মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কত- ঠিক হয়নি ৪৩ বছরেও

স্বাধীনতার ৪৩ বছরেও নিরূপণ হয়নি বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গেছে এই বীর সেনানীদের নামও।

শহীদুল ইসলামবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Dec 2014, 11:49 AM
Updated : 16 Dec 2014, 02:13 PM

তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নির্ধারণ করে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা হালনাগাদ করছে। আগামী স্বাধীনতা দিবসের আগেই তা চূড়ান্ত করা হবে বলে ঘোষণা রয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই ১৬ ডিসেম্বরের আগে মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের ঘোষণা দিলেও তা করতে পারছি না, এজন্য দুঃখিত। তবে আগামী স্বাধীনতা দিবসের আগেই এই তালিকা চূড়ান্ত করা হবে।”

তালিকা চূড়ান্তের আগে ‘লাল মুক্তি বার্তা’র বাইরে সবগুলো তালিকাই যাচাই-বাছাই করা হবে জানিয়ে মোজাম্মেল বলেন, লাল মুক্তি বার্তায় যাদের নাম আছে তাদের নিয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে তা খতিয়ে দেখা হবে।

বিগত বিএনপি সরকারের পাশাপাশি গত আওয়ামী লীগ সরকারের তালিকা নিয়েও বিতর্কের বিষয়টি স্বীকার করে তিনি জানান, মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে অন্তর্ভুক্তির জন্য নতুন করে ১ লাখ ২৩ হাজার আবেদন পাওয়া গেছে।

মন্ত্রী বলেন, “অনেক অভিযোগ পেয়েছি। যুদ্ধ না করেও ভুল তথ্য দিয়ে অনেকে সনদ নিয়েছেন। এই অপকর্মের চক্র গড়ে উঠেছিল, আমরা ভুয়া সনদগুলো বাতিল করছি।

“আগুন লাগলে আগে আগুন নেভাতে হবে, পরে খোঁজ নেওয়া হবে কে আগুন দিয়েছিল,” বলেন মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল।

মুক্তিযোদ্ধা সনদধারী প্রায় ৫০ হাজার জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, উপজেলা পর্যায়ের কমিটি দিয়ে এগুলো যাচাই করা হবে।

নতুন করে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ে উপজেলা পর্যায়ে কমিটি গঠনে একটি খসড়া নীতিমালা করা হয়েছে। শিগগিরই নীতিমালাটি চূড়ান্ত করা হবে বলে মন্ত্রী জানান।

“মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা চূড়ান্ত করে সফটওয্যারের মাধ্যমে তা তথ্যভাণ্ডারে যোগ করা হবে। এই কাজটি শেষ হলে সবাইকে সনদ দিয়ে গেজেট প্রকাশ করা হবে।”

নতুন করে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়নে মন্ত্রণালয়ের কোনো কার্যক্রম থাকবে না জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, নতুন করে ভুয়া কেউ মুক্তিযোদ্ধা হবেন কি না তা নির্ভর করবে উপজেলা কমিটির ওপর।

একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনী এবং রাজাকারদের হাতে নির্যাতিত নারীদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গত ১৩ অক্টোবর মুক্তিযোদ্ধার নতুন সংজ্ঞা ঠিক করে সরকার।

মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা চূড়ান্তে কোনো রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী দেখা হবে না জানিয়ে মোজাম্মেল বলেন, “কেউ জামায়াত করলে তো তাকে আমরা বাদ দিতে পারব না। আবার কেউ আওয়ামী লীগ করছে বলেই তাকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে না।”

রূপান্তরে মুক্তিযোদ্ধা

সেনাবাহিনীর সংরক্ষিত দলিলের তথ্যানুযায়ী, স্বাধীনতার পর কয়েকজন সেক্টর কমান্ডার ও সাব-সেক্টর কমান্ডারদের প্রকাশিত বইয়ে নিয়মিত বাহিনীর ২৪ হাজার ৮০০ এবং অনিয়মিত বাহিনীর ১ লাখ ৭ হাজারসহ মোট ১ লাখ ৩১ হাজার ৮০০ জনকে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে গণ্য করা হয়।

বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ১৯৯৮ সালের আগ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের চার-পাঁচটি তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ নিলেও তা চূড়ান্ত রূপ পায়নি।

মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমিন আহমেদ চৌধুরী বিভিন্ন সেক্টরের তথ্য নিয়ে একটি তালিকা ভলিউম আকারে প্রকাশ করেন, যাতে ৭০ হাজার ৮৯৬ জন মুক্তিযোদ্ধাকে তালিকাভুক্ত করা হয়। বাকি ৬০ হাজার ৯০৪ জন কোন তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবেন তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।

কর্মকর্তারা জানান, ১৯৯৮ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের তৎকালীন মহাপরিচালক মমিনউল্লাহ পাটোয়ারীর মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ প্রথমবারের মতো একটি তালিকা করে।

ওই তালিকাটি মুক্তিযোদ্ধা সংসদে ‘লাল বই’ নামে সংরক্ষিত রয়েছে। বর্তমানে এই তালিকায় ১ লাখ ৫৪ হাজার জনের নাম থাকলেও সবার নামে গেজেট প্রকাশিত হয়নি বলে জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী।

এই ‘লাল বই’য়ে আমিন আহমেদের তালিকার বেশিরভাগের নাম অন্তর্ভুক্ত হলেও কিছু নাম বাদ পড়েছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

তালিকা: ২০০১-০৬ পর্যায়

বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিগত চারদলীয় জোট সরকার মুক্তিযোদ্ধা সংসদকে দায়িত্ব না দিয়ে তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব সা’দত হুসাইনের নেতৃত্বে চারজন সচিব ও খেতাবধারী মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে একটি জাতীয় কমিটি করে।

এই কমিটির দায়িত্ব ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা তৈরি করে সরকারকে সুপারিশ করা, যাদের নাম গেজেট আকারে প্রকাশ করা হবে।

ওই জাতীয় কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ২০০২ সালের ৪ মার্চ সশস্ত্র বাহিনীর ৩৯ হাজার মুক্তিযোদ্ধার নামে ‘বিশেষ গেজেট’ এবং ১ লাখ ৫৯ হাজার মুক্তিযোদ্ধার নামে ‘গেজেট’ প্রকাশ করা হয়।

বিএনপি সরকার নতুন করে আরও ৪৪ হাজার জনকে মুক্তিযোদ্ধার সনদ দিয়ে মোট ১ লাখ ৯৮ হাজার জনের নামে গেজেট প্রকাশ করে।

তালিকা: ২০০৯-১৪ পর্যায়

চারদলীয় জোট আমলে ৭২ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাকে তালিকায় সন্নিবেশিত করা হয় বলে জাতীয় সংসদে অভিযোগ তোলেন তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এ বি তাজুল ইসলাম।

এরপর ২০০৯ সালের ১৩ মে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত নেয় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।

তবে বিএনপি সরকারের মতো তাজুল ইসলামও জেলা প্রশাসক ও ইউএনওদের নিয়ে কমিটি করে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ের দায়িত্ব দেন। মুক্তিযোদ্ধা সংসদকে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করে ডিসি-ইউএনওদের কাছে দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়।

দুই বছরেও ডিসি-ইউএনওদের নেতৃত্বের কমিটি তালিকা যাচাইয়ের কাজ শেষ করতে না পারায় মন্ত্রণালয় এবং এ সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির হস্তক্ষেপে অভিযুক্ত ৬২ হাজার জনের তালিকা এবং নতুন করে আরও ১ লাখ ৪৫ হাজার জনের নাম অন্তর্ভুক্তির তালিকা যাচাই-বাছাইয়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

কিন্তু ওই সময়কার মুক্তিযোদ্ধা সংসদের মেয়াদ শেষ পর্যায়ে থাকায় এই যাচাই-বাছাইয়ের কাজ আর এগোয়নি বলে সংসদের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

এরপর গত আওয়ামী লীগ সরকার ২০১০-২০১২ সালে আরও ১১ হাজার জনকে মুক্তিযোদ্ধার সনদ দিয়ে মোট দুই লাখ নয় হাজার জনের নাম তালিকাভুক্ত করে।

বর্তমান সরকার

এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আলোচনা শুরু হলে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের বৈঠকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যাচাইয়ের সিদ্ধান্ত হয়।

এরপর কয়েক সচিবের সঙ্গে কয়েকশ’ সরকারি কর্মকর্তাসহ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সনদ ও গেজেট বাতিল করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, যা চলমান রয়েছে।

নতুন সংজ্ঞার আলোকে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে গেজেটভুক্ত হওয়ার জন্য গত ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের ওয়েবসাইটে অনলাইনে আবেদন জমা নেওয়া হয়।

আ ক ম মোজাম্মেল হক

বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ মুক্তিযোদ্ধাদের যচাই-বাছাই ও সংখ্যা সংক্রান্ত বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে এ সংক্রান্ত সুপারিশ মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে, যার অনুলিপি হাতে পেয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।

এতে বলা হয়েছে, নতুন করে তালিকাভুক্ত করা বিএনপি সরকারের ৪৪ হাজারের বেশিরভাগ এবং বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তালিকাভুক্ত করা ১১ হাজারের অর্ধেকই ভুয়া।

লাল বইয়ের পদ্ধতি/প্রক্রিয়া অনুসরণ করে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সব স্তরের নির্বাচিত কমান্ডারদের সঙ্গে সব স্তরের স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পৃক্ত করে কমপক্ষে দুই/তিন স্তর কমিটি রেখে তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের সুপারিশ করেছে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।

মন্ত্রীও বলছেন, উপজেলা পর্যায়ে সাত সদস্যের একটি কমিটি মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাই করবে। স্থানীয় সংসদ সদস্য মুক্তিযোদ্ধা হলে তিনি ওই কমিটির সভাপতি হবেন। আর স্থানীয় সাংসদ মুক্তিযোদ্ধা না হলে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারকে মন্ত্রণালয় সভাপতি হিসাবে নিয়োগ দেবে।

মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল ও জেলা কমান্ড কাউন্সিলের একজন করে প্রতিনিধি এই কমিটিতে থাকবেন।

এছাড়া কমিটিতে উপজেলা কমান্ডারের সঙ্গে সদস্য হিসাবে মুক্তিযুদ্ধকালীন আরেকজন কমান্ডার মন্ত্রণালয় ঠিক করে দেবে বলেও জানান মোজাম্মেল।

মন্ত্রী জানান, কমিটিতে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের পক্ষ থেকে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে মনোনয়ন দেওয়া হবে। ইউএনও সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন।