার্স আব্দুল্লাহ ট্রেডার্সের কাছে বিক্রি করা হয়েছে বলে প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী রফিকুল ইসলাম বাবুল জানিয়েছেন।
রফিকুল ইসলাম বাবুল বলেন, “ত্রিশ বছর ধরে ফার্নেস অয়েলের ব্যবসা করছি। এই তেল হাতে পায়ে লেগে কারও স্বাস্থ্যগত সমস্যা অর্থাৎ চর্মরোগ হয়েছে শুনিনি বা দেখিনি।
“দিন যাচ্ছে আর তেল তোলার পরিমাণ কমে যাচ্ছে। বুধবার মাত্র চার হাজার ৬০০ লিটার তেল কিনতে পেরেছি। এই নিয়ে গত ছয়দিনে সুন্দরবনের নদীখাল থেকে গ্রামবাসীর তোলা প্রায় ষাট হাজার লিটার তেল কেনা হয়েছে।”
জয়মনিঘোল গ্রামের নুর মোহম্মদ বলেন, “নদীতে এখন আর তেল আগের মতো ভাসতে দেখা যাচ্ছে না। তাই গ্রামবাসীও নদীতে এখন কম যাচ্ছে।
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) বেলায়েত হোসেন বলেন, “গত ৯ ডিসেম্বর সুন্দরবনের শেলা নদীতে তেলের ট্যাংকার ডুবির পর ওই ট্যাংকারের ভেসে যাওয়া তেল অপসারণে শতাধিক শ্রমিক নিয়ে কাজ করেছি।
“এখন নদীতে তেমন একটা তেল ভাসতে দেখা যাচ্ছেনা। নদীর পানি স্বাভাবিক হয়ে আসতে শুরু করেছে।”
তিনি বলেন, “বুধবার শেলা নদীর বিভিন্ন এলাকায় বেশ কিছু জেলেকে মাছ শিকার করতে দেখা গেছে। সুন্দরবনের শেলা নদীর মৃগমারী এলাকায় আজ দুপুরে দুই তিনটি ডলফিন লাফাতে দেখেছি।”
আন্ধারমানিক এলাকায় লবন পানির একটি কুমিরকে রোদ পোহাতে দেখেছেন বলেও তিনি দাবি করেন।