সেই সঙ্গে ট্যাংকার দুর্ঘটনায় বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনে ছড়িয়ে পড়া তেল সরাতে এবং ক্ষতি যাতে আর না বাড়ে- তা নিশ্চিত করতে বিষয়টি ‘ভালোভাবে’ পর্যবেক্ষণের ওপর জোর দিয়েছেন তিনি।
সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর গোপালগঞ্জ ও যশোরের জেলার প্রশাসক এবং ঢাকা ও খুলনার বিভাগীয় কমিশনারের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী এসব নির্দেশনা দেন।
গত ৯ ডিসেম্বর সুন্দরবনের শেলা নদীতে সাড়ে ৩ লাখ লিটার ফার্নেস অয়েল নিয়ে ‘ওটি সাউদার্ন স্টার-৭’ নামের ওই ট্যাংকারডুবির পর এই প্রথম প্রধানমন্ত্রীর কোনো সরাসরি নির্দেশনা এল।
সুন্দরবনের নদী ও খালে ছড়িয়ে পড়া তেল সংগ্রহে গত তিনদিন ধরে স্থানীয় গ্রামবাসী, জেলে ও শ্রমিকদের নিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে স্থানীয় প্রশাসন। তবে সেখানে কাজ চলছে হাঁড়ি-পাতিল ও চটের বস্তা নিয়ে স্থানীয় পদ্ধতিতে।
প্রথমে রাসায়নিক ব্যবহার করে তেল দূষণ কমানোর কথা ভাবা হলেও পরে সুন্দরবনের ক্ষতির আশঙ্কায় তা স্থগিত করে কর্তৃপক্ষ।
মন্ত্রিপরিষদ সভাকক্ষে বৈঠক থেকে খুলনার বিভাগীয় কমিশনারের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী তেল অপসারণে স্থানীয়দের অংশগ্রহণের প্রশংসা করেন।
তিনি বলেন, “এলাকাবাসী নিজ উদ্যোগে এই তেল সরিয়ে নিচ্ছে। এজন্য তাদের ধন্যবাদ জানাই।”
তবে এরই মধ্যে সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকায় তেল ছড়িয়ে পড়ায় ইরাবতী ডলফিনের সবচেয়ে বড় এই অভয়াশ্রম মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়েছে বলে প্রতিবেশ ও প্রাণীবৈচিত্র্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
এছাড়া শ্বাসমূলীয় বন সুন্দরবনের গাছপালা ও জলজ সম্পদেরও মারাত্মক ক্ষতি হবে বলে তাদের আশঙ্কা।
এ ধরনের ঘটনা যাতে ভবিষ্যতে আর না ঘটে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকার নির্দেশনা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সুন্দরবনের বিষয়টি ভালো করে মনিটরিং করা দরকার, তেল সরানো এবং আর ক্ষতি যাতে না হয়। ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের ঘটনা না ঘটে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।”
এ সময় খুলনা বিভাগীয় কমিশনার সুন্দরবনে ট্যাঙ্কার ডুবির ঘটনায় তেল অপসারণে জোরালোভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, “সোমবার থেকে সুন্দরবনে আরও বেশি লোক লাগিয়েছি, আরও নৌকা নামানো হয়েছে। সেখানে আরও বেশি তেল সংগ্রহ করা হচ্ছে। গতকাল পর্যন্ত ৪০ হাজার ২০০ লিটার তেল সংগ্রহ করা হয়েছে।”
মংলা বন্দরের কাজ বন্ধ করে দেওয়ায় বিএনপি সরকারের সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, “ঘষিয়াখালী খাল অনেকদিন ড্রেজিং করা হয়নি। সিলড হয়ে গিয়েছিল।
“বিএনপির সময় মংলা বন্দরের কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেজন্য এই দিকটায় কেউ আর খেয়াল করে নাই। ঘষিয়াখালীর যে শাখা খালগুলো ছিল, তার মুখে চিংড়ি ঘের করে পানি আসার পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই ঘেরগুলো বন্ধ করে দিতে হবে।”
ঘষিয়ার খাল চালু হলে মংলা বন্দরে যেতে পথ সাত থেকে আট কিলোমিটার পথ কমে যাবে, বলেন প্রধানমন্ত্রী।
মংলার নালা ও রামপালের কুমার নদী ভরাট হয়ে ভারত-বাংলাদেশ নৌ প্রটোকল রুট ও দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে দেশের নৌবাণিজ্য যোগাযোগ পথ হিসেবে ব্যবহৃত ঘষিয়াখালী চ্যানেলটি প্রায় তিন বছর ধরে বন্ধ রয়েছে।
তখন থেকে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে শেলা নদীকে বিকল্প পথ হিসেবে ব্যবহার করছে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআইডব্লিউটিএ।
পরিবেশ বিপর্যয়ের ঝুঁকির কারণে বিশ্বঐতিহ্য সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে এই নৌপথ বন্ধ করার জন্য বিভিন্ন সময়ে দাবি এসেছে। শেলা নদীর ঘটনার পর পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ও ওই পথে নৌযান চলাচল স্থায়ীভাবে বন্ধের সুপারিশ করেছে। তবে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান তা নাকচ করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমি নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়কে এই ঘষিয়াখালী খাল চালুর কথা বলেছি। এর মুখ থেকে চিংড়ি ঘের সরিয়ে দিতে হবে, যাতে খালগুলো বন্ধ না হয়।”
ঝিনুক ও শামুক সংরক্ষণের নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “চিংড়ির খাবার হিসেবে ব্যাপকভাবে শামুক ব্যবহৃত হচ্ছে। চিংড়ি ঘেরের জন্য সব শামুক সংগ্রহ করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে খাল-বিল শামুকশূন্য হয়ে যাবে। ইকো ব্যালেন্স নষ্ট হবে।”
দুই জেলার জেলা প্রশাসকের সঙ্গে আলাপচারিতায় প্রধানমন্ত্রী ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ে সম্মেলন আয়োজনের প্রশংসা করেন। গত ২০ নভেম্বর ওই সম্মেলন হয়।
শেখ হাসিনা বলেন, “ডিসি-ডিএম সম্মেলন একটি ভালো উদ্যোগ। মাদক, চোলাচালান, নারী ও শিশু পাচার বন্ধে একটি ভালো উদ্যোগ। কারও একার পক্ষে এগুলো বন্ধ করা সম্ভব না। এজন্য প্রতিবেশী দেশগুলোর যৌথ উদ্যোগ দরকার।”
দুই দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে এ ধরনের সম্মেলন করা যায় কি না সে ব্যাপারেও চিন্তা-ভাবনা করার পরামর্শ দেন সরকারপ্রধান।
ভিডিও কনফারেন্সে ভারত থেকে যাতে ভেজাল সার আসতে না পারে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে যশোরের জেলা প্রশাসক হুমায়ুন কবীরকে নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।
যশোরের পুলিশ সুপার প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নিয়ে কাজ করছে।
শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী তার নিজ এলাকা গোপালগঞ্জের বিভিন্ন বিষয়ে খোঁজ নেন।
গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসক খলিলুর রহমান গোপালগঞ্জের মানুষের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ পরিস্থিতি ও সামাজিক উন্নয়ন চিত্র তুলে ধরেন।
গোপালগঞ্জের সিভিল সার্জন, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরেন।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী এ এলাকার মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বলেন।
যেসব এলাকায় বিদ্যুৎ নেই সেসব এলাকায় সোলার প্যানেলের মাধ্যমে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেন তিনি। সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচিগুলোকে বেশি গুরুত্ব দিতে বলেন তিনি।
ভিডিও কনফারেন্সের সময় সচিবালয়ে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, রেলমন্ত্রী মজিবুল হক, জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমত আরা সাদিক, মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসেন ভূইঞাসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।