গ্রেপ্তার ব্যাংক কর্মকর্তা ওয়াহেদুজ্জামান সোহেল (৩৬) ডাচ বাংলা ব্যাংকের শান্তিনগর শাখার কর্মরত। তার সঙ্গে ওই ব্যাংকের গুলশান শাখার পিয়ন আল আমিন সুমনও (২৬) গ্রেপ্তার হয়েছেন।
অন্যরা হলেন- মো. জাকির হোসেন (৪১), সোনিয়া আক্তার লিপি (২০), মো. রিজভী খায়ের (৩৭), মো. আবুল কালাম শেখ (৫৮) এবং আবুল কাশেম প্রামানিক স্বপন (৩৮)।
জাকির হোসেন এই চক্রের হোতা বলে র্যাব সদর দপ্তরের সহকারী পরিচালক মাকসুদুল আলম জানিয়েছেন। হোসেন ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক জাকির। তার প্রতিষ্ঠানেরই কর্মচারী সোনিয়া।
মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর উত্তরা, রামপুরাসহ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করা হয়। তারা ব্যাংকের চেক জালিয়াতি করতে সংঘবদ্ধভাবে কাজ করত, বলেন র্যাব কর্মকর্তা মাকসুদ।
র্যাব জানিয়েছে, তাদের কাছে তিনটি ব্যাংকের ২০০টি চেকের মূল পাতা, বিভিন্ন চেকের ১০২টি ফটোকপি, প্রায় ৩০০টি ব্যাংকের স্টেটমেন্ট পাতা, ব্যাংক হিসাব খোলার শতাধিক ফরম, ১০ জন ব্যক্তির প্রতিষ্ঠানের সিলসহ বিভিন্ন সামগ্রী পাওয়া গেছে।
তাদের গ্রেপ্তারের পর বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাব জানায়, জাকিরের পরিকল্পনা অনুযায়ী সোনিয়ার নামে বিভিন্ন ব্যাংকে ১৪-১৫টি একাউন্ট খোলা হত। চেক থেকে কিভাবে স্বাক্ষর-নম্বর ব্লেড দিয়ে উঠাতে হয়, তাও সোনিয়াকে শেখানো হয় বলে র্যাবের কাছে জাকির স্বীকার করেছে।
র্যাবের মুখপাত্র মুফতি মাহমুদ বলেন, আল আমিন পিয়ন হিসেবে চেক ‘ক্লিয়ারিং’য়ের কাজ করত। ব্যাংকের গুলশান শাখায় আসা যাওয়ার কারণে জাকির এবং সোনিয়ার সঙ্গে তার পরিচয় হয়।
এছাড়া একইভাবে ডাচ বাংলা ব্যাংকের ‘রিলেশন অফিসার’ সোহেলের সঙ্গেও পরিচয় হয় জাকির ও সোনিয়ার। পরে সোহেল বদলি হলেও যোগাযোগ রেখে যায় তারা।
এই পরিচয়ের সূত্র ধরে ‘ক্লিয়ারিং’এর জন্য আসা বিভিন্ন ব্যাংকের চেকের পাতার ফটোকপি চলে যেত জাকির-সোনিয়ার কাছে, বলেন র্যাব কর্মকর্তা মুফতি মাহমুদ।
গ্রেপ্তার রিজভী খায়ের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিপণন কর্মকর্তা এবং আবুল কাশেম স্বপন ব্র্যাক ব্যাংকের কর্মকর্তা ছিলেন।
র্যাব জানায়, এই দুজনসহ কালাম শেখের সঙ্গেও জাকিরের সম্পর্ক গভীর। ব্যাংক চেকের বিভিন্ন তথ্য তারা আদান-প্রদান করার পশাপাশি চেক জালিয়াতিতে সহায়তা করতেন।
“এই চক্রটি মূলত বিদেশিদের একাউন্ট, ব্যাংকে যাদের টাকার পরিমাণ বেশি, বিভিন্ন ব্যাংকে যার একাধিক একাউন্ট আছে এসব চেকগুলোকেই তারা টার্গেট করে,” বলেন মুফতি মাহমুদ।
চেক জালিয়াতি করে এ পর্যন্ত তারা ৫০ লাখ টাকার মতো আত্মসাৎ করেছে বলে র্যাবের কাছে স্বীকার করেছেন এই সাতজন।
ব্যাংকের আরও কিছু অসাধু কর্মকর্তা- কর্মচারী এসবে জড়িত বলে স্বীকারোক্তি পেয়েছেন জানিয়ে র্যাব কর্মকর্তা মুফতি মাহমুদ বলেন, তাদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে।
গত ২৬ অক্টোবর সোনালী ব্যাংকের লালমাটিয়া শাখা থেকে গ্রাহকদের ৫৫টি চেক চুরি হলে বিষয়টি গণমাধ্যমে আলোচনায় আসে। ‘হারিয়ে যাওয়া’ এসব চেকের মধ্যে একটি জমা দিয়ে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক থেকে টাকা তোলারও চেষ্টা হয়।
গত দুই মাসে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অন্তত ১৪টি ব্যাংকের বিভিন্ন শাখা থেকে চেক, ডিডি, এফডিআর ডকুমেন্ট, এসডিআর, এমটিডিআর, পে-অর্ডার, আমদানি-রপ্তানির এলসি ডকুমেন্টের মতো গ্রাহকদের গুরুত্বপূর্ণ নথি খোয়া যাওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।
‘হারিয়ে যাওয়া’ নথি ব্যবহার করে অন্য ব্যাংকে জালিয়াতি ঠেকাতে প্রতিটি ঘটনার পর প্রত্যেক ব্যাংককে চিঠিও দিয়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক।
এর আগে ফ্যানফোল্ড ভাউচার জালিয়াতি করে সোনালী ব্যাংকের ঢাকার মিরপুর শাখা থেকে ১৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় একটি চক্র, যা আর ব্যাংক উদ্ধার করতে পারেনি।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে ধরা পড়ে, সোনালী ব্যাংকের শিল্প মন্ত্রণালয় শাখার জাহিদুল ইসলাম নামে এক কর্মকর্তা ভুয়া হিসাব খুলে বিভিন্ন গ্রাহকের একাউন্ট থেকে প্রায় ৫০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক সব ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের চিঠি দিয়ে এ ধরনের কর্মকর্তাদের সতর্ক হওয়ারও পরামর্শ দেয়।