তারেক সাঈদ, আরিফ ও রানা ৭ খুনে দোষী: র‌্যাব

লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ হোসেন এবং নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কমান্ডার এমএম রানাকে দায়ী করে নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত খুনের ঘটনায় তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছে র‌্যাব।

সুপ্রিম কোর্ট প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Dec 2014, 10:59 AM
Updated : 10 Dec 2014, 06:27 PM

এদের মধ্যে ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার জামাতা র‌্যাব-১১ এর সাবেক অধিনায়ক তারেক সাঈদ ও কোম্পানি কমান্ডার আরিফ নারায়ণগঞ্জের প্যানেল মেয়রসহ সাতজনকে অপহরণ থেকে শুরু করে শীতলক্ষ্যায় লাশ ডুবানো পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়ায় জড়িত ছিলেন।

আর রানা অপহরণে অংশ নিয়ে ঘটনায় আংশিক জড়িত ছিলেন বলে র‌্যাবের এই অভ্যন্তরীণ তদন্তে বেরিয়ে এসেছে।

এই তিনজনসহ র‌্যাবের মোট ২১ সদস্যের নাম এসেছে প্রতিবেদনে, যারা কোনো না কোনোভাবে হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ত ছিলেন বলে র‌্যাব মনে করছে।

আর নারায়ণগঞ্জের দুই আওয়ামী লীগ নেতা সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও কাউন্সিলর নূর হোসেনের দ্বন্দ্বকেই এ হত্যাকাণ্ডের মূল কারণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

এতে বলা হয়েছে, একই ধারার রাজনীতি করলেও ব্যবসায়িক স্বার্থ, এলাকায় প্রভাব বিস্তার এবং রাজনৈতিক অবস্থানগত প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে ওই দুই জনের মধ্যে দীর্ঘদিনের শত্রুতা ও পাল্টাপাল্টি মামলা ছিল।

“সম্ভবত এ কারণেই নূর হোসেন তার পক্ষে কাজ করার মতো প্রশাসনের লোকের অন্বেষণে ছিলেন। অব্যাহত প্রচেষ্টায় তিনি র‌্যাব-১১ এর সিপিএসসির কোম্পানি কমান্ডার মেজর আরিফ হোসেন, পরবর্তীতে র‌্যাব-১১ এর অধিনায়ক তারেক সাঈদ মোহাম্মদকে সহযোগী হিসাবে পেয়ে যেতে সমর্থ হন বলে প্রতীয়মান হয়।”

আলোচিত ওই হত্যাকাণ্ডে র‌্যাব সদস্যদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ওঠার আট মাস পর বুধবার এই এলিট বাহিনীর প্রতিবেদন হাই কোর্টে উপস্থাপন করা হয়।

আদালতে প্রতিবেদনটি পড়ে শোনান অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। গত ২৩ নভেম্বর তার হাতে এই প্রতিবেদন জমা দেন র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) আফতাব উদ্দিন।

অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতের বাইরে সাংবাদিকদের বলেন, সাত খুনের ঘটনায় র‌্যাবের কারা জড়িত, অপহৃতদের উদ্ধারে গাফিলতি ছিলো কিনা- এ বিষয়গুলো দেখতে আদালত এই অভ্যন্তরীণ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিল, এটি হত্যাকাণ্ডের মূল তদন্ত প্রতিবেদন নয়। 

“এই প্রতিবেদন বিচারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। গোয়েন্দা পুলিশ যে চার্জশিট দেবে, যেভাবে আদালতে তুলবে, তার ভিত্তিতেই বিচার হবে।”

ওই ঘটনায় প্রশাসনের কেউ বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সদস্যের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা বা সংশ্লিষ্টতা ছিল কি না- গণতদন্তের মাধ্যমে তা উদঘাটনে কাজ করছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় গঠিত আরেকটি কমিটি। আদালতের নির্দেশে গঠিত ওই কমিটি র‌্যাবের মহাপরিচালক মোখলেছুর রহমান, অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসানকেও জিজ্ঞাসাবাদ করে।

সাত খুনে জড়িত অন্য যাদের নাম র‌্যাবের প্রতিবেদনে এসেছে, সেই তালিকাও পড়ে শোনান অ্যাটর্নি জেনারেল।

“এরা হলেন- এসআই পূর্ণেন্দু বালা, এবি আরিফ হোসেন, নায়েক নাজিম, নায়েক দেলোয়ার, ল্যান্স নায়েক হিরা মিয়া, সৈনিক মহিউদ্দিন মুন্সী, সৈনিক আব্দুল আলিম, সৈনিক আলামিন, সিপাহী তৈয়ব, কনস্টেবল সিহাবুদ্দিন, কনস্টেবল আলামিন, হাবিলদার এমদাদ, ল্যান্স নায়েক বেলাল হোসেন, সৈনিক আসাদ, সার্জেন্ট এনামুল, এএএসআই বজলু, হাবিলদার নাসির, সৈনিক তাজুল।”

নারায়ণগঞ্জের র‌্যাব-১১ তে কর্মরত এই র‌্যাব সদস্যের ‘উপস্থিত থেকে’ হত্যাকাণ্ডে ‘সহায়তা’ করেছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। 

প্যানেল মেয়র নজরুল, তার বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন, গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম, আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহীম গত ২৭ এপ্রিল অপহৃত হন। পরে শীতলক্ষ্যা নদী থেকে তাদের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

গত ৩০ এপ্রিল লাশ উদ্ধারের ছবি

 

এর পরপরই র‌্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল ওঠে। নজরুলের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম অভিযোগ করেন, র‌্যাব কর্মকর্তারা কাউন্সিলর নূর হোসেনের কাছ থেকে ৬ কোটি টাকা নিয়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নূর হোসেনকে প্রধান আসামি করে একটি মামলাও করেন তারা।

এরপর হাই কোর্ট র‌্যাব-১১ এর তিন কর্মকর্তা তারেক সাঈদ, আরিফ ও রানাকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেয়। ওই তিনজনকে নারায়ণগঞ্জ থেকে সরিয়ে এনে সামরিক বাহিনী থেকে অবসরে পাঠায় সরকার।

পরে তাদের গ্রেপ্তার করা হয় এবং কয়েক দফা রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের পর তিনজনই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

র‌্যাব সদর দপ্তর ওই ঘটনা সম্পর্কে জানত কি-না এমন প্রশ্নে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “আমি এটা দাখিল করেছি, সদরদপ্তর জানত কি-না সম্পূর্ণ প্রতিবেদন পড়ার পরই তা বোঝা যাবে।”

সরকারের শীর্ষ এই আইন কর্মকর্তা বলেন, “প্রতিবেদন পেয়ে আদালত মন্তব্য করেছেন, এটা যেদিন চূড়ান্ত হলো, তারপরেও অনেকে অপরাধ স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে বলে কাগজে এসেছে। আমি বলেছি, এটাতো তদন্ত সংস্থা না। প্রাথমিকভাবে যারা জড়িত বলে প্রতীয়মান হয়েছে, তাদের নামই এখানে এসেছে।”

আদালতে স্বীকারোক্তি দেওয়ার আগে সাত খুনে জড়িত থাকার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে তারেক সাঈদ দাবি করেছিলেন, ছয় কোটি টাকা নেওয়ার অভিযোগ ‘গণমাধ্যমের সৃষ্টি’।

স্বীকারোক্তির খবর যেভাবে গণমাধ্যমে এসেছে তার সমালোচনা করে র‌্যাবের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতিও দেওয়া হয়।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, র‌্যাবের ওই সময়ের বক্তব্য সম্পর্কে তিনি অবগত নন।

২০০৪ সালে গঠনের পর থেকে ৮০০ বিচারবহির্ভূত হত্যার জন্য র‌্যাবকে দায়ী করে এ বাহিনী ভেঙে দিতে একাধিকবার সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন।

র‌্যাব প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম ব্রাউনফিল্ড সম্প্রতি বলেন, প্রশিক্ষণ ও চর্চার ধরন ভিন্ন হওয়ায় সেনা সদস্য ও পুলিশ সদস্যদের এক বাহিনীতে না রাখাই ভালো।